Advertisement
E-Paper

বুটের চেয়েও ‘তেজস্ক্রিয়’ যে চটি! হাওয়াই নয়, পুজোর বাজারে খুঁজে পরুন বিদ্যাসাগরি চটিজুতো

চটিটি সাদাসিধে। বাহারহীন। এখনকার ফ্যাশনের লব্জে বললে নিতান্তই ‘বেসিক’। অর্থাৎ যেটুকু একেবারে না হলেই নয়। পা গলানোর অংশটি কালো রঙের চামড়ায় মোড়া। পা রাখার জায়গাটি চ্যাটালো। ব্যস। ওইটুকুই। আঙুল গলানোর জায়গা নেই। বাঁধাবাঁধির সুযোগ নেই। এমনকি, গোড়ালির পিছন দিকে ঠেকনা দেওয়ার ঢাকা অংশও নেই। তবু সেই চটিই পছন্দ ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের।

ঐন্দ্রিলা বসু সিংহ

শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৮:৫৭
বিদ্যাসাগরি চটিজুতো।

বিদ্যাসাগরি চটিজুতো। ছবি: কে এম দাস অ্যান্ড কোং। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

এমজি রোড মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়ে ঠিক সাড়ে ৬ মিনিট হেঁটে পৌঁছোনো গেল কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের সামনে। অগ্রজ সহকর্মী বলে দিয়েছিলেন, ওই চত্বরেই কোথাও একটা ছিল দোকানটা। এখন তার খোঁজ পেতে হলে এলাকার পুরনো লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে হবে। সেই মতো ঝকঝকে দোকানের ভিড় কাটিয়ে একটু পুরনো হয়ে যাওয়া এক দোকানের সামনে গিয়ে প্রশ্ন করতেই বয়স্ক মানুষটি আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলেন উল্টো ফুটের ঈষৎ ভগ্নদশার তিনতলা বাড়ির দিকে। কলেজ স্ট্রিট মার্কেট। একটু আগেই যে বাড়ির ছাদ থেকে বৃষ্টির জমা জল অবিরাম রাস্তার উপর জলপ্রপাতের মতো পড়তে দেখে এসেছি। বয়স্ক দোকানদার বললেন, ‘‘জুতোর দোকান সব ওইখানেই।’’

যে কোনও জুতোর দোকানের খোঁজ নয় অবশ্য। পুজোর আগে ক্রেতাদের ভিড়ে গমগম করা কলেজ স্ট্রিট বাজারে যে জুতোর দোকানের সন্ধানে আসা, তার সঙ্গে জুড়ে আছে বাঙালির ‘শিরদাঁড়া সোজা’ রেখে ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস। যে ইতিহাস কম করে পৌনে দুশো বছরের পুরনো।

তখন শহর কলকাতা দেশের মানচিত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়। ভারতের রাজধানী।তার রাজপথে গটমটিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ইংরেজদের বুটজুতো। সেই বুটের দম্ভের সামনে পাল্টা রোয়াব দেখিয়েছিল একজোড়া নিপাট দেশজ চটি। এ গল্প সেই সহজসরল অথচ তেজি, একরোখা চটিজুতোরই।

নাম ‘তালতলার চটি’। সেই নাম যদিও পরে বদলে যায়। নতুন নাম হয় ‘বিদ্যাসাগরি চটি’। কারণ, ওই চটি পরতেন স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। জুতোর নকশা সামান্য বদলে নিজের মতো করে নিয়েছিলেন বলে তাঁর নামেই রাখা হয় জুতোর নাম। তাঁকে নিয়ে কথিত বহু গল্পের ‘হিরো’ তিনি হলেও হিরোয়িজ়মের ‘অস্ত্র’ ছিল ওই চটি!

ফ্যাশনও যে নবজাগরণের সূচনা করতে পারে আর পাল্টা প্রতিবাদের অস্ত্র হতে পারে, তা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ছবিতে তাঁর পায়ে সেই বিদ্যাসাগরি চটিজুতো।

ফ্যাশনও যে নবজাগরণের সূচনা করতে পারে আর পাল্টা প্রতিবাদের অস্ত্র হতে পারে, তা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ছবিতে তাঁর পায়ে সেই বিদ্যাসাগরি চটিজুতো। ছবি: সংগৃহীত।

নানা গল্পের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় যেটি, তার পটভূমি এই কলেজ স্ট্রিট চত্বরই। সালটা হয় ১৮৫০ নয়তো ১৮৫১। কলেজ স্কোয়ারের দু’পাশে দুই কলেজ। হিন্দু কলেজ (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তানদের জন্য। সংস্কৃত কলেজে পড়তেন সাধারণ মধ্যবিত্ত অথবা নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেরা। ১৮৫০ সালে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক হন। এক দিন গেলেন হিন্দু কলেজে। তৎকালীন অধ্যক্ষ জেমস কারের সঙ্গে দেখা করতে। সাক্ষাতে কার সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন না তো বটেই, কথা বললেন বুটজুতো পরা পা জোড়া টেবিলে তুলে রেখে। বিদ্যাসাগর দেখলেন। ক্রুদ্ধও হলেন। কিন্তু বললেন না কিছু। ভুললেনও না। কিছু দিন পরে কার সাহেবকে আসতে হল সংস্কৃত কলেজে। তখন বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছেন। বিদ্যাসাগরকে খবর পাঠালেন, তিনি দেখা করতে চান। কার সাহেব ঘরে এলে বিদ্যাসাগর তাঁর তালতলার চটি পরা পা দু’টি সটান তুলে দিলেন টেবিলে এবং চটি সাহেবের মুখের দিকে রেখেই কথা বললেন তাঁর সঙ্গে!

এ হেন তালতলার চটিটি কিন্তু নিতান্তই সাদাসিধে। বাহারহীন। এখনকার ফ্যাশনের লব্জে বললে নিতান্তই ‘বেসিক’। অর্থাৎ যেটুকু না হলেই নয়। পা গলানোর জায়গাটি কালো রঙের চামড়ায় মোড়া। পা রাখার জায়গাটি চ্যাটালো। ব্যাস। ওইটুকুই। আঙুল গলানোর জায়গা নেই। বাঁধাবাঁধির সুযোগ নেই। এমনকি, গোড়ালির পিছন দিকে ঠেকনা দেওয়ার ঢাকা জায়গা টুকুও নেই। তবু সেই চটিই পছন্দ ছিল বিদ্যাসাগরের। যা তিনি কিনতেন কলেজ স্ট্রিটের জনাকয়েক চর্মশিল্পীর কাছ থেকে। যাঁদের এক জনের নাম ভবীচরণ দাস অন্য জন ক্ষেত্রমোহন দাস। কলেজ স্ট্রিট মার্কেট চত্বরে আসা সেই ভবীচরণ দাস এবং ক্ষেত্রমোহন দাস ওরফে কেএম দাসের জুতোর দোকানের সন্ধানেই।

সাফল্যের ব্যাপারে খানিক দোনামনা নিয়েই ঢোকা গেল কলেজ স্ট্রিটের বর্ণপরিচয় মার্কেটে। নীচে দশকর্মা ভান্ডার থেকে শুরু করে জামাকাপড়, খেলনা, শাড়ি, মনিহারির দোকান ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ভবীচরণ দাসের জুতোর দোকান কোথায়, প্রশ্ন করতে লোকজন নাম শুনেছেন বলেই মনে হল না। কেএম দাসের জুতোর দোকান শুনে এক জন বললেন বাজারের পরের ব্লকে যেতে। ঝুলকালি পড়া দেওয়াল, জমা জল আর কাদা পেরিয়ে পরের ব্লকে পৌঁছোতেই চোখ পড়ল একটি সরু ব্যানার পোস্টারে। হালকা হলুদ রঙের ময়লাটে ছোপ ধরা কাগজে লাল এবং নীল রং দিয়ে লেখা নাম ‘আদি কেএম দাস’। ভরসা হল। দোকানটা তবে আছে! উঠে যায়নি।

পোস্টার তো হল, কিন্তু দোকান কোথায়? দু’ পা এগোতেই জবাব মিলল। একই রকম আরও এক পোস্টার। তাতে তীর চিহ্ন দিয়ে পথনির্দেশ। তবে সে পথ মূল বাজারের দিকে না গিয়ে ঢুকেছে গলিতে। সে গলি নিয়ে যাচ্ছে এক প্রায় অন্ধকার সিঁড়ির দিকে। যে সিঁড়ির শেষে জুতোর দোকান থাকলে এই পুজোর বাজারে জায়গাটি জনমানবহীন হওয়ার কথা নয়। অথচ পোস্টারের নীচে ঠিকানায় স্পষ্ট লেখা— ফার্স্ট ফ্লোর, ব্লক বি, বর্ণপরিচয় মার্কেট।

বিদ্যাসাগরি চটির বর্তমান ঠিকানা। ১) শ্যাওলা, নোংরা জমা জল, আবর্জনার  স্তূপ পেরিয়ে নোনা ধরা দেয়ালের ধার ঘেঁষে ঢুকতে হয়! ২) আদি কে এম দাসের পথ নির্দেশের পোস্টার। মূল বাজার ছেড়ে পথ ঢুকছে বাঁ দিকে। ৩) সিঁড়ির দ্বিতীয় প্যাঁচ। ক্রমশ অন্ধকার বাড়ছে। ৪) অবশেষে গন্তব্য। কে এম দাসের দোকান। পুরনো সেগুন কাঠের সাইন বোর্ডটি আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন দোকানের মালিক।

বিদ্যাসাগরি চটির বর্তমান ঠিকানা। ১) শ্যাওলা, নোংরা জমা জল, আবর্জনার স্তূপ পেরিয়ে নোনা ধরা দেয়ালের ধার ঘেঁষে ঢুকতে হয়! ২) আদি কে এম দাসের পথ নির্দেশের পোস্টার। মূল বাজার ছেড়ে পথ ঢুকছে বাঁ দিকে। ৩) সিঁড়ির দ্বিতীয় প্যাঁচ। ক্রমশ অন্ধকার বাড়ছে। ৪) অবশেষে গন্তব্য। কে এম দাসের দোকান। পুরনো সেগুন কাঠের সাইন বোর্ডটি আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন দোকানের মালিক। —নিজস্ব চিত্র।

এক প্যাঁচ সিঁড়ি উঠেও ‘ফ্লোর’ জাতীয় কিছু চোখে পড়ল না। সিঁড়ি আরও একখানি প্যাঁচ দিয়ে উপরে উঠেছে আবার। ঠিক রাস্তা তো! মনেও হল এক বার। ভরসা এটাই যে তেলকালি, ঝুল, পানের পিক মাখা দেওয়ালে সেই লাল-নীল হরফের পোস্টার চোখে পড়ছে সিঁড়ির প্রতি মোচড়েই। আর এক প্যাঁচ সিঁড়ি উঠতেই এল দালান। তার দু’পাশে সব বন্ধ দোকানের মধ্যে আলো জ্বলছে পাশাপাশি দু’টি দোকানের। জুতোর দোকান। সাইনবোর্ডে সেই নাম, যার সন্ধানে আসা।

দু’টি দোকান কেন? সে গল্প পরে। তার আগে সাধারণ তালতলার চটির ‘বিদ্যাসাগরি চটি’ হয়ে ওঠার গল্প শোনার ছিল। যে চটি তার গোলগাল সাদাসিধে গড়ন ছেড়ে শুঁড় পেয়েছিল। যে শুঁড় দেখে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও মস্করা করতে ছাড়েননি। শোনা যায়, এক সাহিত্যসভায় অতিথি হয়ে আসা বিদ্যাসাগরকে বঙ্কিম বলেছিলেন, ‘‘আপনার তালতলার চটির শুঁড় তো দেখছি ক্রমেই উপরে উঠছে। দেখবেন, শেষে মাথায় গিয়ে না ঠেকে।’’ শুনে বিদ্যাসাগরও পাল্টা ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ‘‘কী আর করা যায় বলো! ‘চট্ট’রা (চটি অর্থে) যতই পুরনো হয় ততই দেখি বঙ্কিম (শুঁড়ের মতো বেঁকে যায় বোঝাতে) হয়েই ওঠে।’’

তালতলার চটিতে শুঁড় এল কেন? কেএম দাসের দোকানের বর্তমান কর্ণধারদের সে প্রশ্ন করতে তাঁরা জানালেন, তালতলার চটিকে শুঁড়তোলা চটি বানানোর ভাবনা আসে বিদ্যাসাগরের মাথাতেই। দু’টি দোকানের একটির বর্তমান মালিক তরুণকুমার মুখোপাধ্যায়। তিনি বলছেন, ‘‘বিদ্যাসাগর প্রথমে তালতলার সাধারণ চটিই পরতেন। অর্থাৎ যে জুতোর মাথার দিকটা ছিল গোল। পরে তাঁর ইচ্ছে হয়, ওই গোল মাথা খানিকটা ছুঁচোলো করে শুঁড় তোলা জুতো পরবেন। ক্ষেত্রমোহনকে সেই ইচ্ছের কথা জানাতে তিনিই বিদ্যাসাগরের জন্য তৈরি করে দেন শুঁড়তোলা চটিজুতো। তালতলার চটির সেই শুঁড়তোলা সংস্করণের নাম হয় বিদ্যাসাগরি চটি।’’

এ হেন বিদ্যাসাগরি চটিজুতোর আরও বহু ইতিহাস আছে। তার একটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষের নামও। গিরিশচন্দ্রের তৈরি ন্যাশনাল থিয়েটারে ‘নীলদর্পণ’ নাটকের প্রথম নাট্যরূপ মঞ্চস্থ হয়। সেই নাটকে ব্রিটিশ শাসকের অত্যাচারের বহর দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন দর্শকাসনে বসা বিদ্যাসাগর। খল চরিত্রের অভিনেতা গিরিশকে নিজের পা থেকে চটি খুলে ছুঁড়ে মেরেছিলেন তিনি। তরুণ বলছেন, সেই চটি ছিল ওই শুঁড় তোলা বিদ্যাসাগরি চটিই। যে চটি দীর্ঘ দিন রাখা ছিল স্টার থিয়েটারে।’’ সে চটি কি তিনি নিজে চোখে দেখেছেন? প্রশ্ন শুনে তরুণ বললেন, ‘‘নিজে দেখিনি। কারণ কথাটা যখন শুনেছিলাম, তখন আমরা ছোট। আমাদের বাবাকে খবরটা দিয়েছিলেন তাঁর বন্ধু। বলছিলেন, ওই চটি স্টার থিয়েটারে রাখা আছে। তাঁর কাছ থেকেই জানা।’’

শুঁড়তোলা বিদ্যাসাগরি চটি আর তালতলার আদি চটি (মাঝে)।

শুঁড়তোলা বিদ্যাসাগরি চটি আর তালতলার আদি চটি (মাঝে)। —নিজস্ব চিত্র।

বিদ্যাসাগরের জুতোর গল্প অবশ্য এখানেই থেমে থাকে না। বিদ্যাসাগর পরবর্তী যুগেও সে চটি জনপ্রিয় ছিল। তরুণ বলছেন, ‘‘সত্যজিৎ রায় থেকে শুরু করে ছবি বিশ্বাস, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অনিল চট্টোপাধ্যায়, এমনকি, উত্তমকুমারের বাড়িতেও এই জুতো যেত আমাদের দোকান থেকে। সত্তরের দশকে বাংলা সিনেমার বহু তারকাই এই দোকান থেকে বিদ্যাসাগরি জুতো কিনেছেন। সিনেমায় ব্যবহারের জন্যও ওই জুতো নিয়ে যাওয়া হত।’’ তবে কেএম দাসের জুতোর দোকানের মালিকানা তত দিনে বার কয়েক বদলে গিয়েছে। ক্ষেত্রমোহন অনেক আগেই ব্যবসা বিক্রি করেছেন এক পঞ্জাবি মুসলিম ব্যবসায়ীকে। পরে ১৯৪৬ সালে তাঁর থেকে ওই ব্যবসা কিনে নেন মহেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তবে মালিক বদলালেও জুতোর নকশা বদলায়নি। তালতলার চটি, শুঁড়তোলা বিদ্যাসাগরি চটি, গান্ধী চটি, জলসা জুতো— সবই পাওয়া যেত। সেই সব জুতো রমরমিয়ে কাটতও বাজারে। সেখান থেকে কাট টু ২০২৫-এর পুজোর আগের মাস।

জমজমাট পুজোর বাজার। চেনা ব্র্যান্ডের জুতোর দোকানে উপচে পড়ছে ভিড়। কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের অন্য ব্লকের দোতলায় ক্রেতাদের জুতো দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না সেলসম্যান। অথচ সেখান থেকে কয়েক মিনিট হেঁটে কেএম দাসের জুতোর দোকান সুনসান। দু’টি দোকানের চারটি মানুষ ছাড়া জনপ্রাণী নেই। অথচ শোকেসে রকমারি চটি সাজানো। তার মধ্যে অধিকাংশই কেতাদুরস্ত কোলাপুরি চপ্পল। যে কোলাপুরি এই সে দিন ইতালির ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘প্রাডা’ মিলানের মার্জার সরণিতে মডেলদের পরিয়ে গোটা বিশ্বের নজর কেড়েছে। যে কোলাপুরির লক্ষ টাকা দাম ধার্য করেছে তারা। তা নিয়ে মহারাষ্ট্রের কোলহাপুরের আসল কোলাপুরি শিল্পীদের সঙ্গে সংঘাতেও জড়িয়েছে। আর কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে কেএম দাসের দোকান মহারাষ্ট্রের শিল্পীদের থেকেই সেই একই কোলাপুরি আনিয়েও দোকানে মাছি তাড়াচ্ছে! ঐতিহ্যবাহী গান্ধী চটি, বিদ্যাসাগরী চটি, তালতলার চটিও লুপ্তপ্রায়, বাক্সবন্দি। কয়েকটি পুরনো ‘স্যাম্পেল’ বাঁচিয়ে রাখা আছে। গৌরবের শেষ প্রমাণ হিসাবে।

বিদ্যাসাগরি চটিজুতো কি তা হলে আর পাওয়া যায় না? মহেশচন্দ্রের আর এক পৌত্র দেবব্রত ওরফে দেবু মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘কিছু পুরনো মানুষ এখনও ওই চটির খোঁজ করেন। আবার কখনও সখনও সিনেমার জন্যও ওই চটির খোঁজ পরে। তাঁদের জন্যই বিদ্যাসাগরি চটি আর তালতলার চটি এখন বানানো হয়। তবে খুবই কম সংখ্যায়। তা-ও চামড়ায় নয়, রেক্সিনে।’’

গোটা দুনিয়া যেখানে ঐতিহ্যকে নতুন আঙ্গিকে মুড়ে আধুনিকের কাছে পেশ করছে, সেখানে কেএম দাসের বিদ্যাসাগরি চটি কোথায় পিছিয়ে গেল? দেবু বলছেন, ‘‘বিদ্যাসাগর যে চামড়ার চটিজুতো পরতেন, তা নিজে হাতে বানাতেন ক্ষেত্রমোহন দাস। তিনি ছিলেন বর্ধমানের মানুষ। পেশাদার চর্মশিল্পী। তাঁর হাতের কাজ এতটাই সূক্ষ্ম এবং সুন্দর ছিল যে, সে যুগে স্বর্ণপদকও পেয়েছিলেন। পরবর্তী কালে ক্ষেত্রমোহন জুতো বানানোর কাজ বন্ধ করেন। ১৯০০ সালের নিজের দোকানটি এক পাঞ্জাবি মুসলিম ব্যবসাদারকে বেচেও দেন। ১৯৪৬ সালে সেই ব্যবসা কিনে নেন আমাদের দাদু মহেশচন্দ্র। তিনি বাঁকুড়ার মুচিদের দিয়ে বানাতে শুরু করেন বিদ্যাসাগরি জুতো। কিন্তু যাঁরা ওই জুতো বানাতেন তাঁদের কেউই এখন আর বেঁচে নেই। চাহিদা না থাকায় পরবর্তী প্রজন্মও আর এ কাজে আসেননি। ফলে শিল্পী পাওয়াই দুষ্কর হয়ে পড়েছে।’’

নকল এবং আসল। বাঁ দিকে, রেক্সিন দিয়ে তৈরি এই যুগের বিদ্যাসাগরি চটি জুতো। ডান দিকে আসলটি। যা চামড়া দিয়ে সেলাই করা হত। এ যুগে যা তৈরি করার শিল্পী আর নেই।

নকল এবং আসল। বাঁ দিকে, রেক্সিন দিয়ে তৈরি এই যুগের বিদ্যাসাগরি চটি জুতো। ডান দিকে আসলটি। যা চামড়া দিয়ে সেলাই করা হত। এ যুগে যা তৈরি করার শিল্পী আর নেই। —নিজস্ব চিত্র

এখন যাঁরা বিদ্যাসাগরি জুতো কিনতে চান, তাঁরা হাতে পান রেক্সিনের জুতো। তার নকশা আর আসল বিদ্যাসাগরি জুতোর নকশায় আসল-নকলের তফাত স্পষ্ট। তরুণ আরও বলছেন, ‘‘ওই বিশেষ ধরনের জুতো তৈরির জন্য যে দক্ষতা দরকার, তা আর এ যুগের চর্মশিল্পীদের মধ্যে বিরল। নেই ধৈর্যও। তা ছাড়া, প্রচুর কাটতিও নেই যে, এর জন্য অনেক অর্থ ব্যয় করা যাবে।’’ অন্য দিকে দেবব্রত বলছেন, ‘‘রেক্সিনকে মুড়ে নির্দিষ্ট আদল দেওয়া সহজ। তার জন্য খুব বেশি শৈল্পিক দক্ষতার দরকার নেই। তাই সাধারণ শিল্পীদের স্যাম্পেল দিয়ে রেক্সিনের জুতো তৈরি করাচ্ছি।’’

মান পড়েছে। তবে ব্যবসা পড়ার আরও কিছু কারণ আছে। ১৮৩৮ সালে ক্ষেত্রমোহনের হাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে দোকান, তা এখন বহু ভাগে ভাঙা। দেবব্রত জানাচ্ছেন, তাঁদের বাবারা ছিলেন পাঁচ ভাই। এঁদের মধ্যে মেজ যিনি, তিনি দাদু বেঁচে থাকাকালীনই নিজের আলাদা দোকান করেছিলেন। পুরনো দোকানটি থেকে যায় বাকি চার ভাইয়ের হাতে। পরবর্তী কালে সেই পুরনো ব্যবসাও বাকি ভাইদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়। আলাদা আলাদা দোকান হয় কেএম দাসের। তার অনেকগুলিই এখন উঠে গিয়ে ঠেকেছে দু’টিতে। একটি আদি কেএম দাস, যেটি ১৮৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত। অন্যটি সেই মেজ ভাইয়ের দোকান। কলেজ স্ট্রিটে এই দুই দোকানের নামডাক ছিল ২০০০ সালেও। কিন্তু বাম আমলে কলেজ স্ট্রিটে বর্ণপরিচয় বাজারের কাজ শুরু হওয়ার পরে এক ধাক্কায় শিকড় উপড়োয় দুই দোকানেরই।

তরুণ জানাচ্ছেন,বর্ণপরিচয় বাজারের জন্য চেনা জায়গা ছাড়তে হয়। টানা দশ বছর অন্য জায়গায় ভাড়া করে দোকান চালু রাখেন তাঁরা। তার প্রভাব পড়ে ব্যবসায়। পরে যখন তাঁরা ফিরে আসেন,তখন দোকানঘর পান এমন জায়গায়,যেখানে অন্য কোনও দোকান নেই। তরুণ বলছেন, ‘‘জুতোর সব ক’টি দোকান একটি ব্লকে আর কেএম দাসের দোকান অন্য ব্লকে। দোকানে যে মানুষ আসবেন, তার জন্য তো দোকানটির অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে হবে। সেটা না জানতে জুতো কিনবেন কোথা থেকে!’’ একই বক্তব্য দেবব্রতেরও।

পরিস্থিতির ফেরে খুচরো ব্যবসা পড়ে যাওয়ায় আপাতত হোলসেল বা দোকানে দোকানে জুতো সরবরাহের কাজ করেই ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন তাঁরা। যে চটি জুতো এক কালে ইংরেজদের সঙ্গে টক্কর নেওয়া বিদ্যাসাগরের পায়ের শোভা বাড়িয়েছে,তার দোকান এখন খাস ‘বর্ণপরিচয়’ বাজারেই একঘরে।

Puja Special 2025 Vidyasagari Choti
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy