সংসদের ওয়েলে নেমে বিক্ষোভ, বিলের কাগজ ছিঁড়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের দিকে ছুড়ে মারা, হইহট্টগোল, চেঁচামেচি— বাদল অধিবেশন শেষ হওয়ার আগের দিন এমন অনেক ছবি দেখা গিয়েছিল লোকসভায়। এই বিশৃঙ্খলার নেপথ্যে শাহের পেশ করা তিন ‘বিতর্কিত’ বিল! তবে এই তিন বিলের মধ্যে বিরোধীদের সবচেয়ে বেশি আপত্তির কারণ ছিল ১৩০তম সংবিধান সংশোধনী বিল নিয়ে।
শাহের পেশ করা সংবিধান সংশোধনী বিলে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, কোনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, রাজ্যের মন্ত্রী কিংবা কোনও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মন্ত্রী যদি গুরুতর অপরাধের অভিযোগে টানা ৩০ দিনের জন্য হেফাজতে থাকেন, তবে ৩১তম দিন থেকে তিনি মন্ত্রিত্ব হারাবেন। পাঁচ বছর বা তার বেশি জেল হতে পারে, এমন অপরাধগুলিকে ‘গুরুতর’ হিসাবে ধরা হবে!
বুধবার শাহ লোকসভায় বিল পেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই হট্টগোল শুরু হয়। বিরোধীদের অভিযোগ, এই বিল আইনে পরিণত হলে তার মাধ্যমে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থাকে কাজে লাগাবে বিজেপি। বিরোধীশাসিত রাজ্যগুলিতে মুখ্যমন্ত্রী বা অন্য মন্ত্রীদের এই আইনের মাধ্যমে বিপদে ফেলা হতে পারে। বিরোধীদের দাবি, কেন্দ্র এই বিল এনে দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে আঘাত করার চেষ্টা করছে। সংবিধানের মূল চেতনা ধাক্কা খাবে। সংবিধান অনুযায়ী, কেউ দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তিনি নির্দোষ।
২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে জিতে বিজেপির নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে এনডিএ। প্রধানমন্ত্রী হন নরেন্দ্র মোদী। ২০১৯ এবং ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে জিতে ক্ষমতা ধরে রাখেন তিনি। বিরোধীদের অভিযোগ, মোদীর শাসনকালে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে নিজেদের ‘হাতের পুতুল’ করে রেখেছে কেন্দ্র। কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে কাজে লাগিয়ে বিরোধী নেতা-নেত্রীদের কখনও আটক করা হয়েছে, কখনও গ্রেফতার। তাঁদের মধ্যে অনেকেই গুরুতর অপরাধের অভিযোগে টানা ৩০ দিনের বেশি হেফাজতে কাটিয়েছেন। কেউ কেউ আবার এখনও জেলবন্দি। গত ১১ বছরে কমপক্ষে ১৩টি এমন ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে, যেখানে যেখানে মন্ত্রীরা গ্রেফতার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগকেই গ্রেফতার করেছে ইডি এবং সিবিআই। উল্লেখ্য, অন্তত ১০ জন তৎকালীন মন্ত্রী গ্রেফতার হয়েছেন আর্থিক তছরুপ মামলায়।
যে ১৩ জনের নাম নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে, তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই আপ এবং তৃণমূলের মন্ত্রী! এক জন বিজেপির মন্ত্রীও রয়েছেন। অবৈধ অস্ত্র রাখার অভিযোগ উঠেছিল ওই মন্ত্রী রাকেশ সচানের বিরুদ্ধে। তবে ২০১৪ সাল থেকে তিনি উত্তরপ্রদেশে মন্ত্রিত্ব সামলাচ্ছেন। বর্তমানে সে রাজ্যের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মন্ত্রী তিনি। ২০২২ সালে অস্ত্র আইনের অধীনে রাকেশকে দোষী সাব্যস্ত করে এক বছরের সাজা শোনায় আদালত। তবে আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলেও গ্রেফতার হননি তিনি। জামিনে মুক্ত। তাঁকে বাদ দিয়ে বাকি ১২ জনই বিজেপিবিরোধী দলের সদস্য। মন্ত্রী থাকাকালীন গ্রেফতার করা হয় তাঁদের।
জয়রাম জয়ললিতা এআইএডিএমকে
তামিলনাড়ুর ছ’বারের মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তির মামলায় বেঙ্গালুরুর বিশেষ আদালতে দোষী সাব্যস্ত হন তিনি। দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরই বেঙ্গালুরুতে কারাবন্দি করা হয় জয়ললিতাকে। ইস্তফা দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে। অবশ্য কর্নাটক হাই কোর্টের রায়ে ‘বেকসুর খালাস’ হয়ে জেল থেকে বেরিয়ে ২০১৫-য় আবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন ‘আম্মা’। দীর্ঘ অসুস্থতার জেরে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে মৃত্যু হয় জয়ললিতার।
অরবিন্দ কেজরীওয়াল, আপ
২০২৪ সালের ২১ মার্চ দিল্লির আবগারি মামলায় ইডির হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন অরবিন্দ কেজরীওয়াল। কিন্তু গ্রেফতারির পরেও মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেননি তিনি। কেজরীই দেশের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী, যিনি গ্রেফতার হওয়ার পরেও মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। সেপ্টেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর আপ প্রধান ঘোষণা করেন, তিনি মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দেবেন। জানান, পুনরায় ভোটে না জেতা পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রীর পদে ফিরবেন না। তিনি ইস্তফা দেওয়ার পরে অতিশী মার্লেনাকে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়। তবে ২০২৫ সালে দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে ভরাডুবি হয় আপের। হেরে যান কেজরীওয়ালও।
জিতেন্দ্র তোমার, আপ
দিল্লির আইনমন্ত্রী থাকাকালীন ২০১৫ সালের জুন মাসে আম আদমি পার্টির (আপ) নেতা জিতেন্দ্র তোমারকে গ্রেফতার করে দিল্লি পুলিশ। আইনের ভুয়ো ডিগ্রি মামলায় নাম জড়িয়েছিল তাঁর। গ্রেফতারের পর পরই আইনমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন জিতেন্দ্র। দেড় মাস জেলে কাটানোর পর জামিনে ছাড়া পান তিনি।
সত্যেন্দ্র জৈন, আপ
আর্থিক তছরুপের অভিযোগে দিল্লির আম আদমি পার্টির নেতা সত্যেন্দ্র জৈনকে ২০২২ সালের মে মাসে গ্রেফতার করেছিল ইডি। সে সময় তিনি দিল্লির স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদে ছিলেন। গ্রেফতারির ন’মাস পরে ওই পদ থেকে তিনি ইস্তফা দেন। ১৮ মাস জেলে কাটানোর পর জামিনে মুক্তি পান সত্যেন্দ্র।
মণীশ সিসৌদিয়া, আপ
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গ্রেফতার হয়েছিলেন দিল্লির তৎকালীন উপমুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিসৌদিয়া। আর্থিক তছরুপ এবং দিল্লির আবগারি মামলায় নাম জড়ায় তাঁর। ১৭ মাস জেলে কাটিয়েছেন তিনি। বর্তমানে জামিনে মুক্ত। গ্রেফতারির এক সপ্তাহ পরেই উপমুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন মণীশ।
আরও পড়ুন:
ভি সেন্থিল বালাজি, ডিএমকে
নিয়োগে দুর্নীতি ও আর্থিক নয়ছয়ের অভিযোগে মন্ত্রী সেন্থিলের বাড়িতে হানা দিয়েছিল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। প্রায় ১৮ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পরে ২০২৩ সালের ১৪ জুন তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৫ মাস জেলে কাটানোর পর জামিনে ছাড়া পান তামিলনাড়ুর প্রাক্তন বিদ্যুৎমন্ত্রী।
নবাব মালিক, এনসিপি
বেআইনি আর্থিক লেনদেনে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা এনসিপি নেতা নবাব মালিককে গ্রেফতার করেছিল ইডি। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাটির তরফে জানানো হয় ওই মামলার অন্যতম অভিযুক্ত, দাউদ ইব্রাহিমের ভাই ইকবাল কাসকর এবং বোন হাসিনা পারকরের নাম। তাঁদের সঙ্গে যোগের অভিযোগ ছিল নবাবের বিরুদ্ধে। ১৮ মাস জেলে কাটান তিনি। পরে সুপ্রিম কোর্ট তাঁর জামিনের আবেদন মঞ্জুর করে।
মদন মিত্র, তৃণমূল
সারদা মামলায় ২০১৪ সালে গ্রেফতার করা হয় পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন পরিবহণ মন্ত্রী তথা তৃণমূল নেতা মদন মিত্রকে। ২০ মাস জেলে কাটান তিনি। জেলে থাকলেও মন্ত্রিত্ব ছাড়েননি কামারহাটির তৃণমূল বিধায়ক। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে জামিনে ছাড়া পান তিনি। ২০২১ সালে নারদ মামলাতেও গ্রেফতার হয়েছিলেন মদন। তবে তখন তিনি রাজ্যের কোনও মন্ত্রিত্ব সামলাচ্ছিলেন না।
ফিরহাদ হাকিম, তৃণমূল
নারদকাণ্ডে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন তৃণমূল নেতা তথা পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। ১২ দিন জেলে কাটানোর পর আদালত তাঁর জামিন মঞ্জুর করে। তবে গ্রেফতারির পরেও মন্ত্রিত্ব ছাড়েননি ফিরহাদ।
আরও পড়ুন:
সুব্রত মুখোপাধ্যায়, তৃণমূল
নারদকাণ্ডে নাম জড়িয়েছিল প্রয়াত তৃণমূল নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায়েরও। ২০২১ সালে মে মাসে ফিরহাদদের সঙ্গেই গ্রেফতার হয়েছিলেন তিনি। গ্রেফতারির সময় তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত মন্ত্রী। তিনিও ১২ দিন জেলে কাটানোর পর জামিনে মুক্তি পান। গ্রেফতারির পর সুব্রতও মন্ত্রিত্ব ছাড়েননি।
জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, তৃণমূল
পশ্চিমবঙ্গের বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ওরফে বালুকে ২০২৩ সালের ২৭ অক্টোবরে রেশন দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার করেছিল ইডি। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে তিনি খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন। ১৪ মাস পরে জামিনে মুক্তি পান তিনি। তবে তার আগে ২০২৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতারির সাড়ে তিন মাস পরে তাঁকে মন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
পার্থ চট্টোপাধ্যায়, তৃণমূল
নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ২০২২ সালের ২৩ জুলাই পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করেছিল ইডি। পরে সিবিআইও তাঁকে গ্রেফতার করে। সেই বছরের ২৮ জুলাই তাঁকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরানো হয়েছিল। গ্রেফতারির সময় পার্থ ছিলেন শিল্পমন্ত্রীর পদে। এখনও তিনি জেলবন্দি। তাঁর ঠিকানা প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগার।
এ ছাড়াও, ২০২৪ সালের ৩১ জানুয়ারি ঝাড়খণ্ডে জমি দুর্নীতি সংক্রান্ত বেআইনি আর্থিক লেনদেনের মামলায় গ্রেফতার হয়েছিলেন ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা (জেএমএম) নেতা তথা মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন। গ্রেফতারির আগে ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন তিনি। ২০২৪ সালের ২৮ জুন ঝাড়খণ্ড হাই কোর্ট হেমন্তের জামিন মঞ্জুর করে। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে আবার ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হন তিনি। পরে বিধানসভা নির্বাচনে জিতে ক্ষমতা ধরে রাখেন হেমন্ত।