ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনকে (এসআইআর) কেন্দ্র করে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে সুর সপ্তমে বেঁধেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রশ্ন তুলেছেন তাদের এক্তিয়ার নিয়েও। এ বার প্রশাসনিক ভাবে সুর চড়াল কমিশনও। আধিকারিক নিয়োগ নিয়ে কমিশনের সুনির্দিষ্ট বিধি লিখিত ভাবে রাজ্যের মুখ্যসচিবকে স্মরণ করিয়ে দিল তারা। বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, হয় রাজ্যকে কমিশনের বার্তা মানতে হবে, না হয় তা রাজ্য-কমিশনের চলতি সংঘাতে ভিন্ন মাত্রা যোগ করবে। এসআইআর শুরুর আগে এই বার্তা কমিশনের তরফে কার্যতসতর্কবার্তার মতোই।
ভোটার তালিকা সংস্কারের প্রশ্নে ইলেক্টোরাল রেজিস্ট্রেশন অফিসারদের (ইআরও) গুরুত্ব অনেক। কারণ, তাঁদের সিদ্ধান্তেই স্থির হয়, কে ভোটার তালিকাভুক্ত হবেন, কে বাদ যাবেন। কমিশনের বিধি অনুযায়ী, এসডিও বা মহকুমাশাসকেরাই ইআরও হতে পারেন। প্রয়োজনে এসডিও পদমর্যাদার কোনও আধিকারিককে সেই দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু এ রাজ্যের ২৯৪টি বিধানসভা আসনের অর্ধেকের বেশি কেন্দ্রে জুনিয়র অফিসারেরাই ইআরও-র দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। যা কমিশনের বিধির সঙ্গে মানানসই নয়। এ নিয়ে আগেই রাজ্যকে উপযুক্ত পদক্ষেপ করতে বলেছে কমিশন। এ বার রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক (সিইও) এবং মুখ্যসচিবকে লিখিত ভাবে কমিশন জানিয়ে দিল, নিয়োগ-প্রশ্নে মানতেই হবে তাদের বিধি।
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবারই মুখ্যসচিবকে পাশে নিয়ে মমতা জানিয়েছিলেন, ভোট ঘোষণা হলে তবেই আধিকারিকেরা কমিশনের নিয়ন্ত্রণে আসেন। তার আগে নয়। পাশাপাশি কমিশনও বার্তা দিয়েছিল, এসআইআরের সময়েই রাজ্যে আধিকারিকেরা চলে আসবেন তাদের নিয়ন্ত্রণে।
রাজ্যের ২৯৪টি বিধানসভা আসনের প্রতিটিতে এক জন করে ইআরও দায়িত্বে থাকেন। কমিশনের তথ্য— এই ২৯৪ জন ইআরও-র মধ্যে ৬৮টি বিধানসভা কেন্দ্রে এসডিও-রা ইআরও-র দায়িত্ব পালন করছেন। ৭৪টি বিধানসভা কেন্দ্রে ভিন্ন ভিন্ন দফতরের আধিকারিকেরা ইআরও-র দায়িত্ব পালন করলেও, তাঁরা এসডিও পদমর্যাদার। ফলে এই ১৪২ ইআরও-কে নিয়ে বিধিগত কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু ১৫২টি বিধানসভায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বা ডেপুটি কালেক্টরেরা ইআরও-র দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। এই আধিকারিকেরা এসডিও পদমর্যাদার তো নন, তাঁরা জুনিয়র স্তরের। ফলে সংশ্লিষ্টদের বদলে উপযুক্ত পদমর্যাদার আধিকারিকদের অবিলম্বেনিয়োগ জরুরি।
এখানেই থেমে থাকেনি দিল্লির নির্বাচন সদন। বরং ২০২৩-এর ২৬ জুন পাঠানো একটি নির্দেশিকার কথা মুখ্যসচিবকে স্মরণ করিয়ে কমিশন জানিয়েছে, পর্যাপ্ত সংখ্যায় সরাসরি এসডিও পাওয়া না গেলে রেভিনিউ ডিভিশনার অফিসার (আরডিও) বা অন্য কোনও আধিকারিকদের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে, যাঁরা এসডিও বা আরডিও পদমর্যাদার। মুখ্যসচিবের উদ্দেশে কমিশনের বার্তা—অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রত্যেক বিধানসভা কেন্দ্রের জন্য কমিশনের বিধি মেনে শুধু উপযুক্ত পদমর্যাদার আধিকারিকদেরই ইআরও হিসেবে দ্রুত নিয়োগ করুক রাজ্য।
বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, নির্বাচনী কাজে কমিশনের নির্ধারিত বিধিই মানতে হয় প্রশাসনকে। কারণ, কমিশন সাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতাশালী। রাজনৈতিক ভাবে কমিশনের বিরুদ্ধে সরব থাকলেও, প্রশাসনিক ভাবে সেই অবস্থান বজায় রাখা কঠিন। ফলে প্রশাসনের কোনও পদক্ষেপ বিধিসম্মত না হলে, সে ব্যাপারে যে কোনও ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে কমিশন।
গত বুধ এবং বৃহস্পতিবার দেশের উপ নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ ভারতী-সহ কমিশনের অন্য কর্তারা বৈঠকে স্পষ্ট করেছেন, এ রাজ্যে শুরু হতে চলা এসআইআরে একমাত্র কমিশনের বিধি মেনেই কাজ করতে হবে। বকেয়া কাজ ১৫ অক্টোবরের মধ্যে শেষ করতেই হবে। পর্যবেক্ষক শিবিরের মতে, যে কোনও সময়ে প্রকাশিত হতে পারে এসআইআর-বিজ্ঞপ্তি। তবে কমিশন-কর্তারা জানাচ্ছেন, আগামী ১৯ থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত কালীপুজো, ভাইফোঁটা ইত্যাদি উৎসব উপলক্ষে সরকারি ছুটি। ফলে মূল কাজ হয়তো শুরু হবে তার পরেই। এক কর্তার কথায়, “রাজ্য সফরে কমিশন-প্রতিনিধিরা দিনক্ষণ সম্পর্কে কোনও বার্তা দেননি। সফরের রিপোর্ট দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনারকে দেওয়া হবে। তার পরে কমিশনের ফুল বেঞ্চ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।”
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)