ভাইয়ের জন্য বাছাই করা, তা কি মুখের কথা? তালিকা যতই লম্বা হোক না কেন, সেরার সেরাই খুঁজতে হবে।বিশেষ দিনটিতে আদরের ভাইয়ের মুখে হাসি না ফুটলে আয়োজনই বৃথা!
ভাইফোঁটার অপেক্ষা থাকে বছরভর। ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিয়ে যমদুয়ারে কাঁটার বন্দোবস্ত করা— দিদি-বোনেদের কর্তব্য এইটুকুতেই শেষ হয়ে যায় না। আদরের ভাইকে তার পছন্দের মিষ্টিটি দিতে না পারলে মনে থাকে খুঁতখুতানি।
ভাইয়েরা এখন স্বাস্থ্যসচেতন। শরীরচর্চা, সুঠাম দৈহিক গড়নে মন তাদের অনেকেরই। নিয়ম মেনে জিমে যাওয়ায় বিশ্বাসী তাঁরা। তার উপর বয়স বাড়লে, ডায়াবিটিস থেকে কিডনি, হার্টের অসুখের চোখরাঙানি তো আছেই। সুস্থ থাকতেই তাই জীবন থেকে চিনি বাদ দেওয়ার প্রচার সমাজমাধ্যম জুড়ে। মিষ্টি নাকি ‘চিরশত্রু’!
তবে ভাইফোঁটায় যাাবতীয় শত্তুরের মুখে ছাই দিয়েই দিদিরা বেছে আনেন মিষ্টি। সাবেকি খাজা, গজা, রাজভোগ থেকে হাল আমলের চকোলেট ফিউশন, আতা, আম, ব্লুবেরির স্বাদের সন্দেশ। ক্যালোরির হিসেব-নিকেশ বাদ একটি দিনের জন্য। ভাইয়ের বয়স ১৫ হোক বা ৬০— এই দিনটিতে ছাড় সব নিয়মে। বোনেরা রকমারি মিষ্টিতে থালা না সাজিয়ে দিলে যে ভাইফোঁটা হবেই না! এটাই তো ঐতিহ্য!
কিন্তু থালা ভরবে কোন মিষ্টিতে? সাবেক মিষ্টির পাশাপাশি এখন আর শুধু স্বাদ নয়, সে মিষ্টি কেমন দেখতে, কতটা মনোগ্রাহী, তার উপরও পছন্দ নির্ভর করে, বলছিলেন কলকাতার একটি প্রসিদ্ধ মিষ্টি দোকানের কর্তা। পছন্দ সময়, বদলাচ্ছে পছন্দও। স্বাদে বৈচিত্র আনতে তাই নিত্যনতুন মিষ্টির সম্ভার আসছে। সাবেক মিষ্টিই বদলাচ্ছে রকমারি নতুন ফ্লেভারে, নতুন উপকরণে।
সীতাফল সন্দেশ, কাজু আঞ্জির বোট, কাজু আনারকলি, কেশরচমচম, জলভরা সন্দেশ। ছবি: বলরাম মল্লিক ও রাধারমণ মল্লিক
কলকাতার বুকেই রয়েছে শতাধিক পুরনো সব মিষ্টির দোকান। তার মধ্যে কোনও কোনও দোকান ঝাঁ-চকচকে হয়েছে, তৈরি হয়েছে নতুন শাখা, কোনওটি আবার পুরনো কলেবরেই একচেটিয়া ব্যবসা করছে। তবে মিষ্টির স্বাদের জন্যই এখনও দূর থেকে লোকজন আসেন বিশেষ দোকানের নির্দিষ্ট মিষ্টির স্বাদ পেতে।
ভবানীপুরের বলরাম মল্লিক ও রাধারমণ মল্লিকের দোকানের বয়স প্রায় ১৪০ ছুঁতে চলেছে। সংস্থার কর্ণধার সুদীপ মল্লিক বললেন, ‘‘এই দিনটিতেই ভাইফোঁটা স্পেশ্যাল খাজা বিক্রি হয় শয়ে শয়ে। অথচ উৎসব মিটলেই সেই খাজার বিক্রি থাকে না। আসলে এখনও অনেকে চিরকালীন ‘ভাইফোঁটা’ লেখা সন্দেশ, খাজায় ভরসা রাখেন। দিলখুশ, পারিজাত, সরের রোল, স্বরলিপি সন্দেশ, সরভাজা তো আছেই।’’ ভাইফোঁটা উপলক্ষে এই দোকানে থাকছে কস্তুরী শঙ্খ। বেশ বড় আকারের সন্দেশের পেটের ভিতর লাড্ডু ভরে দেওয়া হচ্ছে। ফলে এক কামড়েই মিলবে দুই স্বাদ। আর থাকছে ক্যাডমিশ, হৃদয় আকারের মিষ্টির উপরে নলেন গুড় এবং চকোলেটের আস্তরণ থাকবে, ভিতরে সন্দেশ। চিরচেনা অমৃতিও থাকছে অন্য রূপে, নাম অমৃত লুকস। উপরে থাকবে সাদা চকোলেটের আস্তরণ।
জলভরা, আঞ্জির সন্দেশ-সহ রকমারি মিষ্টি। ছবি: গিরিশচন্দ্র দে অ্যান্ড নকুড়চন্দ্র নন্দী
হেদুয়ার নকুড়ের সন্দেশের জনপ্রিয়তা কম নয়। দোকানের নাম ‘গিরিশচন্দ্র দে অ্যান্ড নকুড়চন্দ্র নন্দী’। বয়সেও প্রাচীন। রকমারি সন্দেশ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন তাঁরাও। তারই ফল, এ বার আঞ্জির মিষ্টি। স্বাস্থ্যসচেতনদের অনেকেই আঞ্জির খান। জিনিসটি একটি বিশেষ ধরনের শুকনো ডুমুর। খেতে হালকা মিষ্টি। সেই আঞ্জির, মধু এবং বাদামের পুর দিয়ে তৈরি হয়েছে বিশেষ সন্দেশটি। দোকানের কর্ণধার পার্থ নন্দী জানালেন, তাঁদের কুলফি সন্দেশটি এ বার আসছে নতুন স্বাদে। আম, ব্লুবেরি, স্ট্রবেরি— তিন ধরনের ফ্লেভার মিলবে। এ ছাড়া গুড়ের জলভরা, গোলাপি পেঁড়া, লেবু সন্দেশ, চন্দ্রপুলি, মৌসুমি তো আছেই। তবে ভাইফোঁটায় লোকজন বাদাম, ক্ষীর দেওয়া রকমারি মিষ্টি শিঙাড়াও নিয়ে যান।
সাবেক, নতুন— রকমারি মিষ্টির সম্ভার থাকছে। ছবি: কেসি দাস
মধ্য কলকাতায় ধর্মতলার মুখেই ‘কেসি দাস’। এই দোকানের খ্যাতি স্পঞ্জের মতো নরম সাদা ধবধবে রসগোল্লার জন্য। দীপাবলি, ভাইফোঁটায়, কৌটোবন্দি রসগোল্লা দেশ-বিদেশে পাড়ি দেয়, তবে এ বার সংযোজন কালোজাম, গোলাপজামও, বলছিলেন দোকানেরই এক কর্মী অতনু ভট্টাচার্য। বছরভরই নতুন মিষ্টি তৈরি করে সংস্থাটি। ভাইফোঁটায় থাকছে প্রভুভোগ। রাজভোগের আকারের মিষ্টিটি খেতে হবে চমচমের মতো, উপরে থাকবে ক্ষীরের আস্তরণ। এ ছাড়া ডাব সন্দেশ, ত্রিনয়নী, শুভদীপ, আবার খাবো, গজা, খাজা, পেঁড়া— রকমারি মিষ্টি থাকছেই।
সীতাফল সন্দেশ, কেশর মিলকোজ়, ম্যাঙ্গো সন্দেশ থাকছে অনেক কিছুই। ছবি: নলিনচন্দ্র দাস অ্যান্ড সন্স
কলকাতার বুকে বহু পুরনো মিষ্টির দোকান ‘নলিনচন্দ্র দাস অ্যান্ড সন্স’। চার পুরুষের ব্যবসা তাঁদের। দোকানের বর্তমান প্রজন্মের প্রতিনিধি তপনকুমার দাস বললেন, ‘‘এই বছর থাকছে সীতাফল সন্দেশ। আতার শাঁস আর ছানা দিয়ে তৈরি সন্দেশ। বাইরে থেকে আতার মতো আকার দেওয়া হয়েছে। আর থাকছে কেশর-মিলকোজ়। বাদাম, কেশর দিয়ে তৈরি, চতুষ্কোণ সন্দেশটি হলদেটে রঙের।’’ এই দোকানের খ্যাতি সন্দেশ এবং চকোলেট ফিউশন মিষ্টির জন্যই। স্প্যানিশ টিকি-টাকা, চকো ডিলাইট— রকমারি রকম ফিউশন মিষ্টি থাকছে এই বছরেও।
মেসি সন্দেশ, সহচরী, রোজ়ি, বেকড রসগোল্লা রকমারি মিষ্টির আয়োজন রয়েছে। ছবি: ফেলুমোদক।
কলকাতার বাইরে হুগলির আর এক পুরনো মিষ্টি বিক্রেতা ফেলু মোদক। ভাইফোঁটা উপলক্ষে চমক থাকে প্রতি বছর। এ বার ফুটবলপ্রেমী ভাইদের জন্য আনা হয়েছে মেসি সন্দেশ, বললেন কর্ণধার অমিত দে। ১৩ ডিসেম্বর কলকাতায় আসার কথা আর্জেন্টিনার ফুটবলার লিয়োনেল মেসির। মেসির ভক্তদের জন্যই মেসির জার্সির রং এবং নম্বর দিয়ে তৈরি হয়েছে সন্দেশ। নীল রঙের জন্য ব্যবহার হয়েছে অপরাজিতা ফুল। ভাইফোঁটা উপলক্ষে তৈরি খাজাতেও বৈচিত্র এনেছেন তাঁরা। রাবড়িতেও মিলবে নতুন স্বাদ। কেশর, কাঠবাদামের যুগলবন্দি থাকবে তাতে।
সাবেকি না কি ফিউশন
ভাইফোঁটার মিষ্টিতে সাবেক বং ফিউশনের যুগলবন্দিতেই ভরসা রাখছেন দিদি-বোনেরা, বলছেন কলকাতার মিষ্টান্ন বিক্রেতারা। সেই কারণে একাধিক মিষ্টির দোকানে ভাইয়ের জন্য ৭টি বা ১১টি মিষ্টি এবং তার সঙ্গে নোনতা খাবার দিয়ে থালা সাজিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কেউ বিক্রি করছেন মেলামাইনের থালায়, কেউ আবার মাটির থালায়। কোনও কোনও দোকান আবার ক্রেতার পছন্দমতোই পুরো থালা সাজিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত রাখছে। স্বাস্থ্যসচেতনতা নিয়ে হইচই হলেও, বিশেষ দিনটিতে যে মিষ্টি কেনায় খামতি থাকে না, জানাচ্ছেন বিক্রেতারাই। বরং তাঁদের পর্যবেক্ষণ, এই দিনগুলিতে ‘সুগার ফ্রি’ বা ডায়াবেটিকদের জন্য তৈরি বিশেষ মিষ্টির চাহিদা তুলনামূলক ভাবে কম। কেউ কেউ জানাচ্ছেন, স্বাদ বদলাচ্ছে ক্রেতাদের। চড়া মিষ্টির বদলে হালকা স্বাদের মিষ্টিই পছন্দ করছেন লোকে। সেই মতো মিষ্টিতেও বদল আসছে।