নজিরবিহীন দাম সোনা-রূপোর। তবু ধনতেরস। এমন দিনে সোনার গয়না কেনার ইচ্ছা, অভ্যাস অনেকেরই থাকে। অনেকের বিশ্বাস, ধনতেরসের দিন সোনা কিনলে ধনদেবী লক্ষ্মীর আশীর্বাদ পাওয়া যায়। ঘরে সমৃদ্ধি আনতে তাই অনেকেই গয়না কেনেন। অনেকে মনে করেন, ওই দিন সোনা-রূপো কিনলে বাড়ির শ্রীবৃদ্ধি হবে। সোনার দাম সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে দিক থেকে দেখলে, সোনায় বিনিয়োগ করা সব সময়েই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই ভবিষ্যতের কথা ভেবে ধনতেরসের দিন সোনায় বিনিয়োগ করাই যায়। তা ছাড়া, সোনার গয়না কিনতে হলে ধনতেরসের দিনটি বেছে নেওয়া আরও একটি কারণে লাভজনক। ওই দিন বিভিন্ন দোকানে সোনার গয়নার মজুরির উপর বড় অঙ্কের ছাড় দেওয়া হয়। তাই ওই দিন গয়না কিনলে খরচ অনেকটাই কম পড়ে। তাই বছরের আর পাঁচটা দিনের থেকে এই দিনটায় সাধারণত সোনার দোকানগুলির বাইরে চোখে পড়ে উপচে পড়া ভিড়। এ বছর উৎসবের মরসুমে কেমন গয়না কেনার চল বেশি? চড়া দামকে উপেক্ষা করেও কি কেনাকাটায় মন দিতে পেরেছে মানুষ? কী বলছে এ বছর গয়নার বাজারের ট্রেন্ড?
গত বছর ধনতেরসের দিন কলকাতায় হলমার্ক সোনার গয়নার (২২ ক্যারাট) দাম ছিল ৭৫,১০০ টাকা। এ বছর সেই সোনার দাম বেড়ে হয়েছে ১,২৫, ১০০ টাকা। গত এক বছরে সোনার দাম বেড়েছে প্রায় ৫০ হাজার টাকা। আর গত এক সপ্তাহে হলমার্ক সোনার গয়নার দাম বেড়েছে প্রায় ১১,০০০ টাকা। আমেরিকার নয়া শুল্কনীতির অনেকটাই প্রভাব পড়েছে দেশের গয়নার বাজারে। স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের মতে, ভবিষ্যতে আরও বাড়বে সোনার দাম। দাম কম হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। এই পরিস্থিতিতে এ বছরের ধনতেরসের বিক্রিবাট্টা নিয়ে বেশ সংশয় দানা বেঁধেছিল ব্যবসায়ীদের মনে। পশ্চিমবঙ্গের স্বর্ণশিল্পী বাঁচাও কমিটির সভাপতি বাবলু দে বলেন, ‘‘গত এক সপ্তাহে বাজারে এক উল্টো ছবি চোখে পড়েছে। মাঝে হালকা সোনার গয়নার প্রতি মানুষের ঝোঁক বাড়লেও, সোনার দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু ক্রেতারা এ বার ভারী গয়না কেনার বিষয় বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এ বছর ধনতেরসের আগে এই প্রবণতা আরও বেড়েছে। বেশির ভাগ মানুষ ভারী গয়না কিনছেন বিনিয়োগের কথা ভেবে। সোনার দাম কমবে না, বরং দিন দিন আরও বাড়বে। তাই গয়নাগাটি কেনার এটাই সেরা সময়। বর্তমানে লগ্নির অন্যান্য বিকল্পগুলির তুলনায় সোনায় মুনাফা অনেক বেশি।’’
গয়নার দাম যেমন বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে গয়না পিছু মজুরির খরচও। ছবি: শাটারস্টক।
ট্রেন্ড বলছে হালকা নয়, এ বছর আবার ভারী গয়না কেনাকাটার প্রবণতা বেড়েছে গ্রাহকদের মধ্যে। হাতিবাগানের সেন ব্রাদার্সের কর্ণধার অতীন দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘কেবল বিত্তশালীরা নয়, এখন কিন্তু মধ্যবিত্ত গ্রাহকেরাও চেষ্টা করছেন ভারী গয়না কিনতে। ধনতেরসের দিন কিনবেন বলে ভারী গয়নার খোঁজ করতে দোকানে এসেছেন অনেকেই। ব্যাঙ্কে ৭ শতাংশ বার্ষিক সুদে টাকা দ্বিগুণ হতে সময় লাগে ১৪ বছরের বেশি। অথচ সোনার দাম গত দু’বছরেই প্রায় দ্বিগুণ হারে বেড়েছে। ধনতেরসের দিন মজুরির উপর নানা রকম ছাড় থাকে, সঙ্গে থাকে বিভিন্ন উপহারও। তাই আশা করছি, এ বছর ধনতেরসের বাজার আগের বছরের তুলনায় বেশি ভাল হবে।’’
গয়নার দাম যেমন বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে গয়না পিছু মজুরির খরচও। যত ভারী গয়না, তার মজুরি তত বেশি। সেনকো গোল্ড অ্যান্ড ডায়মন্ডের কর্মচারী সুমি মণ্ডল বলেন, ‘‘ধনতেরসের সময় ক্রেতাদের দু’ভাগে ভাগ করা যেতেই পারে। এক দল আসেন পছন্দসই গয়না কিনতে। আর এক দল আসেন বিনিয়োগের কথা ভেবে। তাঁরা গয়নার নকশা নিয়ে বেশি মাথা ঘামান না। এমন গয়নার খোঁজ করেন, যেগুলির মজুরি কম। অর্থাৎ ভবিষ্যতে লাভ হবে আরও বেশি।’’
গয়না কেনাও হবে অথচ বেশি মজুরিও দিতে হবে না, এমন কী কী রাখা যায় পছন্দের তালিকায়?
মেশিনে তৈরি চেন: বিনিয়োগের কথা ভেবে সোনা কিনতে হলে সবচেয়ে ভাল বিকল্প হল সোনার চেন। অন্যান্য গয়নার তুলনায় চেনের উপর মজুরি তুলনায় কম থাকে। মেশিনে তৈরি করা চেন হলে মজুরি হয় আরও কম। পাঁচ গ্রামেও এখন আপনি চেন পেয়ে যাবেন। চেনের উপর মোটামুটি ৬-৮ শতাংশ মজুরি চাপানো হয়। ৫ গ্রামের কাছাকাছি কোনও চেন কিনতে হলে দাম পড়বে প্রায় ৭৫,০০০ টাকার মতো। একটু ভারী কিনতে চাইলে, ৩০ গ্রামের চেনের দাম পড়বে ৪,০০,০০০ টাকার কাছাকাছি।
বিনিয়োগের কথা ভেবে সোনা কিনতে হলে সবচেয়ে ভাল বিকল্প হল সোনার চেন। ছবি: শাটারস্টক।
চুড়ি: কিনতে পারেন চুড়িও। মজুরি কম দিতে চাইলে খুব বেশি নকশাদার চুড়ির খোঁজ করলে হবে না। মোটামুটি ১২-১৫ গ্রামের মধ্যে সলিড চুড়ি পেয়ে যাবেন। দাম পড়বে প্রায় ১,৭৫,০০০ টাকা থেকে ২,০০,০০০ টাকার মধ্যে।
হাঁসুলি: পুরনো দিনের গয়নার নকশা কিন্তু আবার বাজারে রমরমিয়ে চলছে। তেমনই সাধারণ নেকলেসের তুলনায় হাঁসুলির কদর আবার বাড়ছে। এ বছর ধনতেরসে পছন্দের তালিকায় রাখতে পারেন হাঁসুলিও। তবে খুব বেশি কারুকাজের নকশা চাইলে মজুরি বেশি পড়বে, তাই হালকা নকশার হাঁসুলি কিনে ফেলতেই পারেন। মোটামুটি ২৫ থেকে ৩০ গ্রামের মধ্যে ভাল হাঁসুলি পেয়ে যাবেন। দাম পড়বে ৩,২৫,০০০ টাকা থেকে ৪,০০,০০০ টাকার মধ্যে।
ব্রেসলেট: কম মজুরিতে গয়না কিনতে চাইলে ব্রেসলেটও দেখতে পারেন। মোটামুটি ৮ গ্রাম থেকে পুরুষ ও মহিলা, উভয়ের জন্য পছন্দসই ব্রেসলেট পেয়ে যাবেন। মজুরিতে ছাড় চাইলে খুব বেশি নকশাদার ব্রেসলেট না কেনাই ভাল। একটু ভারী গয়না নিতে চাইলে ১৫-১০ গ্রামের মধ্যেও দেখতে পারেন। দাম পড়বে ২,০০,০০০ থেকে ২,৫০,০০০ টাকার মধ্যে।
আংটি: কোনও রকম পাথর, রত্ন, হিরে ছাড়া সলিড আংটিও কিন্তু এ ক্ষেত্রে ভাল বিকল্প হতে পারে। তাই ধনতেরাসে আংটিও কিনতে পারেন। ভারী ওজনের সলিড আংটি মোটামুটি ১০ গ্রামের মধ্যে পেয়ে যাবেন। দাম পড়বে ২,৫০,০০ টাকার কাছাকাছি।
সোনার চড়া দামের বাজারে পুরনো গয়না ভেঙে নতুন গয়না তৈরি করাচ্ছেন বহু মানুষ। গয়না ব্যবসায়ীদের অভিজ্ঞতা অন্তত তেমনই। তাঁরা জানাচ্ছেন, অনেকে নতুন সোনার সঙ্গে পুরনো সোনা মিশিয়েও গয়না বানাচ্ছেন। যাঁর যেমন আর্থিক অবস্থা। মোটের উপর, গয়না গড়তে পুরনো সোনার ব্যবহার আগের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। পুরনো গয়না বিক্রি করে নতুন গয়না বানাতে চাইলে, এখন সেরা সময় বলে মনে করছেন স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া ধনতেরসে বিভিন্ন সোনার দোকানে বিভিন্ন রকম ছাড় দেওয়া হয়। কোথায় গেলে লাভ বেশি হবে, তুলনা করতে ভুলবেন না যেন। শখের গয়না কেনাই হোক বা বিনিয়োগের তাগিদে— দু’পয়সা বাঁচলে কার না ভাল লাগে!