টলিপাড়ায় চার দিনব্যাপী বিবাহ অনুষ্ঠান। খড়দহে আনুষ্ঠানিক বিয়ের পর ধনধান্য অডিটোরিয়ামে রিসেপশনে যেন চাঁদের হাট। একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা! শুক্রবার রাতে রিসেপশনে তাই আয়োজনে কোনও খামতি রাখেননি অভিনেতা খরাজ মুখোপাধ্যায়। চার দশক ধরে টলিউডের ইন্ডাস্ট্রির সদস্য তিনি। খরাজের ছেলের বিয়েতে যে বাংলার যশস্বীদের ভিড় হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বাঙালি বিয়ের অনুষ্ঠান ঠিক কেমন হওয়া উচিত, তারই যেন নিদর্শন রাখলেন খরাজ। অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে সঙ্গীতশিল্পী, রাজনীতিবিদ— সকলেই বিহু ওরফে তমোঘ্ন মুখোপাধ্যায়ের বিয়ের প্রীতিভোজ উপলক্ষে উপস্থিত হয়েছেন। ব্যস্ততার ফাঁকে নতুন বর-কনে বিহু-রোজাকে কেবল আশীর্বাদ করতেও হাজিরা দিলেন কেউ কেউ।
আগেকার দিনে বাঙালির বিয়েতে আপ্যায়নের ত্রুটি থাকত না। নিমন্ত্রিতদের অভ্যর্থনা জানাতে খোদ বরকর্তা বা বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠরা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। খাওয়ার সময়ে টেবিলে টেবিলে ঘুরে ঘুরে বলে আসতেন, ‘‘লজ্জা করে খাবেন না কিন্তু’’। সেখান থেকে ধীরে ধীরে নিয়মরীতির প্রবর্তন ঘটতে দেখা গিয়েছে বিবাহ অনুষ্ঠানে। সদর দরজায় বাড়ির কেউ থাকুন না থাকুন, অচেনা ব্যক্তিরা ফুল হাতে ধরিয়ে একগাল হেসে অভ্যর্থনা জানান। খাবারের জায়গায় বাড়ির সদস্যদের দেখা মেলা ভার। কিন্তু খরাজ সেই প্রাচীন ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। তার প্রমাণ মিলল ব্যাঙ্কোয়েটের প্রবেশপথেই। একটানা দরজার বাইরে বসে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাতে দেখা গিয়েছে অভিনেতাকে। একেবারে অনুষ্ঠানের শেষে ছবি তুলতে আসরে হাজির হন তিনি।
বর ও কনে তাঁদের রিসেপশনের সাজে রংমিলন্তির ছোঁয়া রেখেছিলেন। শেরওয়ানি-পাজামা এবং বেনারসির রঙে ছিল সবুজের ছোঁয়া। রোজার শাড়ি যদি হয় মস গ্রিন, তা হলে বিহুর পোশাকের রংও সবজেটে ছাই রং। রোজার গলা, কান, হাত, আঙুল ছিল সোনার গয়নায় ভরা। কোমরে গুঁজে রাখা রুপোর গয়না, অনেকটা যেন চাবির থোকার মতো।
খরাজের পরনে ছিল অফ-হোয়াইট নকশা করা ঐতিহ্যবাহী তসরের পাঞ্জাবি এবং কোঁচানো কোরা ধুতি। অভিনেতার সাজসজ্জার নেপথ্যে ছিলেন কলকাতার পোশাকশিল্পী অভিষেক রায়। খরাজ-পত্নী প্রতিভা মুখোপাধ্যায় সেজেছিলেন সোনালি বুটির কাজ করা কালো সিল্কের শাড়িতে।
অসংখ্য কাজের চাপের মাঝেও খরাজের ছেলে বিহু এবং তাঁর স্ত্রী রোজার রিসেপশনে হাজিরা দিতে ধনধান্যে পৌঁছোন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু।
গাঢ় নীল পাঞ্জাবিতে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় এবং রুপোলি চওড়া পাড়ের কালো বেনারসিতে চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়কেও দেখা যায় খরাজপুত্রের রিসেপশনে। বাঙালি বিয়ের চিরাচরিত সাজে দেখা দিয়েছিলেন টলিপাড়ার তারকাদম্পতি। প্রযোজকদ্বয় নন্দিতা রায় এবং শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও হাজির হন অনুষ্ঠানে। নন্দিতার পরনে ছাইরঙা শাড়ি। শিবপ্রসাদ পরেছিলেন কালো টিশার্ট-সবূজ ব্লেজার। পাতা পাতা ছাপ আঁকা কালো শাড়িতে অনসূয়া মজুমদারও সাংবাদিকদের ফ্রেমবন্দি হন।
সবুজ ব্লাউজ়, লাল বেনারসি এবং ভারী গয়নায় সকলের নজর কেড়েছিলেন অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। অন্য দিকে, নতুন ছবির প্রিমিয়ার সেরে উপস্থিত হয়েছিলেন দেব এবং রুক্মিণী মৈত্র। তাঁদের কালো শেরওয়ানি এবং ফুলছাপ অফ-শোল্ডার গাউন সকলের সাজের মধ্যে বিশেষ ভাবে নজর কেড়েছিল। স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় আড্ডার মেজাজে অনুষ্ঠানে প্রবেশ করেন। টেকনিশিয়ান স্টুডিয়োর প্রধান এবং ফেডারেশন অফ ডাব্লিউবি ফিল্ম অপারেটিভের সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাসের সাজে ছিল সাদা শার্টের উপর সুতোর কাজ করা পাখির ছোট ছোট প্রতিকৃতি। লাল-কালো বেনারসিতে বিয়ের আসরে পৌঁছোন মৌসুমী সাহা। হইহুল্লোড়ের মেজাজে ধরা দিলেন শ্রীময়ী চট্টরাজ এবং কাঞ্চন মল্লিক। গাঢ় নীলচে সবুজ রঙের বেনারসিতে অভিনেত্রী নজরকাড়া। অভিনেতার পরনে গাঢ় নীল গলাবন্ধ শেরওয়ানি।
এই অনুষ্ঠান যেন ইন্ডাস্ট্রির পুরনো শিল্পীদের পুনর্মিলন উৎসব। এক দিকে বোধিসত্ত্ব মজুমদার, সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়, অন্য দিকে রঞ্জিত মল্লিক, দীপঙ্কর দে, চিরঞ্জিত চক্রবর্তী, কুশল চক্রবর্তী, স্বাগতা এবং ঋষি মুখোপাধ্যায়।
অভিনেতা-সঙ্গীতশিল্পী বিহুর বিশেষ দিনে অভিনন্দন জানাতে অনুষ্ঠানে হাজির হন গানের জগতের খ্যাতনামী ব্যক্তিরাও। মনোময় ভট্টাচার্য, শ্রীকান্ত আচার্য, রাঘব চট্টোপাধ্যায়, রূপম ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী রূপসা দাশগুপ্ত, স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে রূপঙ্কর বাগচী, প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো তারকারা। কেউ আড্ডায় মজেছিলেন, কেউ বা ছবি তোলায়।
অতিথিদের জন্য গরম গরম কড়াইশুঁটির কচুরি, ছোলার ডাল, ফিশ ফ্রাই, বাসন্তি পোলাও, গন্ধরাজ ভেটকি, মটন কষার এলাহি আয়োজন করেছিলেন খরাজ এবং প্রতিভা। শেষপাতে মিষ্টিমুখের জন্য রাখা ছিল চাটনি, পাঁপড়, নলেন গুড়ের সন্দেশ, রাবড়ি-জিলিপি এবং কুলফি।