এক দিকে যখন ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে ভারতে আসা হিন্দু, জৈন, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, পার্সিদের নির্ভয়ে এ দেশে থাকার অনুমতি দিল কেন্দ্র, একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক অসমে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালগুলিকে সরাসরি সন্দেহভাজন অনুপ্রবেশকারীদের বন্দি শিবিরে পাঠানোর ক্ষমতাও প্রদান করল। কেন্দ্রের এই দ্বিমুখী সিদ্ধান্তকে ঘিরে নতুন করে জটিলতা, বিক্ষিপ্ত বিক্ষোভ ছড়াল অসমে।
আধা-বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠান ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব হল, অনুপ্রবেশকারী বা বিদেশিদের চিহ্নিত করা। তাঁদের গ্রেফতার করা ও জেলে পাঠানোর অধিকার ছিল পুলিশ-প্রশাসনের। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ট্রাইব্যুনালকে এ বার সেই বিশেষ ক্ষমতাও দিয়েছে। ফলে, এখন থেকে যদি কোনও ব্যক্তির নাগরিকত্ব নিয়ে বিতর্ক থাকে এবং তিনি ট্রাইব্যুনালের সামনে হাজির না হন, তবে ট্রাইব্যুনাল সরাসরি তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে পারবে।
অসমে বিদেশি ট্রাইব্যুনালগুলির কার্যপদ্ধতি নিয়ে দীর্ঘদিনের অসন্তোষ রয়েছে। বহু ক্ষেত্রেই সন্দেহজনক হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া ব্যক্তিদের হাতে নোটিস পৌঁছয় না বা আইনজীবীদের গাফিলতিতে তাঁরা সশরীরে ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে পারেন না বলে অভিযোগ। তখন একপাক্ষিক ভাবেই তাঁদের বিদেশি ঘোষণা করে দেওয়া হয়। দরিদ্র ও নিরক্ষর পরিবারগুলির ক্ষেত্রে প্রায়ই পুরনো সরকারি নথিতে নামের বানান, বয়স ও ঠিকানার বানানে হেরফের হয়ে যায়। সেই সব ছোটখাটো ভুলের ফলেও খারিজ হয় নাগরিকত্ব। বাঙালি ও সংখ্যালঘু সংগঠনগুলির আশঙ্কা, এ বার ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের হাতে গ্রেফতারির ক্ষমতা তুলে দেওয়ায় হেনস্থা বাড়বে।
অবশ্য বিজেপির দাবি, বাঙালি হিন্দুদের ভয় নেই। কারণ, এখন এমন মামলায় তাঁরা সিএএ-র অধীনে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন জানাতে পারবেন এবং কেন্দ্রের নতুন নিয়মে ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে আসা কারও বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। তাঁরা নাগরিকত্ব আইনের প্রচলিত নিয়মে ১১ বছর পরে এমনিই নাগরিকত্বের দাবি জানাতে পারবেন।
কিন্তু বাঙালি মঞ্চগুলির দাবি, নিয়ম যা-ই হোক, ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল বিদেশি ঘোষণা করে দিলে সিএএ-র অধীনে নাগরিকত্ব পেতে হলে তো ভারতীয়দেরও নিজেকে ‘বিদেশি’ বলে হলফনামা দিতে হবে! সংখ্যালঘু সংগঠনগুলির অভিযোগ, এনআরসি-র মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের বিদেশি সাজানোর চক্রান্ত বিফল হওয়ায় এখন এক দিকে হিন্দুদের আইনি সুরক্ষা দিয়ে ও অন্য দিকে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতা বাড়িয়ে বিজেপি তাদের দমননীতিকে বৈধতা দিতে চাইছে।
অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা বলেন, ‘‘সিএএ নিয়ে আশঙ্কা অমূলক প্রমাণিত হয়েছে। এখনও পর্যন্ত নাগরিকত্বের দাবিতে মাত্র ১২টি আবেদন জমা পড়েছে। তিন জন নাগরিকত্ব পেয়েছেন। কেন্দ্রের ওই নতুন সিদ্ধান্তের সঙ্গে সিএএ-র কোনও যোগ নেই। তার সময়সীমাওবাড়ানো হয়নি।’’
অসমের বিরোধী দলনেতা দেবব্রত শইকিয়া অসম আন্দোলনে স্বাক্ষরকারী আসুকে চিঠি লিখে প্রতিবাদ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “নতুন নিয়মের ফলে নাগরিকত্ব পেতে পারেন প্রায় পাঁচ লক্ষ বিদেশি, যাঁদের মধ্যে প্রায় ৬৯,৫০০ জনকে ইতিমধ্যে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল বিদেশি হিসেবে ঘোষণা করেছিল।” কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতির বক্তব্য, এই নয়া নিয়ম আদতে ছদ্মবেশে সিএএ-র সময়সীমা বৃদ্ধি ছাড়া কিছু নয়।
আসুর মতে, নতুন নিয়মে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের তথাকথিত ক্ষমতা বৃদ্ধির আড়ালে তাদের হাত আরও বেঁধে দেওয়া হল। অসম নির্বিচারে বাংলাদেশিদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠতে পারে না। নাগরিকত্ব নিয়ে কোনও নতুন আইন, নিয়ম অসমবাসী মানবেন না।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)