স্বাধীনতা পাওয়ার পর যে সকল মানুষ এই দেশটিকে ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে তৈরি করার চেষ্টা করলেন, যে আদর্শ এবং স্বপ্ন দেখে সংবিধান লেখা হল, স্পষ্টতই বুঝতে পারছি, তার ধারকাছেও আজকে আমরা নেই! সকলের জন্য সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া হল। কিন্তু সেই সমানাধিকার কী ভাবে প্রত্যেকের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে, সেই প্রয়োগপ্রণালী এবং পদ্ধতিগত জায়গা থেকে গত ৭৮ বছর ধরে নিশ্চয়ই কোনও ত্রুটি থেকে গেল, যে কারণে আজকে দেশের শাসকেরা যেন স্বাধীনতার ‘এজেন্সি’ হয়ে উঠেছেন। কেন লিখলাম এ কথা? নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। একটু বিশদে বলা যাক।
আরও পড়ুন:
দেশের যাঁরা শাসক, যাঁরা রাজ্য পরিচালনা করেন, তাঁরাই মূলত ঠিক করেন, কাকে কতটুকু ‘স্বাধীনতা’ দেওয়া হবে। যাঁর যত বেশি অর্থ, তাঁর তত বেশি স্বাধীনতা। ইংরেজিতে বিষয়টিকে ‘অলিগার্ক’ বলা হয়। অর্থাৎ ‘গোষ্ঠীপতি’। তিনিই সব ঠিক করে দেন। সহজ ভাবে ধরা যেতে পারে, স্বাধীনতা একটা কেকের মতো। এ বারে বলে দেওয়া হল, ‘‘দেখো বাপু, দেশ স্বাধীন হয়েছে। সংবিধানও আছে জানি। কিন্তু আমি ঠিক করব যে, তুমি এই কেকের কতটা অংশ পাবে।’’
এখন প্রশ্ন হল, আমি আমার উপার্জনের মাধ্যমে ওই কেকের যতটুকু অংশ পাই, সেটা সম্প্রতি ওড়িশায় নিগৃহীত বাংলার মুর্শিদাবাদের বাসুদেবপুরের বাসিন্দা দিনমজুর সুজন সরকার কি পাচ্ছেন? যত দূর জানি, তিনি এখন নাগপুরে কাজ করতে গিয়েছেন। সুজন সরকারকে ভারতীয় সংবিধান যে অধিকার দিয়েছে, আমাকে, এই অনির্বাণ ভট্টাচার্যকেও সেই একই অধিকার দিয়েছে। কিন্তু যে এজেন্সি তথা রাষ্ট্রব্যবস্থা এই স্বাধীনতা নামক কেকের টুকরোটি কেটে কেটে বিলি করছে, সে আমাকে অনেকখানি দিয়েছে এবং তার হয়তো অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি টুকরো সুজন সরকারের মতো মানুষদের কাছে পৌঁছোয়নি।
অনির্বাণ ভট্টাচার্য। ছবি: সংগৃহীত।
এখন তো মোবাইলের দৌলতে গোটা বিশ্ব হাতের মুঠোয়। ধনতন্ত্র স্ফীতোদর হয়ে গিয়েছে। বাড়িতে বসে আমি সুইগি বা জ়োম্যাটোয় খুব সহজেই খাবার অর্ডার করতে পারছি। আমার কাছে সেই স্বাধীনতা আছে। কিন্তু যে ছেলেটি বা লোকটি মোটরবাইক বা সাইকেলে চেপে আমার বাড়িতে খাবার পৌঁছে দিতে আসছেন, তিনি কি সকাল ৬টা থেকে এই কাজটি করতে করতে আমার বাড়িতে আসার আগে কোনও চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে একটু চা, দুটো বিস্কুট বা একটা ডিমের পোচ খেয়ে নেওয়ার স্বাধীনতা পাচ্ছেন? পাচ্ছেন না তো! তার উপর, এই এজেন্সি তাঁর উপর নিয়ম চাপিয়ে দিয়েছে, ‘‘না, ২০ মিনিটের মধ্যেই তুমি ডেলিভারি করে দাও। না হলে ও তোমাকে খারাপ রেটিং দিয়ে দেবে!’’ তা হলে কী দেখা গেল? আমার কাছে অর্থ এবং সুবিধা আছে বলে আমি যে স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছি, যিনি আমাকে এই খাবারটা পৌঁছে দিচ্ছেন, তিনি সেই স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছেন না। দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতা এবং অধিকারের সমবণ্টন একেবারেই ঘেঁটে গিয়েছে। স্বাধীনতা রাষ্ট্র নামক এজেন্সির হাতে কুক্ষিগত এবং তাঁরা বিষয়টাকে একটা ব্যবসায়িক ফর্মুলায় ফেলে পরিচালনা করছেন। কেকের টুকরো পাওয়ার জন্য তাঁদের কখনও অর্থ, কখনও ভোট, কখনও কোনও সুবিধা দিতে হবে— যা তাঁকে পরোক্ষে ক্ষমতার চেয়ারে বসে থাকতে সাহায্য করবে।
আমি যে পেশায় কাজ করি, সেই ইন্ডাস্ট্রিতে গত এক বছর ধরে দুই পক্ষের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব চলছে। তা মাথায় রেখে খুব উঁচু দরের পরিচালকেরাও টিভির পর্দায় বা সংবাদপত্রে বলেছেন, এই লড়াইটা আসলে প্রযোজকদের লড়াই, পরিচালকেরা বলছেন কেন? সমস্যাটা আসলে সামগ্রিক ইন্ডাস্ট্রির। কিন্তু বলে দেওয়া হচ্ছে, ‘‘তুমি এটা বোলো না!’’ এই প্রসঙ্গে একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। খেতে চাষ করার সময়ে লাঙল চালানো, গরুকে নিয়ে আসা, বীজ বপন করা বা জমিতে জল দেওয়া— প্রতিটি বিভাগের দায়িত্ব ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির উপরে রয়েছে। ধরা যাক, যিনি জল দেন, তিনি হয়তো গরুর স্বাস্থ্য বা লাঙলের মরচে নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। তখন তাকে বলা হল— ‘‘তুমি তো জমিতে জল দাও। লাঙল নিয়ে চিন্তা করছ কেন?’’ একই ভাবে বলে দেওয়া হচ্ছে, ‘‘তুমি তো স্বাধীন। নিজে খুশি থাকো। অন্যের স্বাধীনতা নিয়ে ভেবো না।’’
মজার বিষয়, সর্বোচ্চ রাষ্ট্রব্যবস্থা দেশ পরিচালনার জন্য যে ‘মডেল’টি চালু করে, সব রাজ্য, রাজনৈতিক দল এবং সংগঠন (যেমন পাড়ার ক্লাবের দুর্গাপুজো কমিটি থেকে শুরু করে কোনও ফেডারেশন) সেটাকেই অনুসরণ করে। কখনও কখনও সরকার ব্যতিরেকেও বিষয়টি চলতে থাকে। দেশের গণ্ডির বাইরেও একই জিনিস চলতে থাকে। পৃথিবীব্যাপী যাঁরা ধনতন্ত্রের বিধাতা, তাঁরা যে ব্যবস্থা চালু করেন, সেটাই সমাজের বাকি স্তরে প্রতিফলিত হয়। শুরুতে যে ফুড ডেলিভারি অ্যাপের উদাহরণ দিয়েছি, একই ভাবে আমাদের দেশের কোনও একটি অ্যাপ ক্যাব সংস্থা ইউরোপ এবং আমেরিকাতেও রয়েছে। কোন দেশ কী ভাবে তার অ্যাপ-ক্যাব চালকদের সুরক্ষা রক্ষা করবে, সেটা তাদের সিদ্ধান্ত। একই ভাবে আমার বাড়িতে সময়ে খাবার ডেলিভারি করতে গিয়ে জোরে বাইক চালিয়ে কর্মীর যাতে দুর্ঘটনা না ঘটে, সেটা নিশ্চিত করবে আমাদের দেশের সরকার এবং তার তৈরি নীতি। কিন্তু সেখানে সরকার সব সময়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, ‘‘তুমি তো ভাল আছ। যে ভাল নেই, তাকে নিয়ে তোমার এত চিন্তা কিসের!’’
অনির্বাণ ভট্টাচার্য। ছবি: সংগৃহীত।
আমাদের পোশাগত জায়গায় এখন অন্যতম বড় থ্রেট এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা)! সমাজমাধ্যম থেকে শুরু করে চারপাশে একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই বোঝা যাবে, এআই বিষয়টি ধীরে ধীরে আমাদের জীবনে ঢুকে পড়ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে মনে হচ্ছে, বেশ কিছু অভিনেতা, গ্রাফিক ডিজ়াইনার বা সঙ্গীতশিল্পীরা কাজ হারাবেন। কিন্তু দুটো আশঙ্কা একই ধরনের। বকলমে বলে দেওয়ার চেষ্টা— ‘‘তুমি তো এখনও কাজ পাচ্ছ। তুমি তো এখনও নামী অভিনেতা। তুমি তো এখনও অনুষ্ঠানে ডাক পাচ্ছ। তা হলে এআই-এর আগমনে এখনই যাঁরা কাজ হারাচ্ছেন, তাঁদের নিয়ে তুমি এত চিন্তিত হচ্ছ কেন?’’ তা হলে দেখা গেল, আমার কাছে যে স্বাধীনতা রয়েছে, সেটা আমাকে অর্থ (কর) দিয়ে এবং সামাজিক অবস্থানের মাধ্যমে রক্ষা করতে হচ্ছে। অথচ এই মুহূর্তে আমার বাড়ির পাশে যে শ্রমিকেরা নির্মাণের কাজ করছেন বা বাড়ির নীচে রাস্তা সারাইয়ের কাজ করছেন— তাঁদের এবং আমার কিন্তু খাতায়কলমে একই অধিকার রয়েছে। কিন্তু তাঁরা তাঁদের স্বাধীনতা কি রক্ষা করতে পারছেন?
ভারত শাসন করার জন্য একটি কঠিন দেশ। আমি জানি, এত সহজে এখানে সাম্যের পরিবেশ তৈরি করা কঠিন। তা হলে ৭৮ বছর ধরে কী হল? এত সরকার, এত সংগঠন থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতার সমবণ্টন না হলেও, তার অন্তত কাছাকাছি পৌঁছোনো গেল না কেন? আজকে পরিযায়ী শ্রমিকেরা তাঁদের সাংবিধানিক অধিকার বলে দেশের বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে যেতে পারছেন। একই ভাবে একজন বাঙালি অভিনেতা বিমানে চেপে মুম্বই বা দক্ষিণ ভারতে উড়ে গিয়ে কাজ করছেন। তাঁর তো কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু তাঁকে এবং একজন পরিযায়ী শ্রমিককে রাষ্ট্র কতটা স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পেরেছে, তার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যিশু সেনগুপ্ত, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় বা অনির্বাণ ভট্টাচার্য মুম্বই বা দক্ষিণে কাজ করতে যাচ্ছেন এবং সুজন সরকার অন্য রাজ্যে কাজ করতে যাচ্ছেন— দুটো বিষয় কিন্তু একই। উভয়ের স্বাধীনতাই রক্ষা করতে হবে রাষ্ট্রকে। অতএব ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে দেখা যাচ্ছে, ভারতের স্বাধীনতা এমন এক সোনার পাথরবাটিতে পরিণত হয়েছে, যা আসলে একটি এজেন্সির কাছে রয়েছে। যে যত বেশি বিত্তবান হয়ে উঠতে পারছে, যতখানি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারছে, ততখানিই তার স্বাধীনতা।
আরও একটি বিষয়ের উল্লেখ করতে চাই। মানুষের মধ্যে স্বাধীনতাবোধ কিন্তু তৈরি হয় শিক্ষার মাধ্যমে। শিক্ষা তো সকলের অধিকার। সেটা তো কেনার জিনিস নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজকে শিক্ষাও কিনতে হচ্ছে। সম্প্রতি বর্ষীয়ান দক্ষিণী অভিনেতা কমল হাসনও বলেছেন যে, স্বাধীনতা এবং সংবিধান স্বীকৃত বোধগুলি আমাদের দেশে ঠিক কী রকম, সেটা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল শিক্ষার। আমিও যে আজকে এতগুলো কথা লিখছি, সেটা তো আমি আমার স্কুল থেকে পেয়েছি। আমার মাস্টারমশাইয়েরা আমাকে শিখিয়েছেন। আমার বাড়ির নীচে যিনি রাস্তা সারাই করছেন, তাঁর বা তাঁর সন্তানের শিক্ষার অধিকার কেড়ে নিল কে? কিন্তু উত্তর আসছে, ‘‘আরে ভাই, তুমি তো শিক্ষা পেয়েছ। তুমি চুপ করে বসে থাকো। ওঁর অধিকার নিয়ে তোমাকে কেন মাথা ঘামাতে হচ্ছে? আমাদের স্বাধীনতার এজেন্সি আছে, আমরা ওটা আমাদের মতো দেখে নেব। তোমাকে তো কেকের বড় টুকরোটা দিচ্ছি।’’
আরও পড়ুন:
একটি যুক্তরাষ্ট্র তখনই তৈরি হয়, যখন সমাজের একটি শ্রেণি অন্যের সঙ্গে যুক্ত থাকে। প্রত্যেকে যদি প্রত্যেকের থেকে বিযুক্ত হয়ে থাকে, তা হলে তাকে আর যুক্তরাষ্ট্র বলার কোনও যুক্তি খাটে না। তখন আর বললে চলে না যে ‘‘সমস্যাটা প্রযোজকদের, পরিচালকেরা কেন বলছেন।’’ সমস্যাটা ইন্ডাস্ট্রির, সমস্যাটা সকলের। আমি যদি আজকে আমার টেকনিশিয়ানদের কথা না বলি, আমার প্রযোজকদের কথা না বলি বা সুজন সরকারদের কথা না বলি, তা হলে এই ভাবে চলতে চলতে দেশে কেবল দুটো জাতিই রয়ে যাবে— যাঁদের কাজের লোকের প্রয়োজন এবং কাজের লোক! দেশের সংবিধান এবং স্বাধীনতা তো সকলকে সমানাধিকার দিয়েছে মশাই। তা হলে সেই সমানাধিকারের কী হবে? সংবিধানকে টেবিলে আনুন। তারপর সেটা নিয়ে কী করা উচিত, সেটা ভেবে দেখুন। বইটিকে ছুড়েও ফেলতে পারছি না। আবার সেখানে যা লেখা আছে, তার প্রয়োগও করতে পারছি না বা হয়তো চাইছি না। কারণ প্রয়োগ করতে হলে তো পরিশ্রম করতে হবে! এখন দেশব্যাপী একপ্রকার বিযুক্তিকরণের মধ্যে, যেখানে বার বার বলে দেওয়া হচ্ছে ‘‘তুমি সুখী, তুমি স্বাধীন। তুমি সেটা নিয়ে আরামে বাড়িতে বসে থাকো’’, সেখানে ভারত একটি স্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে আবার কবে মাথা তুলে দাঁড়াবে, সেটা আমার পক্ষে বলা সত্যিই সম্ভব নয়।
(লেখক অভিনেতা। মতামত ব্যক্তিগত।)
অনুলিখন: অভিনন্দন দত্ত