শীর্ষ স্থানে থাকা দল পেয়েছে ২০% ভোট। তৃতীয় স্থানে থাকা দলের দখলে ২৩% ভোট। কিন্তু আসনের নিরিখে প্রথম দল বিজেপি যেখানে ৮৯, তৃতীয় আরজেডি সেখানে মাত্র ২৫! বিহারের বিধানসভা ভোটে পাটিগণিতের এই ধাঁধার আড়ালে রয়ে যাচ্ছে নীতীশ কুমার-অমিত শাহদের সাফল্যের অন্য গল্প।
বিহারের ভোটের পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে, তেজস্বী যাদবদের মহাগঠবন্ধনের ভোট পাঁচ বছর আগের তুলনায় কমেনি। গত বারের ৩৭.২৩% থেকে এ বার ৩৭.৯% হয়েছে। বিজেপি-জেডিইউ’এর এনডিএ সেখানে ৩৭.২৬% থেকে বেড়ে ৪৬.৬% হয়েছে। অর্থাৎ গত বার যেখানে এনডিএ এবং মহাজোট ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে গায়ে গায়ে ছিল, এ বার সেখানে প্রায় ১০ শতাংশ বিন্দুর ফারাক হয়েছে। শাসক জোটে এই বাড়তি ভোটের অর্ধেক এসেছে জেডিইউ (১৯.২৫%) এবং বিজেপির (২০.০৮%) দিক থেকে। আর বাকিটা চিরাগ পাসোয়ানের রাষ্ট্রীয় লোক জনশক্তি পার্টি (রামবিলাস) এবং উপেন্দ্র কুশওয়াহার রাষ্ট্রীয় লোক মোর্চার অবদান। বস্তুত, ভোটের শতাংশ বিন্দুতে নীতীশদের এগিয়ে দেওয়া এবং কম ভোট পেয়েও বেশি আসন জিততে এনডিএ-কে সাহায্য করে খেলা ঘুরিয়ে দিয়েছেন চিরাগই!
পাঁচ বছর আগের বিধানসভা ভোটে এনডিএ-র হয়ে লড়েনি চিরাগের দল। এ বারও তাদের দাবি সামলাতে প্রথমে বেগ পেতে হয়েছিল বিজেপি ও জেডিইউ নেতৃত্বকে। পরে শাহের হস্তক্ষেপে চিরাগ, জিতন রাম মাঞ্ঝিরা এনডিএ-র রফা-সূত্র মেনে নেন। চিরাগের দল গত বারের মতোই এ বারও পাঁচ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পেয়েছে। কিন্তু সেই ভোট যোগ হয়েছে এনডিএ-র খাতায়। যা তাদের শতাংশ বিন্দুতে এগিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি বাড়তি আসনও এনে দিয়েছে। এনডিএ-র শরিক হয়ে গত বার লড়াই করে দেড় শতাংশের কাছাকাছি ভোট পেয়েছিল মুকেশ সহনির বিকাশশীল ইনসান পার্টি (ভিআইপি)। এ বার তারা মহাজোটে ছিল কিন্তু তাদের বেরিয়ে যাওয়ার ‘ক্ষতি’ পুষিয়ে দিয়েছে কুশওয়াহার লোক মোর্চা। আর একক দল হিসেবে দেখতে গেলে, নীতীশের জেডিইউ-ই নিজেদের ভোট শতাংশ বাড়ানোর ক্ষেত্রে সব চেয়ে এগিয়ে। কিন্তু আসন জয়ে তারা (৮৫) আবার বিজেপির (৮৯) চেয়ে পিছিয়ে!
এর পরের প্রশ্ন, কম ভোট পেয়েও বিজেপি এত বেশি আসন জিতল কী ভাবে? আবার তুলনায় বেশি ভোট পেয়েও আরজেডি আসনে এত পিছিয়ে পড়ল কী ভাবে? এই রহস্যের উত্তর আছে বিহারের রাজনীতির এ বারের রসায়নে এবং সেখানেই মুখ্য চরিত্র চিরাগ! তার আগে মনে রাখতে হবে, আরজেডি লড়েছে ১৪৩টি বিধানসভা আসনে। সেখানে বিজেপি এবং জেডিইউ লড়েছে ১০১টি করে আসনে। তার ফলে দু’পক্ষের শতাংশ হিসেবের ভিত্তি-সংখ্যা আলাদা। এর পরে রয়েছে চিরাগের ‘খেলা’। পাঁচ বছর আগে মহাজোট যত আসনে জিতেছিল, তার মধ্যে ৬৫টি কেন্দ্রে তৃতীয় স্থানে থাকা দলের ভোটের পরিমাণ সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের জয়ের ব্যবধানের চেয়ে বেশি ছিল। অর্থাৎ ভোট কাটাকুটির ফায়দা পেয়েছিল আরজেডি-সহ মহাজোট। ওই ৬৫ আসনের মধ্যে ৩২টিতেই চিরাগের এলজেপি এবং ১০টিতে কুশওয়াহার লোক মোর্চা ভোট কেটে বিরোধীদের জয়ে সাহায্য করেছিল। তাতে বেশি ক্ষতি হয়েছিল জেডিইউ-এর। তারা আবার ৯টি আসনে চিরাগদের ভোট কেটে দিয়ে মহাজোটকে জিততে সহায়তা করেছিল! এ বার সেই ‘খেলা’ই ঘুরে গিয়েছে। চিরাগের দল মসৃণ ভাবে এনডিএ-র হয়ে কাজ করেছে। বিহারে এ বার ২৩টি আসনে তৃতীয় পক্ষের প্রাপ্ত ভোট সেই কেন্দ্রের জয়ের ব্যবধানের চেয়ে বেশি হয়েছে কিন্তু তার বেশির ভাগই গিয়েছে এনডিএ-র দখলে।
তারই পাশাপাশি, এনডিএ-র জেতা ২০২টি আসনের মধ্যে ৬৮টিতে শাসক প্রার্থীরা জিতেছেন ৫০%-এর বেশি ভোট পেয়ে। কাটাকুটির অঙ্ক সেখানে কার্যকরই হয়নি। আরও একটি ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের মধ্যে ছবিটা সম্পূর্ণ উল্টে গিয়েছে। গত বার নীতীশ ও লালুপ্রসাদের দলের মধ্যে ৬১টি আসনে সরাসরি লড়াই ছিল, তার ৪০টি জিতেছিল আরজেডি। এ বার সেই রকম ৫৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ৫০টিই জেডিইউ জিতেছে। নীতীশকে সাহায্য করেছেন চিরাগ।
এনডিএ-র ‘ঐতিহাসিক জয়ে’র পরে শনিবার নীতীশের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন চিরাগ। রামবিলাস-পুত্র বলেছেন, ‘‘এ বারও প্রচার ছিল জেডিইউ এবং এলজেপি-র মধ্যে বিরোধের। কিন্তু আমাদের দল সতর্ক ছিল। পাঁচ বছর আগের ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা নিয়েছি।’’ ভোটে বিপর্যয়ের পরে আরজেডি-র তরফে বলা হয়েছে, ‘জনসেবা একটা নিরন্তর প্রক্রিয়া। এই যাত্রায় ওঠা-পড়া থাকেই। পরাজয়ে গ্লানি নেই, জয়েও অহঙ্কার নেই। গরিব মানুষের দল হিসেবে আরজেডি গরিবদের কথাই বলে চলবে’।
ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনের (এসআইআর) সময়ে সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া সত্ত্বেও সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের আসন এ বার দুইয়ে নেমে এসেছে, চারটি আসন তারা অল্প ভোটে হেরেছে। দলের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য আত্মসমীক্ষার এবং আন্দোলনের পথে থাকার কথা বলেছেন। আবার প্রশান্ত কিশোরের দলের জাতীয় সভাপতি উদয় সিংহের মতে, ‘‘শেষের দিকে লোকের মনে হয়েছে, জন সুরাজকে ভোট দিলে আরজেডি সরকারে এসে যেতে পারে। জঙ্গলরাজ ফিরে আসার ভয়ে ওই ভোট এনডিএ-র দিকে ঘুরে গিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)