E-Paper

মহোৎসবের প্রতীক্ষায় দিন গুনছে বাণিজ্যনগরী

পুজোর আনন্দে শামিল হওয়ার পাশাপাশি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাঙালিদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশ নেন অবাঙালিরাও। নিছক গুনগুন নয়, রীতিমতো প্রস্তুতি নিয়ে মঞ্চে উঠে বাংলা গানও গেয়ে থাকেন।

স্বর্ণাভ দেব

শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২৩ ০৮:৪০
durga puja.

বছরভর ব্যস্ততার মাঝে পুজোর ক’টা দিনের জন্য অপেক্ষায় থাকেন প্রবাসী বাঙালিরা। —ফাইল চিত্র।

মেলাবেন তিনি মেলাবেন— এই আপ্তবাক্যই যেন এক লহমায় বাণিজ্যনগরী মুম্বইয়ের দুর্গাপুজোর নির্যাস। যেখানে মিলে যায় নানা ভাষাভাষির মানুষ। বছরভর ব্যস্ততার মাঝে পুজোর ক’টা দিনের জন্য অপেক্ষায় থাকেন প্রবাসী বাঙালিরা।

পুজোর আনন্দে শামিল হওয়ার পাশাপাশি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাঙালিদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশ নেন অবাঙালিরাও। নিছক গুনগুন নয়, রীতিমতো প্রস্তুতি নিয়ে মঞ্চে উঠে বাংলা গানও গেয়ে থাকেন।

এই যেমন ডোম্বীবলীর পালাবায় প্রবাসী বেঙ্গলী অ্যাসোসিয়েশনের কথাই ধরা যাক। সেখানে নাচ-গান-অভিনয়ে অংশ নিচ্ছেন অবাঙালিরা। শ’পাঁচেক পারফর্মারের অনেকেই অবাঙালি। এদের অনেকেরই প্রথম পছন্দ বাংলা গান। নাচের জন্যও বেছে নিচ্ছেন বাংলা গানই। এমনকি অবাঙালিদের কোনও কোনও দল নিজেদের নাম রেখেছে ‘ধুনুচি নাচ’ বা ‘বাংলার মাটি’। অথচ গোটা দলে নেই এক জন বাঙালিও।

চলতি বছরে নয়ে পা দিচ্ছে প্রবাসী বেঙ্গলী অ্যাসোসিয়েশনের পুজো। এ বারে বাজেট ২০ লক্ষ টাকা। চন্দ্রযান-৩ অভিযান এ বারের থিম। আশির দশক থেকে এখনও পর্যন্ত যত উপগ্রহ ইসরো তৈরি করেছে, সেই সম্পর্কে তথ্য প্যান্ডেলের ভিতরে প্রদর্শিত হবে। পুজোর পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এখানকার বিশেষ আকর্ষণ। সাংস্কৃতিক শাখার প্রধান অপরাজিতা রায় বলেন, “অনুষ্ঠানে প্রচুর মানুষ অংশ নেন। পুজোকে কেন্দ্র করে পর্যটন গড়ে ওঠার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে।” সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের ‘রেজিস্ট্রেশন ফি’ থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে পুরুলিয়ার একটি গানের দল আনা হচ্ছে।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মাথায় রেখে এ বারে থিম বেছে নিয়েছে ৯৪-এ পা দিতে চলা বম্বে দুর্গাবাড়ি সমিতি। প্রতি বছরেই ভাষা ও সংস্কৃতির উপরে নজর রেখে থিম তৈরি করেন এই ঐতিহ্যবাহী পুজো কর্তৃপক্ষ। আয়োজকদের লক্ষ্য বাঙালি সংস্কৃতি, আচার এমন ভাবে তুলে ধরা, যা আগামী প্রজন্মের মধ্যেও সঞ্চারিত হতে পারে। সেই রীতি অনুযায়ীই এ বারে পটচিত্র শিল্প তুলে ধরা হবে মণ্ডপে। বম্বে দুর্গাবাড়ি সমিতির সভাপতি সুস্মিতা মিত্র বলেন, “এ বারে লোকশিল্প তুলে ধরছি। প্রতিমাসজ্জাও সে ভাবেই হবে। এ জন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে শিল্পী আনা হয়েছে। শিল্পীরা এখানে নিজেদের শিল্পকর্ম যেমন মণ্ডপসজ্জায় তুলে ধরবেন, তেমনই আমাদের স্টলে নিজেদের সৃষ্টিও উপস্থাপিত করতে পারবেন।” উদ্যোক্তারা মনে করছেন, শনি ও রবিবার বিপুল ভিড় হতে পারে। সে ভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁরা। ভোগেরও বিরাট বন্দোবস্ত করা হয়েছে। সেতার, রবীন্দ্রসঙ্গীত, গীতীনাট্য, নাটকে জমজমাট থাকে পুজোর প্রতিটি দিন।

গত বার সেই অর্থে অতিমারি শঙ্কা কেটে গেলেও উদ্বেগের রেশটুকু থেকে গিয়েছিল। এ বারে যেন জৌলুস-জাঁকজমকের আয়োজনে সমস্ত উদ্বেগ-আশঙ্কা ঝেড়ে ফেলে দুর্গোপুজোর আনন্দযজ্ঞে ঝাঁপ দিতে মরিয়া বাণিজ্যনগরী। জুহু কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের পুজোর সভাপতি বিশ্ববরণ চক্রবর্তীর এ নিয়ে দ্বিমত নেই। এ বছর তাঁদের পুজো ২৪ বছরে পড়ছে। সাবেকি পুজোর পাশাপাশি, ভোগ এই পুজোর অন্যতম আকর্ষণ। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহে দৈনিক হাজারেরও বেশি দর্শনার্থী ভোগ খান। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীতে সে জন্য খিচুড়ির বন্দোবস্ত থাকছে। প্রবীণ নাগরিকদের আলাদা বসে খাওয়ানোর বন্দোবস্ত কর হয়। উল্লেখ্য, বয়স্কদের খাওয়ার সময়ে পরিবেশনের দায়িত্বেও থাকেন প্রবীণরাই।

সপ্তমী থেকে ভোগের আয়োজন হলেও পেটপুজোর মধ্য দিয়ে হুল্লোড়ের শুরু পঞ্চমী থেকেই। আনন্দমেলার আয়োজন করা হয়। পুজোর বাইরে জনকল্যাণমূলক কাজ হিসাবে পিছিয়ে পড়া শিশুদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থাও করেন তাঁরা। এ বারে অষ্টমীতে বিশেষ অতিথি হিসাবে মর্যাদা দেওয়া হবে গরিব শিশুদের। পুজোর দিনগুলোয় ভোগ্যপণ্যের স্টল থাকবে মণ্ডপ চত্বরে। সেখানে খাবার, শাড়ির পাশাপাশি গাড়ি প্রদর্শনীর ব্যবস্থাও থাকছে। বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষেরা স্টলে বসে আঁকবেন। তাঁদের আঁকা ছবি বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ দুঃস্থ মানুষদের সাহায্যে ব্যবহার করা হবে। আর এ সবের সঙ্গে প্রতিদিন সন্ধেয় থাকছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

অধিকাংশ পুজো কমিটিই যেখানে নিজেদের বারোয়ারি পুজো বলে দাবি করে থাকেন, সেখানে কিছুটা ব্যতিক্রমী স্পন্দন ফাউন্ডেশন পওয়াই শারদোৎসব। এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত অনিন্দিতা চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “এটা একটা পারিবারিক পুজো।” পরিবার বলতে অনিন্দিতা পুজোর সংগঠক, সদস্য সকলকেই একসঙ্গে বেধে ফেলেছেন। পুজোর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য স্বপন ঘোষ বলেন, “আমরা জাতপাতে নয়, জনকল্যাণে বিশ্বাসী।”

এ বছর এগারোয় পা দিচ্ছে পওয়াইয়ের এই দুর্গাপুজো। বাজেট প্রায় কোটি টাকা। সাবেকি ঘরানা বজায় রেখেই পুজোর আয়োজন করা হয়। তবে একে নিছক ধর্মীয় অনুষ্ঠান বলতে নারাজ স্বপন। তাঁর কথায়, “এ এক উৎসব। আর আমরা উদ্দেশ্য নিয়ে পুজো করি। সেই জন্যই আমাদের পুজোর ট্যাগলাইন ‘ফেস্টিভ্যাল উইথ পারপাস।’ প্রতি বারই জনকল্যাণমূলক কাজে আমরা জোর দিয়ে থাকি। প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যারা লড়াই করে দাড়িয়েছেন, এর আগে তাঁদের আমরা তুলে ধরেছি। বৃদ্ধবাস থেকে প্রবীণ মানুষদের পুজো দেখতে নিয়ে আসার বন্দোবস্তও করা হয়েছে। পুজোয় শামিল করা হয়েছে অনাথ শিশুদেরও।”

এখানকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও বেশ জমাটি হয়। বলিউড-টলিউডের মেলবন্ধন এক বড় আকর্ষণ। এ বারেও কলকাতার শিল্পীদের অনুষ্ঠান থাকছে। এখানকার ভোগও খুব জনপ্রিয়। শেষ লগ্নে সিঁদুরখেলাও এখানকার আর এক আকর্ষণ।

নিছক পুজো নয়, দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে মহোৎসবের রূপ নেয় মুম্বই। হয়ে ওঠে মহামিলনের ক্ষেত্র।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Durga Puja 2023 Mumbai

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy