Advertisement
E-Paper

হাল্কা চালেও সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে মনে করালেন দায়িত্ব

‘নমস্তে’ দিয়ে শুরু, ‘জয় হিন্দ’-এ শেষ। যে ছকভাঙা ‘দোস্তি’ আর বৈঠকী মেজাজে দু’দিন আগে শুরু হয়েছিল তাঁর ভারত সফর, বিদায়ী বক্তৃতাতেও সেই মেজাজই ধরে রাখলেন বারাক ওবামা। কিন্তু বন্ধুত্বের মোড়কে সুকৌশলে নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় তার গুরুদায়িত্বের কথাও মনে করিয়ে দিলেন তিনি। বললেন, “ভারত তত ক্ষণই সফল, যত ক্ষণ না সে ধর্মের ভিত্তিতে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে।” ২০০২ সালের গুজরাত দাঙ্গার পরে দীর্ঘ প্রায় বারো বছর যাঁকে ভিসা দিতে অস্বীকার করেছিল আমেরিকা, সেই নরেন্দ্র মোদীর কথা সরাসরি বলেননি ওবামা।

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০১৫ ০৪:৩৪
সিরি ফোর্ট অডিটোরিয়ামে মার্কিন প্রেসিডেন্টের নমস্কার, যেখানে তিনি বক্তৃতা শুরু করেন স্বামী বিবেকানন্দকে স্মরণ করে। ছবি: এপি

সিরি ফোর্ট অডিটোরিয়ামে মার্কিন প্রেসিডেন্টের নমস্কার, যেখানে তিনি বক্তৃতা শুরু করেন স্বামী বিবেকানন্দকে স্মরণ করে। ছবি: এপি

‘নমস্তে’ দিয়ে শুরু, ‘জয় হিন্দ’-এ শেষ। যে ছকভাঙা ‘দোস্তি’ আর বৈঠকী মেজাজে দু’দিন আগে শুরু হয়েছিল তাঁর ভারত সফর, বিদায়ী বক্তৃতাতেও সেই মেজাজই ধরে রাখলেন বারাক ওবামা। কিন্তু বন্ধুত্বের মোড়কে সুকৌশলে নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় তার গুরুদায়িত্বের কথাও মনে করিয়ে দিলেন তিনি। বললেন, “ভারত তত ক্ষণই সফল, যত ক্ষণ না সে ধর্মের ভিত্তিতে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে।”

২০০২ সালের গুজরাত দাঙ্গার পরে দীর্ঘ প্রায় বারো বছর যাঁকে ভিসা দিতে অস্বীকার করেছিল আমেরিকা, সেই নরেন্দ্র মোদীর কথা সরাসরি বলেননি ওবামা। কিন্তু যে ভাবে ভারতের দীর্ঘ ধর্মীয় সহিষ্ণুতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তাতে বিজেপি সরকারের প্রতি বার্তাই দেখছেন অনেকে। বিশেষ করে বর্তমান বাতাবরণে। যখন বিজেপির পালের বাতাসকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের এজেন্ডা পূরণ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন সঙ্ঘ পরিবারের কট্টরপন্থীরা। দেশের নানা প্রান্তে তাঁদের ‘ঘর ওয়াপসি’ (ধর্মান্তরণ) কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে তীব্র বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

এমনটা নয় যে, রীতিমতো টেবিল চাপড়ে কোনও কথা বলেছেন ওবামা, অথবা ভারতের কর্তব্য দাগিয়ে দিয়েছেন। বরং আজ সকালে রাজধানীর সিরি ফোর্ট অডিটোরিয়ামের শ্রোতাদের সামনে মোটের ওপর হাল্কা মেজাজেই ছিলেন তিনি। গত বারের মতো এ বারের সফরে বাচ্চাদের সঙ্গে নাচা হল না বলে আফসোস করে ভাঙা হিন্দিতে আউড়েছেন শাহরুখ খানের ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে’-র বিখ্যাত সংলাপ ‘সেনোরিটা, বড়ে বড়ে দেশোঁ মে...।’

কিন্তু অনেকেরই মতে, বক্তৃতার আসল জায়গাটা হল, শেষ দশ-পনেরো মিনিট। যেখানে ওবামা ব্যাখ্যা করেছেন, ভারত ও আমেরিকা যৌথ ভাবে কী কী দায়িত্ব পালন করতে পারে। যেখানে প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেছেন, “দু’দেশেই নানা জাতি-নানা ধর্মের মানুষ বাস করেন। এই বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যই সবচেয়ে বড় শক্তি।” এবং তাতেই না-থেমে পাশাপাশি তুলে ধরেছেন ভারতীয় সংবিধানের ২৫ নম্বর ধারা এবং মার্কিন সংবিধানের প্রথম সংশোধনীটিকে। যে দু’য়েরই বক্তব্য এক ‘ধর্মাচরণের স্বাধীনতা’।

ঘটনা হল, উন্নয়ন আর সুশাসনের স্লোগানকে হাতিয়ার করে ক্ষমতায় আসা মোদীই এখন সঙ্ঘ পরিবারের একটা বড় অংশের কট্টর হিন্দুত্ববাদী কর্মসূচি নিয়ে বিব্রত। আগরার এক বস্তিতে ধর্মান্তরণে নাম জড়িয়েছে আরএসএসের এক শাখা সংগঠনের। তা নিয়ে উত্তাল হয়েছে সংসদের শীতকালীন অধিবেশন। সংসদ অচল থাকায় বিমা বা জমি অধিগ্রহণের মতো সংস্কারমুখী গুরুত্বপূর্ণ বিল পাশ করাতে পারেনি সরকার। হাঁটতে হয়েছে অর্ডিন্যান্সের পথে।

আরএসএসের কর্মসূচি ঘিরে বিতর্কের জেরে সরকারের মূল কাজগুলিই যে ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে, সে কথা কবুল করছেন বিজেপির অনেক নেতাই। মন্ত্রী সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতি থেকে শুরু করে সাংসদ সাক্ষী মহারাজ একের পর এক নেতার বেফাঁস মন্তব্য অস্বস্তিতে ফেলেছে সরকারকে। যার জেরে সঙ্ঘপ্রধান মোহন ভাগবতের সঙ্গে বৈঠক করতে হয়েছে খোদ নরেন্দ্র মোদীকে। বোঝাতে হয়েছে, উগ্র হিন্দুত্বের বাড়বাড়ন্তে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে তাঁর উন্নয়নের মুখ। অথচ ইউপিএ জমানার নীতিপঙ্গুত্বের পরে উন্নয়নই বিজেপি সরকারের কাছে দেশের মানুষের প্রথম প্রত্যাশা।

ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে উন্নয়ন যে ব্যাহত হয়, সে ব্যাপারে অতি সম্প্রতি সতর্ক করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জগদীশ ভগবতী। ওবামার বক্তৃতায় সেই একই সতর্কবাণী প্রচ্ছন্ন বলে মনে করা হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, ধর্মীয় বিভাজন রোখা না-গেলে উন্নয়নের গতি স্তব্ধ হতে বাধ্য, সুকৌশলে এই বার্তাই দিয়ে রাখলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

বস্তুত, ওবামার এই মন্তব্যে কিছুটা অস্বস্তিও দেখা দিয়েছে বিজেপির অন্দরে। তবে ওবামার সফরের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী পীযূষ গয়ালের বক্তব্য, “আজ ওবামা যা বলেছেন, তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর মতামতের কোনও পার্থক্য নেই। দু’জনেই এ ব্যাপারে একই মত পোষণ করেন।”

ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠতে পারা যে ভারত ও আমেরিকার ঐতিহ্য, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে আজ ওবামা বলেছেন, “আমরা এমন দেশের বাসিন্দা হতে পেরে গর্বিত, যেখানে রাঁধুনির নাতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হন, দলিতের ছেলে হন ভারতীয় সংবিধানের রূপকার, আর চা-বিক্রেতা হন প্রধানমন্ত্রী।” কথা প্রসঙ্গে নিজের জীবনের গল্প শুনিয়ে বলেছেন, সাদা চামড়া না-হওয়ায় অল্প বয়সে কী ভাবে অপমানিত হতে হয়েছে তাঁকে। বলেছেন, “আমায় চিনতেন না, এমন অনেকে আমার ধর্মবিশ্বাস নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। যেন অন্য কোনও ধর্মাবলম্বী হওয়াটা অপরাধ।” শান্তির নোবেলজয়ীর মতে, প্রত্যেক দেশেরই সরকারের দায়িত্ব এটা দেখা, যাতে প্রত্যেকটি নাগরিক স্বাধীন ভাবে নিজের ধর্মাচরণ করতে পারেন। এই সময়েই তিন বছর আগে উইসকনসিনের গুরুদ্বারের হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ তুলেছেন ওবামা। ভারতীয়-মার্কিন মিলিয়ে ছ’জন মারা গিয়েছিলেন ওই হামলায়। ওবামার মতে, ওই ঘটনা ধর্মাচরণের স্বাধীনতা নিয়ে নতুন করে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তুলেছিল দু’দেশকে। এই সময়েই শাহরুখ খান, মেরি কম, মিলখা সিংহ, কৈলাস সত্যার্থীর নাম করে তিনি বলেছেন, এঁদের প্রত্যেকের জন্যই ভারতবাসীর একই ভাবে গর্বিত হওয়া উচিত। তাঁরা কার উপাসনা করেন, তাঁদের চামড়ার রং কী, সে সব গৌণ বিষয়।

অন্তরের সম্পদই আসল সম্পদ। এই বার্তাটি দিতে গিয়েই ওবামার উদাহরণ কখনও গাঁধীজি, কখনও মার্টিন লুথার কিঙ্গ জুনিয়র আর কখনও স্বামী বিবেকানন্দ। বক্তৃতার গোড়াতেই বলেছেন স্বামী বিবেকানন্দের কথা। বলেছেন, “উনি আমার শহর শিকাগোয় গিয়েছিলেন একশো বছরেরও আগে। গিয়ে আমেরিকাবাসীকে ‘আমার প্রিয় বোন এবং ভাইয়েরা’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। আমিও আজ এখানে এসে আপনাদের বোন এবং ভাই বলে ডাকতে চাই।” বক্তৃতার শেষ পর্বেও ওবামা বলেছেন, ‘সিস্টারস অ্যান্ড ব্রাদারস অব ইন্ডিয়া।’

ওবামার মতে, বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখার কাজটা ভারত ও আমেরিকা সফল ভাবে করে দেখাতে পারলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের কাছে তা নিদর্শন হয়ে থাকবে। এর পাশাপাশি আজও ছিল সহযোগিতার নানা বার্তা। ওবামা জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদের জন্য আমেরিকা সমর্থন করবে ভারতকে। পরিকাঠামো থেকে শুরু করে স্মার্ট সিটি, বুলেট ট্রেন থেকে নিরাপত্তা প্রযুক্তি সর্বস্তরে ঢালাও সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। আর তুমুল হাততালির মধ্যে জানিয়েছেন, তিনিই প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট যিনি দু’বার ভারত সফরে এলেন। কিন্তু তিনিই এই নজিরের সর্বশেষ উদাহরণ হয়ে থাকবেন না। কেন, তার কারণটা নিজেই বলেছেন ওবামা। বলেছেন, “আমরা আপনাদের বন্ধু হিসেবে, অংশীদার হিসেবে গর্বিত।”

agni roy barack obama visit to india narendra modi siri fort auditorium
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy