সন্ত্রাসবাদী হামলার জবাবে সামরিক জবাব। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদী সরকার নতুন রণনীতি বা ‘ডকট্রিন’ প্রতিষ্ঠা করে ফেলল।
২০১৬ সালে উরির বায়ুসেনা ঘাঁটিতে জঙ্গি হামলার জবাবে ভারতের সেনা ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালিয়েছে। ২০১৯-এ পুলওয়ামায় সিআরপিএফ কনভয়ে হামলার জবাবে বায়ুসেনা পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের বালাকোটে অভিযান হয়েছে। মঙ্গলবার মধ্যরাতে বায়ুসেনার একসঙ্গে ন’টি সন্ত্রাসবাদী শিবিরে হামলা আগের দুই প্রত্যাঘাত থেকে একেবারেই আলাদা বলে মনে করছেন সামরিক বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের বক্তব্য, এ বার ‘অপারেশ সিঁদুর’-এ শুধু যেখান থেকে পহেলগামের হামলা হয়েছিল, সেখানে ছোট মাপের প্রত্যাঘাত হয়নি। তার সঙ্গে এর আগে বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী হামলার সঙ্গে যুক্ত ঘাঁটিকে নিশানা করা হয়েছে। তা করতে গিয়ে ভারতের প্রত্যাঘাত শুধু পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে সীমাবদ্ধ থাকেনি। পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ডে ঢুকে পড়েছে। ন’টি নিশানার মধ্যে চারটিই পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ডে। ফলে ভারত নিজের নীতি স্পষ্ট করে দিয়েছে। এখন থেকে জঙ্গি হামলার জবাব দেওয়া হবে বড় মাপের সামরিক প্রত্যাঘাতেই। তার ফলাফল নিয়ে ভারত পরোয়া করবে না।
‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ ও ‘বালাকোট অভিযান’-এর পরে বিরোধীরা প্রমাণ চেয়েছিল। ঘটনার পরে কিছু ভিডিয়ো এবং ছবি ছাড়া বিশেষ কোনও প্রমাণ সে বার সরকারের তরফে দেখানো হয়নি। গত কাল মধ্যরাতের ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর একেবারে সঙ্গে সঙ্গেই সেনার তরফে ন’টি প্রত্যাঘাতের ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত ফৌজি অফিসারদের মতে, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর ফলাফল সরকার বা সামরিক বাহিনী আমজনতার কোনও সংশয়ের অবকাশ রাখতে চায়নি।
অতীতে ২৬/১১-র মুম্বই হামলার পরে নয়াদিল্লি আন্তর্জাতিক মহলের কাছে তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরে প্রমাণের চেষ্টা করেছে, পাকিস্তান কী ভাবে ওই নাশকতার সঙ্গে যুক্ত। পাক প্রশাসনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয়, এমন ‘নন-স্টেট অ্যাকটর’-দের সঙ্গে সেনা বা ‘স্টেট-অ্যাকটর’-দের জড়িত থাকার তথ্যপ্রমাণ বা ‘ডসিয়ার’ তৈরি করে ভারত আন্তর্জাতিক মহলের সামনে পেশ করেছে। কূটনীতিকরা বলছেন, এ বার ভারত সেই রাস্তাতেই হাঁটেনি। পহেলগামের হামলার কার্যত পরের দিন থেকেই মোদী সরকার পাকিস্তানের উপরে চাপ তৈরির কৌশল নিয়েছে। একইসঙ্গে, সামরিক প্রত্যাঘাতের পরিকল্পনাও শুরু হয়ে গিয়েছিল।
সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল কে জে এস ধিল্লোঁ বলেন, ‘‘এটা যুদ্ধের পদক্ষেপ নয়। শুধু সন্ত্রাসবাদী হামলার সামরিক জবাব। বল এখন পাকিস্তানের কোর্টে। এ বার পাকিস্তান যদি কিছু করে, তা হলেই ভারতের যুদ্ধে যাওয়ার অধিকার রয়েছে।’’ বায়ুসেনার এক অবসরপ্রাপ্ত অফিসারের কথায়, ‘‘এটুকু ধরে নেওয়া যায়, সামরিক বাহিনী যখন নিখুঁত পরিকল্পনা করে একসঙ্গে পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ড ও পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে হামলা চালিয়েছে, তখন পাকিস্তান পাল্টা জবাব দিলে তার মোকাবিলা কী ভাবে করা হবে, তার নীল নকশাও তৈরি রয়েছে। যে কোনও সামরিক আঘাতের ক্ষেত্রে পাল্টা প্রত্যাঘাত কী হতে পারে, তার জবাব কী হবে, সেই অঙ্ক কষে নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রেও নিশ্চিত ভাবে তা করা রয়েছে।’’
প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, পহেলগামের ঘটনার পর থেকেই পাকিস্তান সংঘর্ষবিরতির চুক্তি ভেঙে নিয়ন্ত্রণরেখায় গোলাগুলি চালাচ্ছে। গত কাল রাতের পর থেকে তা আরও বেড়েছে। সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী নিয়ন্ত্রণরেখায় মোতায়েন সেনাকর্তাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখছেন। পাকিস্তান কামান থেকে গোলা দাগলে, নিরীহ নাগরিকদের নিশানা করলে তার যথোচিত জবাব দেওয়ার স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণরেখায় মোতায়েন বাহিনীকে দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তান নিরীহ মানুষকে নিশানা করতে শুরু করেছে। তার জবাবও দেওয়া হচ্ছে।
কূটনৈতিক ও সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলওয়ামার পরে ভারতে সন্ত্রাসবাদী হামলা হলেও সরাসরি পাকিস্তানের দিক থেকে সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়নি। বালাকোটে অভিযানের পরে পাকিস্তান অনেকদিন হাত গুটিয়ে ছিল। যদিও কাশ্মীরে সন্ত্রাসে পাকিস্তান মদত দিয়েছে। এ বার পহেলগামের পরে পাকিস্তানকে যে প্রত্যাঘাত করা হয়েছে, তাতে তাদের সন্ত্রাসে লাগাম পরানো সম্ভব হবে কি না, না কি পাকিস্তানের আইএসআই, সেনা আরও মরিয়া হয়ে উঠবে, সেটাই এখন দেখার।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)