কী ভাবে ২৬/১১ মুম্বই হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, কী ভাবে লক্ষ্যস্থল বাছাই করা হয়েছিল, জেরায় তদন্তকারীদের এই নিয়ে নানা তথ্য দিয়েছেন জেলবন্দি তাহাউর রানা। এমনটাই জানিয়েছে মুম্বই পুলিশের অপরাধদমন শাখার একটি সূত্র। ওই হামলায় ১৭০ জনের প্রাণ গিয়েছিল। পুলিশ সূত্রে খবর, কী ভাবে হামলার অন্যতম চক্রী ডেভিড কোলম্যান হেডলিকে সাহায্য করেছিলেন, তা-ও জেরায় জানিয়েছেন রানা। কী ভাবে ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাস-সহ জনবহুল জায়গাগুলি হামলার জন্য চিহ্নিত করেছিলেন, তা-ও তিনি তদন্তকারীদের জানিয়েছেন বলে খবর। তদন্তকারীদের সূত্রেই জানা গিয়েছে, পাক সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত থাকার সময়ে তাদের রোষেও পড়েছিলেন তিনি। সেই ‘কলঙ্ক’ মুছতে হাত ধরেছিলেন হেডলির।
আমেরিকার জেলে বন্দি ছিলেন রানা। গত এপ্রিলে তাঁকে ভারতে নিয়ে আসা হয়েছে। প্রথমে কিছু দিন রানা এনআইএ হেফাজতে ছিলেন। তার পর তাঁকে তিহাড় জেলে স্থানান্তরিত করা হয়েছে।
পাক সেনা যোগ
রানা আদতে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক। তাঁকে জেরা করে জানা গিয়েছে, ১৯৮৬ সালে রাওয়ালপিন্ডির সেনা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেন তিনি। কোয়েটায় পাকিস্তানি সেনার চিকিৎসক হিসাবে নিযুক্ত হন। পাকিস্তানের সিন্ধ, বালোচিস্তান, বহওয়ালপুর, সিয়াচেন-বালোত্রার মতো সংবেদনশীল এলাকায় সেনার চিকিৎসক হিসাবে কাজ করেছিলেন তিনি। সিয়াচেনে থাকার সময়ে পালমোনারি এডেমা হয় তাঁর। এই রোগে ফুসফুসে জল জমে। এর ফলে দীর্ঘ দিন কাজে অনুপস্থিত ছিলেন। সে কারণে তাঁকে ‘পলাতক’ ঘোষণা করা হয় সেনার তরফে। এর আগে জেরায় রানা দাবি করেছিলেন, অতীতে হেডলি তাঁর রেকর্ড থেকে ‘কলঙ্ক’ দূর করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। সে কারণেই তিনি তাঁকে সন্ত্রাস হামলায় সাহায্য করতে রাজি হন। রানার আরও দাবি, উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়ে গোপন অভিযানে তাঁকে সৌদি আরবে পাঠিয়েছিল পাকিস্তানি সেনা। তাঁকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্বাসও করত তারা। কানাডায় থিতু হওয়ার আগে জার্মানি, ব্রিটেন, আমেরিকায় ছিলেন তিনি। অবশেষে কানাডায় মাংস প্রক্রিয়াকরণ, রিয়্যাল এস্টেটের ব্যবসা শুরু করেছিলেন।
হেডলি যোগ
১৯৭৪ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত একই কলেজে পড়াশোনা করতেন হেডলি এবং রানা। পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের ক্যাডেট কলেজে পড়তেন তাঁরা। হেডলির মা ছিলেন আমেরিকান। বাবা পাকিস্তানি। সৎমায়ের সঙ্গে অশান্তির পরে হেডলি আমেরিকায় গিয়ে জন্মদাত্রী মায়ের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। রানার দাবি, ২০০৩ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে জঙ্গি সংগঠন লশকর-এ-ত্যায়বার প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দিয়েছিলেন হেডলি। তিনি রানাকে জানিয়েছিলেন, লশকর আসলে গুপ্তচর সংস্থা।
হামলায় ভূমিকা
এনআইএ-র চার্জশিট বলছে, ভারতের বিভিন্ন শহরে ঘুরেছিলেন রানা। অভিবাসী আইন কেন্দ্রের প্রতিনিধি সেজে দিল্লি, মুম্বই, জয়পুর, পুষ্কর, গোয়া, পুনেতে ঘুরেছিলেন তিনি। মুম্বই অপরাধদমন শাখার কাছে জেরায় তিনি দাবি করেন, ‘ভুয়ো’ সংস্থা খোলেন তিনি তাঁর। সংস্থা চালাতেন এক মহিলা। আর সেই সংস্থার আড়ালেই সন্ত্রাসের ছক কষেন রানা। জেরায় রানার আরও দাবি, ২০০৮ সালের নভেম্বরেই তিনি মুম্বই এসেছিলেন। ২০ এবং ২১ নভেম্বর পওয়াইয়ের একটি হোটেলে ওঠেন। ২৬ তারিখ হামলার ঠিক আগে দুবাই হয়ে বেজিং চলে গিয়েছিলেন। মুম্বইয়ের অপরাধ দমন শাখা ২০২৩ সালে যে চার্জশিট পেশ করে, তাতে জানানো হয়, এ দেশে জনবহুল জায়গা চিহ্নিত করতে হেডলিকে সাহায্য করেছিলেন রানা। ১৪ জন সাক্ষী তাঁর ভূমিকা নিশ্চিত করেছেন। কী ভাবে ভুয়ো নথি নিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিল জঙ্গিরা? রানার এ ক্ষেত্রে দায় ঠেলেছেন ভারতীয় দূতাবাসের দিকে। জাল নথি নিয়ে হেডলিকেও রানা ভারতে প্রবেশ করতে সাহায্য করেছিলেন বলে জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা। হামলার অন্যতম চক্রী সাজিদ মীর, আবদুল রহমান পাশা, মেজর ইকবালের সঙ্গে রানার যোগাযোগ ছিল বলে জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা। লশকর, পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের সঙ্গেও তাঁর যোগ রয়েছে বলে খবর।