দূর থেকে মহিলা নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে প্রায় ঝুলতে ঝুলতে আসছিলেন তিনি। জ়ুবিন গর্গের কফিনের কাছে পৌঁছে প্রায় সংজ্ঞাই হারালেন। দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন জ়ুবিনের স্ত্রী গরিমা গর্গ। খাওয়ালেন জল। মাথায় বুলিয়ে দিলেন হাত। খড়কুটোর মতো গরিমাকে আঁকড়ে কেঁদে চলেছেন তবুও। সেই হাহাকারে কোনও অক্ষর নেই। বাক্য নেই। শুধু অব্যক্ত বোধের ভাইরাস আছে। যা পলকে সংক্রমিত করে দিল আশপাশের ভিড়কে। কে কাকে সামলাবেন তখন! পাশেই, কফিনবন্দি গায়ককে সন্তানস্নেহে আদর করছিলেন বৃদ্ধা।
গরিমাকে পেয়ে বোরখা তুলে জড়িয়ে ধরলেন। মুখের বলিরেখারা ভেসে যাচ্ছে বাঁধভাঙা স্রোতে। বলছিলেন, “তুমি কোনও চিন্তা কোরো না মা। আমরা সবাই আছিতোমার সঙ্গে।”
রবিবারের সরুসজাইতে নেমেছিল দিশাহারা শোকের হড়পা বান। আজ সেই ধারা পরিণত, কিন্তু অবিরাম। গত ২৪ ঘণ্টায় অনেক মান-অভিমান, দোষারোপের পালা চলেছে। আজ যেন ছিল মান ভাঙানোর দিন। স্মৃতিচারণের দিন। জ়ুবিনের শেষ যাত্রায় না থাকায় ভ্রাতৃসম অঙ্গরাগ পাপন মহন্তকে বয়কটের ডাক উঠেছিল। আজ তিনি এসে পৌঁছেছেন। শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, “মানুষ যা বলেছে আবেগে বলেছে। দাদা গেল, ভাই থাকলাম। কিন্তু জ়ুবিনের স্থান পূরণ করার সাধ্য আমার নেই।” ছিলেন জ়ুবিনের বহু বছরের সঙ্গী, নায়িকা নিশিতা গোস্বামী, বরষারানি বিষয়ারা।
লেন জুবিনের দীর্ঘদিনের মঞ্চজুটি জ়ুবলি বরুয়া। শিল্পীমহলের ভিড় বলছিল, মনে হচ্ছে ‘গোল্ডি’ এখনই দুই পায়ে দুই রঙা জুতো, আর মাথায় বিচিত্র টুপি বাগিয়ে হাজির হয়ে বেজায় ঠাট্টায় বেকায়দায় ফেলে দেবেএই জমায়েতকে।
এ দিকে, জ়ুবিনের মৃত্যুকে অনেকেই দুর্ঘটনা বলে মানতে নারাজ। স্বচ্ছ তদন্তের দাবি তুলেছেন জ়ুবিন ঘনিষ্ঠরাও। দাবি মেনে মুখ্যমন্ত্রী জানান, “সিঙ্গাপুর ময়নাতদন্ত করার পরে আবারও তা করার অর্থ ছিল না। কিন্তু সকলের সন্দেহ নিরসন করতে, পরিবারের সম্মতি নিয়ে মঙ্গলবার সকালে এমসের চিকিৎসকেরা ফের তাঁর ময়নাতদন্ত করবেন। এর পরে শেষযাত্রায় সামিল হবেন পরিবার-পরিজন মিলিয়ে ৮৫ জন। থাকবেন তিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেণ রিজিজু, পবিত্র মার্গারিটা ও সর্বানন্দ সোনোয়াল। এ ছাড়া আসবেন রাজ্যপাল, হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি, অসম বিধানসভার স্পিকার, বিরোধী দলনেতা, অসম সাহিত্য সভার সভাপতি ও সম্পাদক, আসুর তরফে দু’জন, মেঘালয়ের উপ-মুখ্যমন্ত্রী-সহ মন্ত্রিসভার প্রতিনিধি দল। শেষকৃত্যের পরে অস্থি পরিবারকে ও ভস্ম সংস্কৃতি দফতরকে সমর্পণ করা হবে। আগামী কাল বিকেল চারটে পর্যন্ত জাতীয় সড়কের ওই অংশে গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকবে। গ্রামে গ্রামে স্ক্রিন লাগিয়ে বা টিভিতে চলবে শেষকৃত্যের সরাসরি সম্প্রচার। ১৩ দিনের আচারাদি যোরহাটে হবে। সেখানে চিতাভস্ম রেখে সমাধিক্ষেত্র তৈরি হবে। তিনি আরও জানান, আগামী কাল বেলা ২টোর পরে কেউ জোর করে দোকানপাট বন্ধ করার চেষ্টা করলে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে। জ়ুবিনের নামে গুণ্ডামি বরদাস্তকরা হবে না।
এ দিকে, জ়ুবিনের জলে নামার শেষ ভিডিয়োয় দৃশ্যমান যন্ত্রশিল্পী শেখর গোস্বামী গুয়াহাটিতে ফিরে জানালেন, প্রমোদতরীতে থাকা সকলকে সিঙ্গাপুর পুলিশ ১২ ঘণ্টা জেরা করেছে। শেখর কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “১০ বছর আগে দাদাইআমায় সাঁতার শিখিয়েছিল। সিঙ্গাপুরেও দাদাই জোর করে আমায় জলে নামায়। প্রথম বার লাইফ জ্যাকেট পরে যখন জলে শুয়েছিল, আমায় বলছিল, ভয় পাস না। সমুদ্র কাউকে ডোবায় না। তুই জ্যাকেট না পরলেও ভেসে থাকবি।”
শেখর জানান, ওই ভাইরাল অংশের পরে জ়ুবিন আবার প্রমোদতরীতে ফিরে এসেছিলেন। ফের জলে নামলেও লাইফ জ্যাকেট পরতে রাজি হননি। শেখরের কথায়, “অনেকে সাবধান করেন লাইফ জ্যাকেট ছাড়া নামা ঠিক হয়নি। তাই আমি তাঁকে ফেরাতে যাই। দাদা তখন জলে উল্টো হয়ে শুয়ে। তাঁকে পাশ ফেরাতেই দেখতে পাই, মুখ দিয়ে বের হচ্ছে ফেনা। ওঠানোর চেষ্টা করায় হলুদ বমিও করেন। সকলে মিলে প্রমোদতরীতে তুলে সিপিআর দিলেও জ্ঞান ফেরেনি।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)