Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Rabindranath Tagore

পূজার ছলে অটুট বিস্মরণের ধারা

অনেকেরই মত, বরণীয়দের প্রতি ভক্তির আধিক্য থেকে তাঁদের খেলো করার প্রবণতাও দেখা গিয়েছে।

নরেন্দ্র মোদী। ছবি পিটিআই।

নরেন্দ্র মোদী। ছবি পিটিআই।

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২০ ০৪:৩৮
Share: Save:

কখনও ‘মন কি বাত’-এ রবিচ্ছায়া। বণিকসভায় প্রধানমন্ত্রীর সম্ভাষণে গীতাঞ্জলির পংক্তি। দলের সর্বভারতীয় সভাপতির নামে টুইট-উদ্ধৃতিতে গুলিয়ে গিয়েছে বিশ্বকবির জন্মস্থানও। এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বোলপুরে আবাহনের ফ্লেক্সে অমিত শাহের ছবির নীচে ঠাঁই হয়েছে রবি ঠাকুরের। পর পর ঘটনাগুলোর পিছনে ২০২১এর ভোটের পদধ্বনি নিয়ে দ্বিমত নেই জনমানসে। কিন্তু এই পুজোর হিড়িকের পিছনে বরণীয় মনীষীদের নিয়ে অতিভক্তিতে খেলো করার প্রবণতাও সমান দায়ী। রবিবার শাহের বোলপুর সফরেও এরই ধারাবাহিকতা দেখছেন ইতিহাসবিদেরা।

“ভোট এলে এমনটা ঘটবেই ভেবে ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকি। রবীন্দ্রনাথ বা নেতাজি, বিবেকানন্দকে নিয়ে বাংলায় টানাটানি চলবে, এটা দস্তুর। কিন্তু এর পিছনে মনীষীদের অতিমানব ভেবে নেওয়ার মানসিকতাকেই রাজনীতিবিদেরা সুকৌশল ইন্ধন জোগান”, বলছিলেন ইতিহাসবিদ তথা প্রাক্তন সাংসদ সুগত বসু। এবং কোনও দলের ভূমিকাই এ ক্ষেত্রে ঠিক ত্রুটিমুক্ত নয় বলে তিনি মনে করেন। ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায়ের মতে, ‘‘গাঁধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার সময় থেকেই এই নেতাদের দিকে তাকিয়ে থাকা ছিল। পরে স্বাধীনোত্তর দেশের প্রথম ভোট থেকেই কিছু মনীষীর মুখ রাজনীতিতে ব্যবহার শুরু হয়েছে। গাঁধী কিন্তু মহাত্মা শুনতে ভালবাসতেন না। রবীন্দ্রনাথের পছন্দ ছিল না গুরুদেব সম্ভাষণ। কিন্তু মনীষীদের নিয়ে মাতামাতির অভ্যাস সব সময়ে তাঁদের প্রতি সুবিচার করেনি।’’

অনেকেরই মত, বরণীয়দের প্রতি ভক্তির আধিক্য থেকে তাঁদের খেলো করার প্রবণতাও দেখা গিয়েছে। ১৯৮২ সালের এশিয়াডে ফুটবলারদের ক্লাবের খেলা ছেড়ে জাতীয় শিবিরে যাওয়া নিয়ে টানাপড়েনেও একদা স্বাধীনতাসংগ্রামীদের প্রসঙ্গ এসে বিতর্ক দানা বেঁধেছিল। ক্ষুদিরামের আত্মত্যাগে উদ্বুব্ধ হওয়ার পাশাপাশি তাঁকে খেলো করে কথা বলাও আমাদের লব্জে মিশেছে সেই কবে থেকেই। সুভাষচন্দ্র বসুর ভ্রাতুষ্পুত্রের পুত্র সুগতবাবু বলেন, ‘‘কোনও বাড়াবাড়িই ভাল নয়। অতিভক্তিতেও আসল মানুষটার ইতিহাস থেকে আমরা সরে আসি। ভুল তথ্য মিশিয়ে কল্পকথা রচনা করি, সেটায় তাঁর অসম্মান।’’

কিন্তু মূলস্রোতের সঙ্গে টিকে থাকতে বীরপুজো বা আইকন-রাজনীতি আমাদের ভোটপর্বে অনিবার্য বলে মনে করেন প্রাক্তন আমলা জহর সরকারও। রাজ্যে বাম আমলে মনীষী-স্মরণ সরকারি অনুষ্ঠানের পরিসরে কিছুটা নিচু তারে বাঁধা ছিল। তৃণমূল সরকারের সময়ে বীরপুজোর নামে নামকরণ-রাজনীতিও অনেকের বাড়াবাড়ি ঠেকেছিল। এ ভাবেই ক্রমশ বাংলায় বিজেপি-র রবিপুজোর পটভূমি তৈরি হয়েছে।

তবে বিজেপি-র এই রাজনীতির মধ্যে অসহায়তাও দেখছেন অনেকে। রজতবাবুর মত, ‘‘গাঁধীর মতো রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও নিজেদের একটা যোগ প্রমাণে বিজেপি মরিয়া। সেটা হাস্যকর। কারণ, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবোধে ভরপুর, সঙ্ঘপরিবার বা বিজেপি-র সঙ্গে যার আকাশপাতাল ফারাক।’’ স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাসে নেতার অভাবেও এখন মোদী-শাহ শিবিরকে কথায় কথায় মনীষীদের নাম করতে হচ্ছে বলে ইতিহাসবিদদের অভিমত। আর বাংলায় নিজেদের বহিরাগত-তকমা হটাতেও রবিপুজো বা বাউল সংসর্গের নমুনা পেশ করতে হচ্ছে। এই সব কাজে অজ্ঞতাপ্রসূত নানা ভুলও প্রকট হয়ে সমালোচনার সুর শোনা যাচ্ছে। ‘‘আইকন বা মনীষীদের খেলো করা আমাদের দেশে ঘটতেই থাকে। এক বার মনীষী হলে এর থেকে নিস্তার নেই’’ , বলছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। রবীন্দ্রগানও তো কবেই বলেছে, তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rabindranath Tagore BJP Narendra odi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE