Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

প্রেমের টানে পাক জেলে মুম্বইয়ের যুবক! মুক্তি পেলেন ছ’বছর পর

বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন যখন, ছিলেন ২৭। ফিরলেন ৩৩-এ। সেদিনের কামানো গাল আজ দাড়িতে ঢাকা। ওয়াঘার মাটিতে দীর্ঘ চুম্বনরত হামিদ নেহাল আনসারিকে দেখে মনে হচ্ছিল, জন্মভূমি শব্দটার যাবতীয় ওম শুষে নিচ্ছেন মাটি থেকে। তার পরই জড়িয়ে ধরলেন মাকে। এক সেনা অফিসার নীরবে এগিয়ে দিলেন জলের বোতল।

ওয়াঘা সীমান্তে মায়ের সঙ্গে হামিদ। মঙ্গলবার। পিটিআই

ওয়াঘা সীমান্তে মায়ের সঙ্গে হামিদ। মঙ্গলবার। পিটিআই

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ০২:০২
Share: Save:

বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন যখন, ছিলেন ২৭। ফিরলেন ৩৩-এ। সেদিনের কামানো গাল আজ দাড়িতে ঢাকা। ওয়াঘার মাটিতে দীর্ঘ চুম্বনরত হামিদ নেহাল আনসারিকে দেখে মনে হচ্ছিল, জন্মভূমি শব্দটার যাবতীয় ওম শুষে নিচ্ছেন মাটি থেকে। তার পরই জড়িয়ে ধরলেন মাকে। এক সেনা অফিসার নীরবে এগিয়ে দিলেন জলের বোতল।

শাহরুখ খানের ‘বীর-জারা’ ছবির সঙ্গে মু্ম্বইয়ের এই যুবকের জীবনের আশ্চর্য মিল। মনে রেখো, সীমান্তের এ পারে একজন রইল, যে তোমার জন্য প্রাণও দিতে পারে— স্টেশনে দাঁড়িয়ে বীরপ্রতাপ সিংহের বলা কথাগুলো সিনেমায় জ়ারা হায়াত খানের পৃথিবী ওলটপালট করে দিয়েছিল। পাকিস্তানে ফিরে জ়ারা তার বান্ধবী শাব্বোকে বলেছিল, সে বাড়ির ঠিক করা বিয়ে করতে চায় না। শাব্বো বীরকে ফোন করে বলুক, সে যেন এসে জ়ারাকে নিয়ে যায়!

হামিদও তাঁর ‘জ়ারা’কে উদ্ধার করতেই পাকিস্তানে ছুটে গিয়েছিলেন। পর্দার ‘বীর’কে ২২ বছর পাকিস্তানের জেলে কাটাতে হয়েছিল। হামিদ ছ’বছর পর, বাবা-মা, ভারত ও পাক বিদেশ মন্ত্রক, ভারত ও পাক সংবাদমাধ্যম, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবীদের নিরন্তর চেষ্টায় দেশে ফিরলেন আজ।

২০১২-এর নভেম্বরে বেআইনি নথি নিয়ে পাকিস্তানে ঢোকার দায়ে গ্রেফতার হন হামিদ। আইএসআই-এর অফিসাররা ধরেই নেন, হামিদ ভারতের গুপ্তচর। ২০১৫-র ১৫ ডিসেম্বর, পাক সামরিক আদালতের রায়ে হামিদের তিন বছর কারাদণ্ড হয়।

হামিদের গল্পের শুরু ২০১০ সালে। ওই সময়েই ফেসবুকে পাকিস্তানের একটি মেয়ের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। চ্যাট করতে করতে প্রেম। ভারসোভার বাসিন্দা ২৭ বছরের হামিদ ইঞ্জিনিয়ারিং আর ম্যানেজমেন্ট পড়ে পড়ানোরই চাকরি করছিলেন। মা ফৌজিয়াও কলেজে পড়াতেন, বাবা চাকরি করতেন ব্যাঙ্কে। হামিদের প্রেমের কথা জানতেন না কেউই।

হামিদের ভালবাসার মেয়েটি থাকতেন আফগান সীমান্ত লাগোয়া খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের কোহাট শহরে। ২০১২ সালের শেষার্ধে মেয়েটি জানালেন, বাড়ি থেকে তাঁর বিয়ে ঠিক হয়েছে। হামিদ এসে যেন তাঁকে উদ্ধার করেন। পরে এই কথোপকথনের নথি ফেসবুক ইনবক্সে দেখতে পান হামিদের মা। এ দিকে পাখতুনখোয়া এলাকাটা পারিবারিক মর্যাদার নামে খুনখারাপির জন্য কুখ্যাত। মেয়েটির মরিয়া আর্তি শুনে হামিদ ঠিক করে ফেললেন তিনি পাকিস্তান যাবেন।

ইতিমধ্যে হামিদের সঙ্গে সম্পর্কের কথা মেয়ের বাড়িতে জানাজানি হয়েছে। মেয়েটির ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ। তাঁর সঙ্গে আর যোগাযোগই করতে পারছেন না হামিদ। কোহাটের আর একটি মেয়েকে ফেসবুকে খুঁজে বের করে কোনও তথ্য পাওয়া যায় কি না, জানার চেষ্টা করলেন। লাভ হল না। এ দিকে ভিসাও জোটে না!

ভারত-পাক আদানপ্রদান নিয়ে কাজ করা এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্তা যতীন দেশাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন হামিদ। দেশাই ভিসার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারলেন না। কিছুদিন পরে তাঁকে খবরের কাগজে দেখলেন, হামিদ পাকিস্তানে নিখোঁজ! সেই থেকে হামিদকে ফেরানোর জন্য প্রাণপাত করেছেন দেশাই। করাচি প্রেস ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ করে পাক সংবাদমাধ্যম এবং আইনজীবী মহলে হামিদের মামলা নিয়ে নিয়মিত তদ্বির করার ব্যবস্থা করেছেন। ‘বীর-জারা’য় শাহরুখের জন্য যে ভাবে লড়ে গিয়েছিলেন রানি মুখোপাধ্যায়, হামিদের জন্য সে ভাবেই লড়েছেন দেশাই, পাক আইনজীবী রক্ষন্দা নাজ এবং‌ কাজি মহম্মদ আনোয়ার।

হামিদ কিন্তু কর্তব্য ঠিক করেই নিয়েছিলেন। ফেসবুকে আলাপ করেন পাকিস্তানের কয়েক জন যুবকের সঙ্গে। তাঁরা বুদ্ধি দিলেন, আফগান সীমান্ত দিয়ে চুপিসারে পাকিস্তানে ঢোকা যায়। হামিদ কাবুলের পর্যটন ভিসা নিলেন। বাড়িতে বললেন, কাবুল বিমানবন্দরে চাকরি পেয়েছেন। কাবুল থেকে সত্যিই বেআইনি নথি বানিয়ে হামিদ পাকিস্তানে ঢোকেন। কোহাটের একটি হোটেলে হামজা খালিদ নাম নিয়ে ঘরও বুক করেন। ১৪ নভেম্বর, ২০১২, ওই হোটেল থেকেই ধরা পড়েন তিনি।

ফেসবুকের চ্যাট রেকর্ড থেকে ইঙ্গিত, হামিদের মাথায় শাহরুখের ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে’ ছবিটার প্রভাবও ছিল তুমুল। তিনিও ভেবেছিলেন, মেয়ের বাবাকে রাজি করাতে পারবেন। সে সুযোগ পাননি। ভারতের এক সাংবাদিক মেয়েটির বাবাকে ফোন করেছিলেন পরে। সাংবাদিকটির দাবি, ভদ্রলোক তাঁকে জানান, মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। হামিদের পরিণতির কথা মেয়েটি জেনেছেন কি না, জানা যায়নি। ফলে বীর-জ়ারার মতো পুনর্মিলন কোনও দিন হবে কি না, বলা যাচ্ছে না সেটাও।

ফৌজিয়ার আবেদনে সাড়া দিয়ে কিছু দিন ধরেই উদ্যোগী হয়েছিলেন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। সোমবার পাক সরকার জানায়, মঙ্গলবার মুক্তি পাবেন হামিদ। এ দিন সকালেই ওয়াঘা পৌঁছে যান ফৌজিয়ারা। পাকিস্তানের মারদান জেল থেকে হামিদকে আনা হয় ইসলামাবাদে। সেখান থেকে ওয়াঘা। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় হামিদ যখন দেশের মাটিতে পা দিচ্ছেন, তখন হারানোর প্রেমের জন্য কোনও বেদনা আর অবশিষ্ট কি না, জানা নেই। তবে হামিদের পরিবার মেয়েটির বিপদের কথা ভেবে আজ অবধি তার পরিচয় প্রকাশ করেনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Pakistan Love Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE