অবসরগ্রহণের পর বিচারপতিদের রাজনীতিতে যোগদান আখেরে বিচারব্যবস্থা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সন্দেহ তৈরি করে। বিদেশে এক আলোচনাসভায় গিয়ে এমনই মন্তব্য করলেন ভারতের প্রধান বিচারপতি বিআর গবই। পাশাপাশি, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ নিয়েও বেশ কিছু মন্তব্য করেছেন তিনি।
ব্রিটেনে সুপ্রিম কোর্ট আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি গবই। ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের মহিলা প্রধান বিচারপতি ব্যারোনেস কার, বিচারপতি বিক্রম নাথ এবং ব্রিটেনের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি জর্জ লেগেটের উপস্থিতিতে ভারতের বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে বলতে গিয়ে রাজনীতি ও বিচারব্যবস্থা নিয়ে বেশ কিছু মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, ‘‘ভারতে বিচারপতিদের অবসরের একটি নির্দিষ্ট বয়সসীমা থাকে। যদি কোনও বিচারপতি অবসর গ্রহণের পরেই সরকারের অন্য কোনও পদ গ্রহণ করেন অথবা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য পদত্যাগ করেন, তা হলে তা তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে নীতিগত উদ্বেগের সৃষ্টি করে। জনসাধারণের নজরেও পড়ে এই ঘটনাগুলি।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘একজন বিচারপতি (অবসরপ্রাপ্ত) রাজনৈতিক পদের জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, সেটা বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা এবং নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। সন্দেহ সৃষ্টি করতে পারে। কারণ, একে স্বার্থের সংঘাত বা সরকারের অনুগ্রহ অর্জনের প্রচেষ্টা হিসাবে দেখা যেতে পারে। তাই অবসর-পরবর্তী এই ধরনের কর্মকাণ্ড বিচার বিভাগের উপর জনগণের আস্থা কমাতে পারে।’’
উল্লেখ্য, অবসরের পরে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ-এর রাজ্যসভায় মনোনয়ন নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হয়েছে। হালফিলে কর্মরত অবস্থায় কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতির পদ ছেড়ে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিজেপি-তে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি বিজেপি সাংসদ। কিছু দিন আগে সুপ্রিম কোর্টের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ধনঞ্জয় যশবন্ত (ডিওয়াই) চন্দ্রচূড়কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, অবসরের পরে বিচারপতিদের রাজনীতিতে যোগ দেওয়া উচিত কি না। তিনিও অনেকটা বর্তমান প্রধান বিচারপতির সুরেই জানিয়েছিলেন, অবসরজীবনে নিজে এমন কিছু করবেন না যা বিচারপতি হিসাবে তাঁর কাজ বা বিচারব্যবস্থার প্রতি তাঁর আনুগত্য নিয়ে সংশয়ের অবকাশও তৈরি করতে পারে।
প্রধান বিচারপতি গবই ওই আলোচনাসভায় জানান, সরকার যখন বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিত, তখন এমনও হয়েছে, প্রধান বিচারপতি নিয়োগের সময় সিনিয়র বিচারপতিকে বাদ রেখে অন্যদের বেছে নেওয়া হচ্ছে। ভারতে দু’বার এই ঘটনা ঘটেছে। তাঁর মন্তব্য, ‘‘ভারতে বিতর্কের অন্যতম বিষয় হল বিচারপতি নিয়োগে কার প্রাধান্য থাকবে। ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট এবং হাই কোর্টে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগেরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ছিল। ওই সময়কালে দু’বার ভারতের প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে সিনিয়র বিচারপতিদের বাতিল করা হয়েছিল। যা সেই সময়ে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যের বিরোধী।’’ বস্তুত, শীর্ষ পদের জন্য যে দুই বিচারপতিকে বাতিল করা হয়, তাঁরা হলেন বিচারপতি সৈয়দ জাফর ইমাম এবং বিচারপতি হংসরাজ খন্না। ১৯৬৪ সালে স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে বিচারপতি ইমামকে ওই পদে উন্নীত করা যায়নি। আর ১৯৭৭ সালে বিচারপতি খন্না ইন্দিরা গান্ধী সরকারের বিরাগভাজন হয়ে প্রধান বিচারপতির পদ হারান। প্রধান বিচারপতি গবই জানান, এর ফলে সুপ্রিম কোর্ট তার ১৯৯৩ এবং ১৯৯৮ সালের রায়ে বিচারপতিদের নিয়োগ সম্পর্কিত সাংবিধানিক বিধানগুলি ব্যাখ্যা করে বলে যে, শীর্ষ আদালতে নিয়োগের কলেজিয়াম গঠন হবে। সেই কলেজিয়ামে থাকবেন প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্টের চার জন সিনিয়র বিচারপতি।
আরও পড়ুন:
অন্য দিকে, সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়ামের মাধ্যমে বিচারপতি নিয়োগ ঘিরে গত কয়েক বছর ধরেই ধারাবাহিক ভাবে প্রশ্ন তুলছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। ওই প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিতর্কের আবহেই কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রীর পদ থেকে সরতে হয় কিরেন রিজিজুকে। এমনকি, এ নিয়ে বিতর্ক গড়িয়েছে সুপ্রিম কোর্টেও। ২০১৫ সালে মোদী সরকার সুপ্রিম কোর্ট এবং বিভিন্ন রাজ্যের হাই কোর্টগুলির বিচারপতিদের নিয়োগের ক্ষেত্রে দু’দশকের কলেজিয়াম ব্যবস্থাকে পাল্টে দিয়েছিল। বিকল্প হিসাবে জাতীয় বিচারবিভাগীয় নিয়োগ কমিশন (এনজেএসি) গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কেন্দ্র। এই উদ্দেশ্যে সংসদ এবং ১৬টি রাজ্যের বিধানসভায় বিলও পাশ করানো হয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ এনজেএসি গড়ার ব্যবস্থাকে ‘অসাংবিধানিক’ ঘোষণা করে কলেজিয়াম প্রথাই বহাল রাখার রায় দেয়। আলোচনায় প্রধান বিচারপতি গবই বলেন, ‘‘কলেজিয়াম ব্যবস্থার সমালোচনা হতে পারে, কিন্তু বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে কোনও সমাধানে আসা উচিত নয়।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘বিচারপতিদের অবশ্যই বহিরাগত নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত থাকতে হবে।’’