Advertisement
০৩ মে ২০২৪
Patuli Jhil Park

কলরবের কলকাতায় আছে নিরিবিলি আড্ডার ঠিকানা, আছে ‘ভাল থাকার পাসওয়ার্ড’ও, যাবেন কী ভাবে?

শহরের অলিগলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা রেস্তরাঁ আর ক্যাফের ভিড়ে আড্ডা আর প্রেমের নতুন ঠিকানা পাটুলি ঝিলপাড়। সেখানেই আছে ‘ভাল থাকার পাসওয়ার্ড’। কেমন সেই জায়গা? ঘুরে দেখল আনন্দবাজার অনলাইন।

image of patuli.

কলকাতায় দু’দণ্ড সময় কাটানোর নতুন ঠিকানা। নিজস্ব চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০২৩ ১৪:৩২
Share: Save:

সিনেমা-থিয়েটার দেখা অথবা ক্যাফে-রেস্তরাঁয় খাওয়াদাওয়া— শহরবাসীর বিনোদন খানিকটা গতে বাঁধা রুটিনেই সীমাবদ্ধ। দু’দণ্ড বসে গল্প করার জায়গার বড়ই অভাব বলে অভিযোগ শোনা যায় অলিগলিতে। সেই আক্ষেপ বোধ হয় কিছুটা হলেও দূর করতে পারে পাটুলি ঝিলপাড়। সেখানেই এখন ফুচকা-মোমো সহযোগে বসছে তরুণ-তরুণীদের আড্ডা। আছে ‘ভাল থাকার পাসওয়ার্ড’।ঝিলের ধারের একটি রাস্তা ঘিরেই এখন সেখানে বেড়েছে সকলের যাতায়াত। দু’পাশে সিমেন্ট বাঁধানো গাছের সারি। কোনও এক বিকেলে সেখানে পৌঁছলে দেখা যাবে, প্রায় প্রতিটি গাছের নীচেই লেখা হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন প্রেমের গল্প। কারও মান-অভিমানের পালা চলছে। কেউ আবার প্রেমিকার পছন্দের আইসক্রিম কিনতে ব্যস্ত। রয়েছে একটি শিশু উদ্যানও।

পাটুলির ঝিলপাড়ে সাজানো নিরিবিলি আড্ডার জায়গাটির উল্টো দিকেই একটি সরু রাস্তা। আড্ডার রসদ জোগাতে সেখানেই তৈরি হয়েছে রকমারি খাবারের ছোট-বড় দোকান। মোমো থেকে মোগলাই, সবের ঠিকানা। ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম এমনই বেড়েছে যে, সে রাস্তা এখন আলাদা করে পরিচিত শহরের দক্ষিণ প্রান্তের অনেকের কাছেই। সেই রাস্তারই এখন নাম হয়েছে ‘ভাল থাকার পাসওয়ার্ড’। গড়িয়া সংলগ্ন এলাকা। ওয়ার্ড নং ১০১। উল্টো দিকেই পাটুলির ফ্লোটিং মার্কেট। মেট্রো করে গিয়ে নামতে হবে শহীদ ক্ষুদিরাম স্টেশনে। ঢালাই ব্রিজ ধরে দশ মিনিটের হাঁটা পথ। হাঁটতে ইচ্ছে না করলে রিকশাও আছে। পাটুলিগামী বাসও আছে কিছু। উঠে পড়া যায় তার একটিতেও।

Image of Jhil Park.

ঝিলপাড়ে যুগলদের আনাগোনা। নিজস্ব চিত্র।

পাটুলির ঝিলের ধার ধরে সাজানো জায়গাটিতে আড্ডা আর খেলাধুলায় ভরে থাকে বিকেল-সন্ধ্যা। আর ‘ভাল থাকার পাসওয়ার্ড’ হল ঝিলের অন্য পাড়ে। আসলে পাটুলি হোক কিংবা পাটায়া, বাঙালি আড্ডা দেবে আর পেটপুজো হবে না, তা কি হয়! ভুট্টা, ঘটিগরম, আইসক্রিম, ঝালমুড়ির গাড়িতে ভরে গিয়েছে ঝিলের ধারের ওই রাস্তা। সেই সঙ্গে সার দিয়ে তৈরি হয়েছে কয়েকটি খাবারের দোকান। কোনও এক সন্ধ্যায় সেখানে পৌঁছে মনে হতেই পারে, মেলা বসেছে যেন। শিশুদের খেলনা গাড়ি, পুতুলের ভ্রাম্যমাণ দোকানও চোখে পড়ল। রয়েছে চোখধাঁধানো আলোকসজ্জা। দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের ছোট সংস্করণও রয়েছে। সমাজমাধ্যমে চোখ রাখলে দেখা যাবে, জমজমাট এই রাস্তার ছবিতে ভরে গিয়েছে ফেসবুক থেকে ইনস্টাগ্রাম।

চা থেকে শুরু করে রুহ্ আফজ়া— রসনা তৃপ্তির সমস্ত ব্যবস্থাই রয়েছে। আছে ‘ওয়াটার এটিএম’। সাধারণ জল ১৩ টাকা, ঠান্ডা জল ১৪ টাকা। দোকানের কর্মীকে টাকা দিলে তিনি এটিএমের মতো একটি যন্ত্র থেকে বোতলে জল ভরে দেবেন। ফলে সঙ্গে করে জল নিয়ে যাওয়ার ঝক্কি নেই। পাশেই ছোট্ট দোকানে বিকোচ্ছে কবাব, ললিপপ, নরম পানীয়। রোল, চাউমিন, চাট, পকোড়া, আছে সবই। তবে ভিড়ের ঠেলায় কোনও কিছু হাতে পাওয়া কঠিন।

Image of Crowd.

নানা ধরনের খাবারের স্বাদ নিতে ব্যস্ত সকলে। নিজস্ব চিত্র।

রোল-চাউমিন বানাতে সময় লাগবে। তাই পাশের দোকানে ঢুঁ দেওয়া গেল। দোকানের নাম ‘ক‍্যাফে পজ়িটিভ’। বাকি দোকানগুলির চেয়ে ফাঁকাই বলা চলে। কফি থেকে শুরু করে স‍্যান্ডউইচ, সবই রয়েছে। হিসাবের খাতায় পেন দিয়ে খসখস করে কিছু লিখছিলেন দোকানের ম‍্যানেজার সোমনাথ সর্দার। মাস তিনেক ধরে ঝিলপাড়ের এই দোকানটির দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। তিনি জানান, ছুটির দিনগুলিতে পা ফেলার জায়গা থাকে না এখানে। সোমনাথের কথায়, ‘‘বিভিন্ন বয়সের মানুষ আসেন এখানে। দু’দণ্ড বসে থাকেন। আড্ডা দেন। মাঝেমাঝে তো এত ভিড় থাকে যে, দম ফেলার সময় পাই না। যা খাবার বানাই, সন্ধ্যার মধ্যে সব শেষ হয়ে যায়। প্রায়ই আবার নতুন করে সব বানাতে হয়।’’

সপ্তাহের ব্যস্ত দিনেই ভিড় থাকে চোখে পড়ার মতো। ছুটির দিনে বিক্রেতাদের কী অবস্থা হয়, তা কিছুটা হলেও আন্দাজ করা যায়। একটি রোলের দোকানে গিয়ে দেখা গেল মালিক তপেন্দ্র হীরার প্রায় নাস্তানাবুদ অবস্থা। অর্ডার নেবেন না টাকাপয়সা সামলাবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না। সঙ্গে অবশ‍্য স্ত্রী শুক্লা হীরা রয়েছেন। কিন্তু তিনিও খাবারের উপকরণ তৈরিতে ব‍্যস্ত। দু’জন কর্মীও আছেন। তা সত্ত্বেও হিমশিম খাচ্ছেন সকলে। ঘাম মুছতে মুছতে দোকানের মালিক তপেন্দ্র বলেন, ‘‘আড়াই মাস হল এখানে আমরা দোকান খুলেছি। আমি আর আমার স্ত্রী মিলেই পুরোটা দেখাশোনা করি। ব‍্যবসা ভালই হচ্ছে। কয়েক দিনে লাভের মুখও দেখেছি। আরও অনেক নতুন খাবার রাখার পরিকল্পনা আছে।’’

image of Food Street.

অর্ডার দেওয়া সারা, খাবারের অপেক্ষায় ক্রেতারা। নিজস্ব চিত্র।

খাবার কি সব অসাধারণ স্বাদের? না হলে এত ভিড় কেন? রোলে কামড় বসাতেই বোঝা গেল, স্বাদ তেমন আহামরি নয়। তবু সান্ধ‍্যভোজনের জন‍্য ঠিক আছে। দামও বেশি নয়। মিউজিক্যাল চেয়ার খেলার মতো তক্কে তক্কে থেকে একটা বেঞ্চ দখল করে এক বার বসে পড়তে পারলে মোমো, শিক কবাব না হোক, ঝালমুড়ি অথবা ভুট্টা চিবোতে চিবোতে বহু ক্ষণ কাটিয়ে দেওয়া যায়। এমন সুলভে সময় কাটানোর জায়গা তো কমে আসছে মহানগরে। শহরের বুকে গজিয়ে ওঠা এই জায়গাটির জনপ্রিয়তার কারণ বোধ হয় এটাই।

বহু ক্ষণ হাঁটাহাঁটি হয়ে গিয়েছে। খাবারের দোকানগুলির সামনের একটি বেঞ্চে অল্প জায়গা পেয়ে বসা গেল। বেঞ্চে পাশে বসে আরও দু’জন। বোঝা গেল, সম্পর্কে তাঁরা দাদু আর নাতি। নরম পানীয় চেয়ে বায়না ধরেছে শিশুটি। আর দাদু তা কিছুতেই কিনে দেবেন না। কথায় কথায় আলাপ জমতে জানা গেল, ভদ্রলোকের নাম প্রদ্যুম্ন গঙ্গোপাধ্যয়। নাকতলায় থাকেন। তিনি বলেন, ‘‘ছেলে-বৌমা দু’জনেরই অফিস থেকে ফিরতে দেরি হয়। তাই নাতিকে নিয়ে বিকেলবেলায় প্রায় দিনই এখানে চলে আসি। বসে থাকি। লোকজন দেখি। দাদু আর নাতি মিলে মাঝেমাঝেই রোল, মোমো কিনে খাই। অপরিচিত অনেকের সঙ্গেই আলাপ হয়। সময়টা বেশ কেটে যায়।’’

সন্ধ‍্যা যত ঘন হচ্ছিল, ভিড় তত বাড়তে থাকল। দাদু-নাতিদের মুখ বদলে নানা বয়সের যুগলের দেখা মিলতে থাকল। বাবা-মায়ের হাত ধরে শিশুরাও ভিড় জমাল নানা দোকানে। শোনা গেল, রাত ১২টা পর্যন্ত মাঝেমধ্যে ভিড় থাকে কোনও কোনও দোকানে। সপ্তাহান্তে ‘ভাল থাকার পাসওয়ার্ড’-এ তাই পা ফেলায় কঠিন হয়ে যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Patuli Kolkata Hangout
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE