অভিজ্ঞতায় : নানা দেশের শিশুরা ইনফ্লুয়েঞ্জা সংক্রান্ত নানা বিষয় নিয়ে ছবি এঁকেছে। ছবি: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সৌজন্যে।
উপসর্গগুলো খুব চেনা। মাথা ব্যথা, নাক দিয়ে জল ঝরা, কাশি এবং গায়ে হাতে ব্যথা। সাধারণ মানুষ ভাবেন, ঠান্ডা লেগেছে। আসলে এগুলো সবই ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগের লক্ষণ। এই রকম সর্দি, কাশি তথা ইনফ্লুয়েঞ্জা কিন্তু মরসুমি। আবহাওয়া পরিবর্তনের সময়ে হয়। ফলে অনেকেই একে অবহেলা করেন। কিন্তু মরসুমি ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু-ও প্রাণঘাতী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) হিসেব বলছে, প্রতি বছর ছ’লক্ষ ৫০ হাজার জনের মৃত্যু হয় মরসুমি ইনফ্লুয়েঞ্জায়। ঠিক এই কারণেই প্রয়োজন ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রতিষেধকের। বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক, অন্তঃসত্ত্বারা ইনফ্লুয়েঞ্জায় বেশি আক্রান্ত হতে পারেন।
কেন সাধারণ মানুষ ফ্লু আর মরসুমি ইনফ্লুয়েঞ্জা গুলিয়ে ফেলেন? এর একটা কারণ, শীতের সময়েই এর প্রকোপ দেখা যায়। বিশ্বে বছরে দু’বার এর কবলে পড়তে হয়। একবার উত্তর গোলার্ধের ঠান্ডায়। আরেকবার দক্ষিণ গোলার্ধের ঠান্ডায়। তার পর ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সাবধান থাকাটা খুবই জরুরি। কারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাইরাস বারবার তার চরিত্র বদল করে। ছদ্ম আচরণে নিজেকে লুকোয়। এর একটাই কারণ, ভাইরাস চেষ্টা করে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে এড়াতে। ক্রিকেটের পরিভাষায় ‘রিভার্স স্যুইং’ দিতে।
নতুন ধরনের ফ্লু ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতাও সাংঘাতিক। যখন নতুন ধরনের ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে তখন খুব সহজেই মানুষ তাতে আক্রান্ত হন। এবং খুব দ্রুত অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই আক্রান্তদের মধ্যে বেশির ভাগেরই কোনও প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে না। আর তখনই ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর আকার নিতে পারে। হু-র আশঙ্কা, নতুন ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস মহামারীর আকার নিতে। কিন্তু কখন সেটা মারাত্মক আকার নেবে তা হু-এর ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রকল্পের আধিকারিকেরাও জানেন না।
ইনফ্লুয়েঞ্জা কতটা ভয়ঙ্কর তার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। একটি ঘটনা ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরের। দুবাই থেকে নিউ ইয়র্কের একটি বিমানের ঘটনা। ১০০ জন যাত্রী ছিলেন বিমানে। হঠাৎই অনেকের প্রবল শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। বিমানটিকে আলাদা করে রেখে যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছিল। জানা যায়, ‘মার্স-সিওভি’তে আক্রান্ত হয়েছিলেন যাত্রীদের বেশ কয়েকজন। ইনফ্লুয়েঞ্জার সবথেকে খারাপ উদাহরণ ১৯১৮ সাল। বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ মানুষ সেই সময়ে ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। মারা গিয়েছিলেন পাঁচ কোটি মানুষ। এই ইনফ্লুয়েঞ্জা ‘স্পেনীয় ফ্লু’ নামে পরিচিত ছিল। মারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা কখন ছড়াবে এবং কোন রূপে ছড়াবে তা জানা বেশ কঠিন। ১৯৫৭ সালে চিন থেকে ছড়িয়ে ছিল ফ্লু। সারা বিশ্বে মারা গিয়েছিলেন ১০ লক্ষ আক্রান্ত। ২০০৩ সালে এ(এইচ৫এন১) বা অ্যাভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ছড়াল। এই ফ্লু প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছিল। তবে মহামারী হয়নি সেবার। কারণ এই ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়নি। ২০০৯ সালে এল সোয়াইন ফ্লু। এবং মহামারীর আকার নিল। ছড়িয়েছিল মেক্সিকো থেকে। ২১৪টি দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। এক লক্ষ পাঁচ হাজার থেকে তিন লক্ষ ৯৫ হাজার জনের মৃত্যু হয়েছিল বলে মনে করা হয়। শুরু হল পর্যালোচনা। আন্তর্জাতিক সমীক্ষার মত হল,
এই মহামারীর আশঙ্কা এখনও দূর হয়ে যায়নি বলেই মনে করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিষয়ক বিখ্যাত পত্রিকা ‘দ্য ল্যানসেট’ জানাচ্ছে, অন্য রোগের মতোই ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী ছড়াতে পারে দরিদ্রদের মধ্যে। কিন্তু মহামারী ঠেকাতে দেশে দেশে তার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। কারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা হল এমন এক রোগ যার ভাইরাস নিত্য রূপ বদলায়। রোগ ঠেকাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং তার সহযোগী সংস্থাগুলো বিশ্ব জুড়ে পরিকল্পনা নিয়েছে। এই পরিকল্পনায় তিনটি ফল দেবে বলে আশা। প্রথমত, মহামারীর প্রতিরোধে কাজে দেবে। দ্বিতীয়ত, মরসুমি ইনফ্লুয়েঞ্জাও প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। ফ্লু ছড়িয়ে পড়া কী ভাবে প্রতিরোধ করা যায়, তার একটা রূপরেখা আগে থেকেই তৈরি হয়ে থাকবে। কাজ হবে ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতিষেধক আরও ভাল করার। এবং চেষ্টা করা হবে একটি সর্বজনীন প্রতিষেধক তৈরির।
মোটামুটি তিন ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হন মানুষ। একটি সাধারণ, মরসুমি ইনফ্লুয়েঞ্জা। দ্বিতীয়টি হল মহামারীর আকার ধারণ করে এমন ইনফ্লুয়েঞ্জা। যেমন ১৯১৮ সালের স্পেনীয় ইনফ্লুয়েঞ্জা। তৃতীয়টি হল জুনোটিক ইনফ্লুয়েঞ্জা। যা প্রাণী থেকে ছড়ায়। যেমন, বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু ইত্যাদি।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার উপমুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সৌমশঙ্কর ষড়ঙ্গী জানালেন, সাধারণ মরসুমি ইনফ্লুয়েঞ্জা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। তিনি সৈয়দ মুজতবা আলির গল্প ‘বেঁচে থাকুক সর্দি কাশি’র উল্লেখ করে জানান, এই ফ্লু চিকিৎসা করালে সারে সাতদিনে। চিকিৎসা না করালে এক সপ্তাহে। তবে সোয়াইন ফ্লু হলে একটু চিন্তার। তবে সব ধরনের রোগীর ক্ষেত্রে চিন্তার করার প্রয়োজন নেই। কম বয়সি এবং বেশি বয়সিরা এই ফ্লুয়ে আক্রান্ত হলে বেশি সমস্যার। আর যাঁদের কেমোথেরাপি চলছে, যাঁরা স্টেরয়েড নেন তাঁদের ক্ষেত্রে একটু ঝুঁকির হতে পারে। তবে সোয়াইন ফ্লুয়ের চিকিৎসা রয়েছে। সরকারি ভাবেই সেই চিকিৎসা করানো হয়। রয়েছে ওষুধও। শুধু সময় মতো পরীক্ষাগুলো করিয়ে নেওয়া প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন সৌমশঙ্করবাবু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy