অরুণ জেটলি (১৯৫২-২০১৯)।
২৫ জুন, ১৯৭৫। দিল্লির রামলীলা ময়দানে জয়প্রকাশ নারায়ণের বিরাট জনসভার পরে রাত করেই বাড়ি ফিরেছিলেন অরুণ জেটলি। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র তখন ছাত্র সংসদের সভাপতি। রাত দু’টো নাগাদ বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ল পুলিশ। জেটলির বাবা মহারাজ কিশনও আইনজীবী ছিলেন। বাড়ির দরজায় তিনি যখন পুলিশের সঙ্গে তর্ক জুড়েছেন, সেই সুযোগে জেটলি পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যান। পরের দিন সকালে দেশ জানতে পারল— জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে। সে-দিনই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলেন অরুণ। প্রথমে অম্বালা, তার পর তিহাড়— ১৯ মাস কাটাতে হয় জেলে।
সেই অর্থে অরুণ জেটলির রাজনৈতিক দীক্ষা জেলখানাতেই। জেলে থাকতেই সরাসরি অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আডবাণী, নানাজি দেশমুখদের সংস্পর্শে আসেন। ছাড়া পেতেই তাঁকে এবিভিপি-র সর্বভারতীয় সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। জেটলিও ওকালতির সঙ্গে রাজনীতিকে কেরিয়ার করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।
১৯৭৪ সালে দিল্লির ছাত্র সংসদের নির্বাচনই অরুণ জেটলির শেষ ভোট জয়। পরের চার দশকে তিনি বিজেপির বহু নির্বাচনের কৌশল, প্রচারের কৌশল তৈরি করলেও নিজে ভোটে লড়েননি। তাঁর কোনও জনভিত্তি ছিল না। শেষে ২০১৪-য় লোকসভা ভোটে অমৃতসর থেকে ভোটে লড়ে, প্রবল নরেন্দ্র মোদী-ঝড় সত্ত্বেও হেরে যান। তাতে অবশ্য মোদীর কাছে তাঁর গুরুত্ব কমেনি। শুরুতে অর্থ মন্ত্রকের পাশাপাশি প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দায়িত্ব দেওয়া হয় জেটলিকে।
অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাঁর ট্র্যাক-রেকর্ড নিয়েও বিস্তর প্রশ্ন। অর্থ মন্ত্রকে তাঁর পাঁচ বছরে বার্ষিক আয় বৃদ্ধির হার আট শতাংশ থেকে ছয় শতাংশের ঘরে নেমে এসেছে। বাজারে চাহিদায় ভাটা। বেসরকারি লগ্নি রেকর্ড পরিমাণ কমেছে। কর্মসংস্থানেও দিশা মেলেনি। তাঁর আমলে জিএসটি চালু হলেও, তার রূপায়ণ নিয়ে নানা সমস্যা থেকে গিয়েছে। বিশ্ব বাজারে তেলের কম দামের কল্যাণে মূল্যবৃদ্ধির রাশ টানতে পারলেও, রাজকোষ ঘাটতি সামলাতে পারেননি, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সঞ্চিত পুঁজির ভাঁড়ারে থাবা বসাতে হয়েছে।
তবে, তাঁর অর্থমন্ত্রিত্বে বৃহত্তম প্রশ্নচিহ্নটি বসেছিল ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর। যে দিন টেলিভিশনের পর্দায় নোটবাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। অর্থনীতির পক্ষে প্রাণঘাতী এই সিদ্ধান্তটিতে তৎকালীন অর্থমন্ত্রীর সায় ছিল কি না, বা প্রধানমন্ত্রী আদৌ তাঁর মতামতটুকু নিয়েছিলেন কি না, জানা যায়নি। কিন্তু এটুকু বোঝা গিয়েছিল, অর্থনীতির রাশ তাঁর হাতে নেই। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাঁর মেয়াদের অভিজ্ঞান ছিল এই কর্তৃত্বহীনতা। পাঁচ বছরে এক বারও মনে হয়নি, ভারতীয় অর্থনীতিকে চালনা করার মতো ভাবনা, জোর এবং দক্ষতা তাঁর আছে। তাঁর সঙ্গে সংঘাতের জেরে রঘুরাম রাজন, উর্জিত পটেলরা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের পদ থেকে বিদায় নিয়েছেন। দেউলিয়া বিধির মতো সংস্কার হলেও ব্যাঙ্ক, অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনাদায়ী ঋণের সমস্যার সমাধান হয়নি। কখনও প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তোলা, কখনও ব্যাঙ্কের আমানতের সুরক্ষাকবচ সরিয়ে দিয়ে সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলে তাঁকে পিছু হটতে হয়েছে। প্রকৃত অর্থে যাকে আর্থিক সংস্কার বলা চলে, তেমন কোনও পদক্ষেপ অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি করতে পারেননি।
ক্রিকেট প্রশাসক হিসেবে দিল্লি ডিস্ট্রিক্ট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনে এক দশকের বেশি সময় সভাপতি ছিলেন। তাঁর আমলে ফিরোজ শাহ কোটলা স্টেডিয়াম নতুন করে তৈরি হলেও, তাঁর দলের নেতারাই দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিলেন। এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলি আইন ভেঙে বিদেশ থেকে চাঁদা নিয়েছে কি না, সেই তদন্তের রাস্তা ২০১৮-য় তাঁর পেশ করা শেষ বাজেটে বন্ধ করে দিয়েছিলেন জেটলি। তাঁর আমলে নির্বাচনী বন্ডের ফলে কোন কর্পোরেট সংস্থা কোন দলকে কত চাঁদা দিচ্ছে, সে তথ্য জানার রাস্তাও বন্ধ হয়েছে।
তবে মোদী সরকারের প্রথম পাঁচ বছরে জেটলির ভূমিকা ছিল ‘ট্রাবলশুটার’-এরও। যখনই মোদী সরকার প্যাঁচে পড়েছে, সরকারের হয়ে সওয়াল করতে নরেন্দ্র মোদী তাঁর ‘অরুণজি’-কে এগিয়ে দিয়েছেন। জেটলির ওপর প্রধানমন্ত্রীর আস্থা অনেক দিনের। ১৯৯৫-এ গুজরাতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর মোদীকে দিল্লিতে কাজ করতে পাঠানো হয়। সে সময় দিল্লির বাকি বিজেপি নেতারা তাঁকে বিশেষ গুরুত্ব দেননি, কিন্তু জেটলির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। ২০০১-এ গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হন মোদী। ২০০২-এ গুজরাতের দাঙ্গার পরে দলের মধ্যে বিতর্কে মোদীর পাশে ছিলেন জেটলি, বাজপেয়ী বিরুদ্ধ অবস্থান নিলেও লালকৃষ্ণ আডবাণীর সঙ্গে তিনি মোদীর হয়ে সওয়াল করেন। দাঙ্গার পরে বিধানসভা ভোট নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংঘাতেও তিনি মোদীর পক্ষে সুপ্রিম কোর্টে
লড়াই করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী হয়ে গুজরাত থেকে দিল্লিতে আসা মোদীর কাছে জেটলির সবচেয়ে বড় উপযোগিতা ছিল তাঁর রাজধানীর ‘নেটওয়ার্ক’। অন্য দলের নেতানেত্রী, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, আইনজীবী থেকে খবরের কাগজের মালিক, সম্পাদক, সাংবাদিক মহলে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সংখ্যা ছিল ঈর্ষণীয়। যেচে উপকার করতেন। সাহায্য চাইলে শত্রুকেও ফেরাতেন না। সুযোগ পেলেই পায়ের উপর পা তুলে জমিয়ে গল্প করতেন। চায়ের আড্ডার এই ‘দরবার’-এ তাঁর দলের নেতাদের নিয়ে রসিকতা বাদ পড়ত না। এই সব আড্ডায় নতুন তথ্য, যুক্তি দিয়ে যে কোনও বিতর্কে তাঁর মোচড় সুবিদিত ছিল ‘জেটলি স্পিন’ নামে।
১৯৯৯-এ বিজেপির মুখপাত্র করা হয় মাধ্যম-বান্ধব জেটলিকে। বাজপেয়ী সরকারের তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রক, আইন মন্ত্রক সামলেছেন তিনি। মনমোহন-সরকারের শেষ পাঁচ বছরে টু-জি, কয়লা কেলেঙ্কারির
অভিযোগকে কাজে লাগিয়ে, রাজ্যসভায় আক্রমণাত্মক বিরোধী দলনেতা হিসেবে জেটলির ভূমিকা বিজেপিকে ফায়দা দিয়েছিল।
আইনজীবী হিসেবে জেটলির মক্কেলের তালিকায় ছিল দেশের প্রথম সারির কর্পোরেট সংস্থাগুলি। বাবরি মসজিদ ভাঙার যড়যন্ত্র থেকে হাওয়ালা কেলেঙ্কারির মামলায় তিনিই আডবাণীর প্রধান আইনি উপদেষ্টা ছিলেন। দেশভাগের সময় লাহৌর থেকে অমৃতসরে চলে আসা পঞ্জাবি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম জেটলির। আর পাঁচ জন নিখাদ পঞ্জাবির মতোই ‘চাঙ্গা খানা তে চাঙ্গা পানা’ বা ভাল খাওয়া-পরার সংস্কৃতি তাঁর প্রিয় ছিল। পছন্দ করতেন দামি শাল, কলম, ঘড়ি। কেউ প্রশংসা করলে মনে করিয়ে দিতেন, সবই ওকালতির
উপার্জনে কেনা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy