Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
National News

পেট্রল ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হল দলিত জনমজুরের মেয়েকে, দুষ্কৃতীরা এখনও অধরা

সঞ্জলি তাই মৃত্যুশয্যায় তার মাকে বলেছিল, ‘‘লড়াইটা আমি লড়তে পারলাম না মা। হেরে গেলাম। তোমরা লড়াইটা চালিয়ে যেও। ওরা (অপরাধীরা) যেন কিছুতেই পার না পায়।’’

সঞ্জলি। ছবি- সংগৃহীত।

সঞ্জলি। ছবি- সংগৃহীত।

সংবাদ সংস্থা
লালাউ (আগরা) শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৭:৪৪
Share: Save:

দলিত পরিবারের কন্যা সঞ্জলি বড় হয়ে আইপিএস অফিসার হতে চেয়েছিল। সব অন্যায়, অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চেয়েছিল। মা, বাবার পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিল। পরিবারের সকলকে নিয়ে সুখে দিন কাটাতে চেয়েছিল।

সঞ্জলি পারেনি। ৫০ শতাংশ দগ্ধ হয়ে সঞ্জলি তাই মৃত্যুশয্যায় তার মাকে বলেছিল, ‘‘লড়াইটা আমি লড়তে পারলাম না মা। হেরে গেলাম। তোমরা লড়াইটা চালিয়ে যেও। ওরা (অপরাধীরা) যেন কিছুতেই পার না পায়।’’

চোখ মুছতে মুছতে ১৫ বছর বয়সী মেয়ের বলে যাওয়া শেষ কথাগুলি আওড়াতে আওড়াতে সঞ্জলির মা অনিতা চাণক্য বললেন, ‘‘আমার মেয়ের গায়ে যারা কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়েছে, তাদের জেলে না পোরা পর্যন্ত থামব না। শেষ দেখেই ছাড়ব।’’

আগরার নৌমিল গ্রামে আশরাফি দেবী চিদ্দা সিংহ ইন্টার-কলেজ স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ত সঞ্জলি। লালাউ গ্রামের বাড়ি থেকে সঞ্জলির স্কুল ছিল ৫ কিলোমিটার দূরে। স্কুলে যাওয়া-আসার সময় রোজ ওই পথটা হয় সাইকেলে বা পায়ে হেঁটেই পেরোত সঞ্জলি। গত মঙ্গলবার স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে ৩৯ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশের বালির রাস্তা ধরে হাঁটছিল সঞ্জলি। সেই সময় আচমকাই দুই অজ্ঞাতপরিচয় যুবক একটি মোটরসাইকেলে চেপে এসে তার গায়ে পেট্রল ছিটিয়ে, জ্বলন্ত লাইটার ছুড়ে দেয়। দাউদাউ আগুনে পুড়তে শুরু করে সঞ্জলি। তা দেখে পথচারীরা তড়িঘড়ি একটি স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যায় সঞ্জলিকে। সে দিন সন্ধ্যায় সঞ্জলিকে নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লির সফদরজঙ হাসপাতালে। বৃহস্পতিবার সেখানেই মৃত্যু হয় সঞ্জলির। লালাউ আর তার আশপাশের গ্রামগুলিতে মেয়েদের স্কুল রয়েছে তিনটি। ওই ঘটনার পর থেকে সবগুলিই বন্ধ। ছাত্রীরা ভয়ে স্কুলে যেতে চাইছে না। ওই হামলার পর চার দিন কেটে গিয়েছে। তাতেও প্রশাসনের টনক নড়েছে, বোঝা যাচ্ছে না। এখনও অপরাধীরা ধরা পড়েনি।

আরও পড়ুন- সোশ্যাল মিডিয়ায় কটাক্ষ, লাইভ ভিডিয়োয় আত্মহত্যার চেষ্টা তরুণীর!​

আরও পড়ুন- দলিত-আদিবাসী নন, তিনি জৈন, বজরঙ্গবলির সঙ্কট বাড়িয়ে সামনে এল নতুন বার্থ সার্টিফিকেট!​

আগরার সার্কেল অফিসার ডিএসপি নম্রিতা শ্রীবাস্তব বলেছেন, ‘‘খুব শীঘ্রই আমরা অপরাধীদের ধরে ফেলব।’’ কিন্তু আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন পেশায় দিনমজুর, সঞ্জলির বাবা হরেন্দ্র সিংহ। বললেন, ‘‘আর কবে ধরবে! তারা কি আর আছে এলাকায়? পালিয়ে গিয়েছে অন্য কোথাও।’’

সঞ্জলির বাবা হরেন্দ্র সিংহ ও মা অনিতা চাণক্য। ছবি- সংগৃহীত

দলিত বলেই কি এই ভাবে খুন হতে হল সঞ্জলিকে? সঞ্জলির বাবার অবশ্য তা মনে হয় না। তাঁর কথায়, ‘‘আমার মনে হয় না দলিত বলে আমার মেয়ে খুন হয়েছে। দিনকয়েক আগে রাতে বাড়ি ফেরার সময় অন্ধকারে আমাকেও আক্রান্ত হতে হয়েছিল। আমার মাথায় আঘাত করা হয়েছিল। তখন বুঝিনি, ওদের হাত থেকে মেয়েকেও বাঁচাতে পারব না।’’

অপরাধীরা ধরা না পড়লেও, সঞ্জলির পরিবারকে কোনও রাজনৈতিক দলই এখন ছাড়তে চাইছে না। সঞ্জলির বাড়িতে এসেছিলেন উত্তরপ্রদেশের উপ-মুখ্যমন্ত্রী দীনেশ শর্মা সমবেদনা জানাতে এসেছিলেন সঞ্জলির বাড়িতে। জনাকুড়ি পুলিশকর্মী নিয়ে। সঙ্গে এসেছিলেন বিজেপি বিধায়ক হেমলতা দিবাকর ও আগরার প্রাক্তন মেয়র অঞ্জুলা সিংহ মোহর।

কিন্তু না, তার পরেও ধরা পড়েনি অপরাধীরা। সঞ্জলির মা ও বাবা দু’জনেই বললেন, ‘‘ওঁরা বার বার জানতে চাইছিলেন আমাদের কতটা ক্ষতিপূরণ চাই। ২ লক্ষ নাকি ৫ লক্ষ টাকা।’’ সঞ্জলির মা অনিতা বললেন, ‘‘ওঁদের বলে দিয়েছি, কিছুই চাই না। শুধু চাই অপরাধীদের এখনই ধরা হোক। আর তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হোক।’’ পাশ থেকে সঞ্জলির দিদি অঞ্জলি বললেন, ‘‘ওঁর (উপ-মুখ্যমন্ত্রী দীনেশ শর্মা) নিজের মেয়ে হলে তো অপরাধীরা এই ভাবে পার পেয়ে যেত না।’’

শুধু শাসক দল বিজেপি নয়, সঞ্জলির বাড়ি ঘুরে গিয়েছেন কংগ্রেস, বহুজন সমাজ পার্টি ও সিপিএমের মহিলা শাখা সংগঠনের নেতা, নেত্রীরাও। ‘ভিম সেনা’র প্রধান চন্দ্রশেখর আজাদ টুইট করে হুমকি দিয়েছেন, ‘‘অপরাধীরা এখনই ধরা না পড়লে এপ্রিলে যেমনটা হয়েছিল, সেই ভাবে গোটা দেশ অচল করে দেব।’’ ভিম সেনারা ১ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে সঞ্জলির পরিবারের জন্য। চেয়েছে সিবিআই তদন্ত।

কিন্তু সেই সব নিয়ে ভাবার সময়ই নেই এখন সঞ্জলির মা, বাবার। মেয়ের স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে সঞ্জলির বাবা বললেন, ‘‘মেয়েকে বলেছিলাম, তুই আইপিএস অফিসার হবি কী করে? আমার তো অত টাকা নেই। তোকে তো সেই ভাবে লেখাপড়া করাতে পারব না। মেয়ে বলেছিল, চিন্তা কোরো না বাবা, ওটা আমি বুঝে নেব।’’ পড়শিরাও জানাচ্ছেন বেশ মেধাবী ছিল সঞ্জলি। ফি-বছরই পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করত। দিদি অঞ্জলি বললেন, ‘‘সাধারণ জ্ঞানের প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে একটা সাইকেল প্রাইজ পেয়েছিল ও।’’

সেই সাইকেলটা এখনও পড়ে রয়েছে সঞ্জলির বাড়ির সামনের ঘরটায়। একা।

আর চার পাশ থেকে আসা ক্ষতিপূরণের লক্ষ লক্ষ টাকার আশ্বাস কানেই ঢুকছে না সঞ্জলির মা, বাবার। তাঁরা শুধুই ভাবছেন, অপরাধীরা ধরা পড়বে কবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dalit Girl Sanjali Lalau সঞ্জলি
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE