E-Paper

‘স্থায়ী স্থানান্তরিত’-র তথ্য দিল কে, উত্তর নেই

দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার বলেছেন, মৃত বা স্থায়ী ভাবে স্থানান্তরিতদের নাম ভোটার তালিকায় থেকে যাবে, কমিশন কী ভাবে সেটা মেনে নিতে পারে? যাঁরা প্রতিবাদ করছেন, তাঁদের ভেবে দেখা উচিত।

সন্দীপন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২৫ ০৫:৪৯

—প্রতীকী চিত্র।

কোভিড-কালের সেই ছবিটা নিশ্চয়ই অনেকে ভুলতে পারেননি। জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তার মধ্যে কাঁধে ব্যাগ চাপিয়ে রেললাইন ধরে বাড়ির পথ ধরেছেন শ্রমিকেরা। তারপরে সেই দৃশ্য। শ্রমিকের নিষ্প্রাণ হাতের পাশে লাইনে ছড়িয়ে আছে শুকনো রুটি!

সেই পরিযায়ী শ্রমিকের দলে বড় সংখ্যায় নাম ছিল বিহারের মানুষের। কায়িক শ্রমে পটু, দোকান, ছোট ব্যবসা থেকে শুরু করে গাড়ি চালানোর মতো নানা কাজে জানকবুল লড়াই দিতে সিদ্ধহস্ত বিহারি ছড়িয়ে আছেন কলকাতা-সহ দেশের নানা প্রান্তে। এই চলতি সপ্তাহেই কেরলের এর্নাকুলাম থেকে বিহার যাতায়াতের সুবিধার্থে আরও একটা নতুন ট্রেন নামিয়েছে রেল। আর এর মধ্যেই ৩৫ লক্ষ ‘স্থানান্তরিত’ ভোটারের নাম বাইরে রেখে শেষ হয়েছে নির্বাচন কমিশনের বিশেষ নিবিড় সংশোধনের (এসআইআর) প্রথম দফা। যার মধ্যে অবধারিত ভাবেই থেকে গেলেন বহুসংখ্যক শ্রমিক। বিহারির থেকে যাঁদের এখন ‘বাহারি’ (বাইরের) পরিচয়ই বেশি!

দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার বলেছেন, মৃত বা স্থায়ী ভাবে স্থানান্তরিতদের নাম ভোটার তালিকায় থেকে যাবে, কমিশন কী ভাবে সেটা মেনে নিতে পারে? যাঁরা প্রতিবাদ করছেন, তাঁদের ভেবে দেখা উচিত। এই প্রশ্নের যৌক্তিকতাকে কোনও ভাবে অস্বীকার না-করেই বিহারের নানা মহলে আরও কিছু প্রশ্ন আছে। যেমন, পাকাপাকি ভাবে চলে গিয়েছেন অথবা যোগাযোগ করা যায়নি, এই দুই ধরনের ভোটারকে এক করে দেখিয়েছে কমিশন। তা হলে কি যোগাযোগ করতে না-পারার কারণেই অনেককে স্থায়ী স্থানান্তরিত বলে ধরা হচ্ছে? দ্বিতীয়ত, পাকাপাকি ভাবে চলে যাওয়ার এই তথ্য কি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা তাঁর পরিবার গণনাপত্রে ঘোষণা করেছেন? যদি নিজেরাই এখন জানিয়ে থাকেন, তা হলে বছর বছর ভোটার তালিকা সংশোধনের সময়ে সেটা জানা গেল না কেন? নইলে তো একলপ্তে এত বড় সংখ্যা হয় না? না কি এখন অন্য কেউ তথ্য দিয়েছে? স্থায়ী ভাবে স্থানান্তরিতদের মধ্যে কত জনের অন্যত্র ভোটার তালিকায় নাম উঠেছে?

এবং আরও প্রশ্ন, বিহার থেকে ভিন্ রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া মানুষের সংখ্যাটা কত? বাংলায় যেমন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, তাঁর রাজ্য থেকে ২২ লক্ষ শ্রমিক বাইরে কর্মরত। সংখ্যা তর্কসাপেক্ষ হতে পারে, কিন্তু সরকারি ভাবে একটা পরিসংখ্যান আছে। বাংলায় প্রধান বিরোধী দল বিজেপির বক্তব্য, রাজ্য সরকার কর্মসংস্থান দিতে পারেনি বলেই বিপুল সংখ্যক মানুষকে বাইরে রুটি-রুজির জন্য যেতে হচ্ছে। বিহারে যেখানে ‘ডাবল ইঞ্জিন’ (বিজেপির শরিক জেডিইউ-কে ধরলে ‘ট্রিপল’) সরকার, সে রাজ্য থেকে কত মানুষ বাইরে কাজে যান? কেন যান? রাজ্য সরকার এবং শাসক দল বিজেপির কাছে এই নিয়ে কোনও সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না। রাজ্যের উপ-মুখ্যমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা সম্রাট চৌধরির বক্তব্য, ‘‘কমিশন বলেছে ৩৫ লক্ষ পাকাপাকি ভাবে চলে গিয়েছে। কমিশন যা জানাচ্ছে, সেটাই সংখ্যা।’’ পাশাপাশি, গয়ার জেলাশাসক শশাঙ্ক শুভঙ্কর জানাচ্ছেন, বাইরে কেউ কাজে গেলে প্রশাসনকে তথ্য দিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়।

বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতা ব্রিজেশ পাণ্ডের পাল্টা খোঁচা, ‘‘সরকারের কাছে কোনও হিসাবই নেই তো বলবে কী! বিহার, উত্তরপ্রদেশ এখন ‘লেবার হাব’-এ পরিণত হয়েছে। এখানে মাঠে চাষবাসের কাজ করার লোক নেই, একটু উন্নত জীবনের আশায় দলে দলে লোক অন্য রাজ্যে যাচ্ছে। এই এসআইআর-এ তারাই সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। আর বেরোজগারি, সুশাসনের করুণ হাল থেকে নজর ঘোরানোর জন্য বিজেপি এসআইআর-কে সামনে রেখে লোককে নাগরিকত্বের পরিচয় খুঁজতে ব্যস্ত রাখছে।’’ সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কুমার পারভেজের মতে, ‘‘পরিযায়ীরা যেখানে কাজ করতে যাচ্ছেন, সেখানে তাঁদের অধিকাংশের কাছেই কোনও কাগজ নেই। কখনও মহারাষ্ট্র, কখনও দিল্লিতে হয়রানির মুখে পড়তে হচ্ছে। আর বিহারে নিজের রাজ্যে বলা হচ্ছে, ওঁরা বাইরে থাকেন, তাই ভোটার নন!’’

দিল্লি, মুম্বই, কলকাতা-সহ নানা শহরে বিহারের অনেকেই যে পাকাপাকি ভাবে থাকছেন, রাজনৈতিক দল হোক বা শিক্ষা জগৎ, নাগরিক সমাজ— কেউই অস্বীকার করছে না। কিন্তু তাদের অভিজ্ঞতা বলছে, খেটে খাওয়া বিপুল অংশের শ্রমজীবী মানুষ ছট-ইদ-দিওয়ালিতে বাড়ি ফেরেন। ভোটের সময়েও বুথে লাইনে দাঁড়ান। আবার বিহারের মধ্যেই গয়ার লোক পটনায়, কাটিহারের লোক রাজগীরে বা কিসানগঞ্জের লোক দানাপুরে কাজের জন্য থাকেন। এঁদের সকলকে কি এসআইআর ন্যায্য সুযোগ দিল? অগস্টে খসড়া তালিকার উপরে আবেদন শুরু হলে কী দৃশ্য দেখা যায়, নজর থাকবে অনেকেরই।

আপাতত শাঁখের করাতের মুখে পড়া পরিযায়ীদের জন্য বিহারে সেই লব্জটাই ঘুরছে। না ঘর কা, নাঘাট কা…!

(চলবে)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bihar Assembly Election 2025 Bihar Voter Card Election Commission of India Migrant Workers

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy