মাস দুই হল দক্ষিণ কলকাতার একটি ক্যাফেতে কাজ শুরু করেছেন পম্পিতা সরকার। বয়স ৩৭। স্থায়ী চাকরি এই প্রথম। এর আগে আয়ার কাজ করেছেন কয়েকটি বাড়িতে। কিন্তু তাঁর বাড়ির বড়দের তেমন পছন্দ ছিল না। ৪০-এ পৌঁছোনোর আগে স্থায়ী কাজ চাইছিলেন। শেষে হিন্দুস্থান পার্কের এক ক্যাফেতে টেবিলে টেবিলে খাবার পৌঁছে দেওয়া, খাবারের অর্ডার নেওয়ার কাজ পেয়েছেন। আয়ার চাকরির থেকে রোজগার বেশি। সম্মানও বেশি বলে মনে করেন বাড়ির লোকজন। তবে কর্মজীবন যখন শুরু করেন, তখন মেয়েদের জন্য এ ধরনের কাজ ছিল না। তাই যখন যেমন কাজ পেতেন, তেমনই করতেন।
পম্পিতা যে কাজ নিয়েছেন এখন, তা হল ‘ওয়েট স্টাফ’-এর দায়িত্ব। এ কাজ করেন যাঁরা, ইংরেজিতে তাঁদের বলা হয় ‘ওয়েটার’, মেয়েদের ক্ষেত্রে ‘ওয়েট্রেস’। বাংলা সাহিত্য-সিনেমায় হোটেল-রেস্তরাঁয় এমন কাজের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিকে ‘বেয়ারা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে বহু সময়ে। মহিলাকর্মীদের ক্ষেত্রে কী বলে ডাকা হবে, তার জন্য প্রচলিত কোনও শব্দ বিশেষ ব্যবহার করা হতে দেখা যায়নি। কারণ, এমন কাজে বহু দিন প্রর্যন্তই মেয়েদের দেখতে অভ্যস্ত ছিল না বঙ্গ সমাজ।

৩৭ বছরের পম্পিতার চাকরিজীবন শুরু হয়েছে হিন্দুস্থান পার্কের ক্যাফেতে। ছবি: নিজস্ব।
বহু কাল পর্যন্ত কলকাতা ও আশপাশের এলাকাগুলি একই রকম ছিল। হোটেল-রেস্তরাঁয় খাবার পরিবেশন করতেন পুরুষরাই। বাংলায় ছবিটা বদলাতে শুরু করেছে গত কয়েক বছরে। কলকাতা শহর শুধু নয়,বিভিন্ন জেলাতেও এ ধরনের কাজে মহিলাকর্মীর সংখ্যা বাড়ছে চোখে পড়ার মতো। পাড়ায় পাড়ায় ক্যাফে যত তৈরি হচ্ছে, তার সঙ্গে এই বদলের যোগ আছে বলেও মনে করছেন অনেকে।
আগে দার্জিলিং-কালিম্পঙে বেড়াতে গিয়ে মহিলাদের ক্যাফে-রেস্তরাঁয় খাবার দিতে দেখেছেন হয়তো বহু বাঙালি, কিন্তু কলকাতা শহর ও পার্শ্ববর্তী জেলাগুলিতে তেমন বিশেষ চোখে পড়ত না। এখন ক্যাফে সংস্কৃতি যত জোরদার হচ্ছে শহর জুড়ে, খাবার পরিবেশন করার কাজে যেন তত বেশি দেখা যাচ্ছে নারীদের। পুরনো কিছু রেস্তরাঁয় যে মহিলা কর্মীরা খাবার দিতেন না তেমন নয়, তবে ক্যাফেগুলিতে তার প্রচলন বেড়েছে। কাজের সুযোগও বাড়ছে ক্যাফের সংখ্যাবৃদ্ধির সঙ্গে।
এত দিন অধিকাংশের ক্ষেত্রে সুরক্ষাই ছিল বাধা। সল্টলেকের ‘ক্যারাভ্যান ক্যাফে’-র কর্ণধার পায়েল সেনশর্মার কথায় জানা গেল, ২০২১ সালে যখন ক্যাফে খুলেছিলেন, তখন শুধু পুরুষদের নিয়েই কাজ শুরু হয়েছিল। রান্নাঘর থেকে রিসেপশন, সব ক্ষেত্রেই। এখন দু’জন মহিলা কর্মী রয়েছেন। আগে মেয়েদের কাজে না নেওয়ার কারণ ছিল দু’টি। পায়েল বলছেন, ‘‘আমি নিজে একজন মহিলা।এটা সব সময়েই জানি যে, মেয়েদের কাজে নিলে সুরক্ষা নিয়ে ভাবতেই হবে। কিন্তু শুরুর দিকে সব কিছু নিয়ে ভাবার অবস্থা ছিল না। আমাদের ক্যাফে রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত, এমনকি সপ্তাহান্তে রাত দুটো পর্যন্তও খোলা থাকে। মেয়েদের তো কখনওই ওই সময় পর্যন্ত কাজে রাখা উচিত নয়। এখনও যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা ৮টায় বেরিয়ে যান। ফলে এ কাজে মেয়েদের নিতে যে অন্য সব জায়গাতেই আলাদা করে ভাবতে হয়, তা বুঝতেই পারি। তবে আগে কিন্তু আমাদের এখানে অন্তত কোনও মেয়ে এই ধরনের চাকরির আবেদনই করেননি।’’ করলে হয়তো অনেক আগে থেকেই মেয়েদের কাজে রাখার কথা ভাবনাচিন্তা করতেন তিনি। পরিষেবার কাজে মেয়েদের থেকে বেশি পারদর্শী কে-ই বা আছে, প্রশ্ন তোলেন পায়েল। জানান, এর পরে আরও মেয়েকে ক্যাফেতে নেওয়ার ইচ্ছে আছে তাঁদের। তবে রাতের শিফ্টে এখনও পুরুষ কর্মীদেরই রাখেন।
দক্ষিণ কলকাতার হিন্দুস্তান পার্ক এলাকায় মুখোমুখি দু’টি ক্যাফেতে গিয়ে দেখা গেল, মেয়েরাও খাবার পরিবেশন করছেন। তাঁদেরই এক জন হোটেল ম্যানেজমেন্টের ছাত্রী রিয়া মণ্ডল। এর আগে কলকাতার অন্য এক ক্যাফেতেও কাজ করেছেন। এখন এসেছেন ‘সিয়েনা’-এ। প্রায় দু’বছর হয়ে গেল এই পেশায়। মেদিনীপুরের মেয়ের কলকাতায় আসা এমন কাজের জন্যই।
আরও পড়ুন:
‘সিয়েনা’-র ঠিক উল্টো দিকের গলির শেষেই ‘কাপ-এ বং’ ক্যাফে। পম্পিতা কাজ করেন এখানেই। ক্যাফের মালিক অমিত হালদার জানালেন, সেখানে প্রায় ছ’মাস আগে প্রথম বার মহিলা কর্মীকে নিযুক্ত করেন কাজে। তিনি ছেড়ে দেওয়ার পর আরও দু’জনকে নেওয়া হয়। পম্পিতার যেমন এখানেই এসে জীবনের প্রথম স্থায়ী কাজ, আবার আর এক জন ছিলেন ইয়াসমিন বিবি। দিন দুই আগে অন্য জায়গায় কাজ করতে চলে যান তিনি। তবে ক্যাফেতে খাবার পরিবেশনের কাজে যোগ দেওয়ার আগে কল সেন্টারে কাজ করেছেন। আগে এই ধরনের কাজ মেয়েদের জন্য অবাঞ্ছিত ছিল।
তবে দক্ষিণ কলকাতাতেই শুধু নয়, বাংলার অন্য প্রান্তেও মহিলাদের দেখা যাচ্ছে এমন কাজে যোগ দিতে। যেমন সল্টলেকের ‘ক্যারাভান ক্যাফে’-র কথাই ধরা যাক। সেখানেও দু’জন মহিলা খাবার পরিবেশনের দায়িত্বে আছেন। আছেন শান্তিনিকেতন, কোন্নগরেও।
কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে, মোড়ে মোড়ে এখন ক্যাফের সন্ধান মিলবে। রেস্তরাঁ-বার মিলিয়ে সে সংখ্যা আরও অনেক বেশি। সেই তুলনায় হয়তো ওয়েট্রেসের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য নয়। কিন্তু শহর যে বদলাচ্ছে, তা চোখে পড়েছে অনেকেরই। কলকাতা শহরের এক কলেজের চলচ্চিত্র বিষয়ক শিক্ষক বিদিশা বিশ্বাস বলছেন, ‘‘শহরের সব ক্যাফেতে গিয়ে খাওয়াদাওয়া করি না বটে, কিন্তু তা-ও যতটুকু যাতায়াত, আগে ওয়েটিংয়ের কাজে মেয়েদের দেখেছি বলে মনেই পড়ে না। কেবল পাহাড়ে গেলে দেখতাম। তবে এখন কিছু কিছু ক্যাফেতে গিয়ে দেখতে পাই, মেয়েরা খাবার পরিবেশন করছেন। খানিক তো ছবিটা বদলাচ্ছেই।’’
বদলটা ঠিক কেন? আগে কেন নেওয়া হত না মেয়েদের? না কি মেয়েরাই আসতে চাইতেন না? প্রশ্ন তুললে উঠে আসে বহু প্রতিকূলতার কথা। কখনও বাবা-মায়ের চোখরাঙানি, কখনও আবার মালিকদের অনিচ্ছা। ‘মেয়ে আমার পুরুষদের কাজে অংশ নেবে?’ অথবা ‘বাইরের লোককে খাবার পরিবেশন করার কাজ তো ছোট কাজ, আমাদের পরিবারে মানায় না’ বা ‘মেয়েদের কাজে নিলে সন্ধ্যা নামতেই ছেড়ে দিতে হবে, নয়তো বিপদে পড়লে আমাদের দায়।’ নানা তরফে নানা ধরনের বাধা। ফলে শুধু মেয়ে বলেই এমন কাজ থেকে বাদ পড়ে গিয়েছেন কেউ কেউ।

কোন্নগরের ‘ক্যাফে কুটুম’-এ কাজ করেন রীপা বর্মণ। ছবি: নিজস্ব।
যে কারণে মেয়েদের এ কাজ নিয়ে এত কথা, তার একটি হল নিরাপত্তা। বাইরের লোক আসেন, বসেন। সকলে যে একই ভাবে ভদ্র ব্যবহার করবেন, তেমন তো নয়। মনে করালেন, হুগলির কোন্নগরের ‘ক্যাফে কুটুম’-এর কর্ণধার ইন্দ্রাণী দাশগুপ্ত। তিনি বলছেন, ‘‘মালিকপক্ষ থেকে কর্মী, আমাদের ক্যাফেতে মহিলার সংখ্যাই বেশি। শুরুর দিকে ক্যাফেটি একতলায় রাস্তার উপরে ছিল। ওয়েটিংয়ে দু’জনই মেয়ে। তাঁদের একা দেখলেই ঢুকে পড়ত উটকো লোক। কখনও কখনও রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওঁদের দিকে তাকিয়ে থাকত কেউ। তবে দোতলায় চলে আসার পর সমস্যা খানিক কমেছে।’’ তা-ও মালিকেরা বাইরে থাকলে সারা ক্ষণ সিসিটিভির দিকে নজর রাখেন, যাতে কারও উপস্থিতিতে অস্বস্তিতে না পড়েন ওয়েট্রেসরা।
নিরাপত্তার কথা উল্লেখ করেন কলকাতার গল্ফ গ্রিনের ‘ট্র্যাভেলিস্তান’-এর মালিক পারমিতা গায়েন। তিনি বলছেন, ‘‘একজন মহিলা হিসাবে আর একজন মেয়েকে কাজে নিযুক্ত করার সময়ে তাঁর সুরক্ষাই আমার প্রথম চিন্তা। কেবল কাজের জায়গায় নয়, বাড়ি ফেরার পথেও কত কিছু ঘটে যায়।’’ জানালেন, বাকিদের তুলনায় মেয়েদের একটু আগে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন তাঁরা। ফলে নিরাপত্তার চিন্তা দূর হয়নি। তবে দেখার চোখ হয়তো খানিক বদলেছে। সব কাজে যেমন এগিয়ে যাচ্ছেন মেয়েরা, অবশেষে এ কাজেও সুযোগ দিচ্ছে বাঙালি সমাজ।

‘ট্র্যাভেলিস্তান’-এ খাবার পরিবেশনের কাজ করেন শুভশ্রী আর ঝিলিক। ছবি: নিজস্ব।
কিন্তু মনে করে দেখুন তো, উত্তরবঙ্গে পাহাড়ি এলাকায় ক্যাফে বা রেস্তরাঁয় মেয়েদের অনেক বেশি দেখা যেত না কি? সে বহু বছর ধরেই তো পর্যটকদের মোমো, স্যুপ, ম্যাগি বানিয়ে পরিবেশন তাঁরা। বিদিশার মতোইপশ্চিমবঙ্গের দুই প্রান্তের ভিন্ন ছবির কথা মনে করালেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবীবিদ্যা বিভাগের প্রধান ঐশিকা চক্রবর্তী। তিনি বলছেন, ‘‘সমাজ বদলাচ্ছে, এমন দাবি করতে গেলে যত সংখ্যায় দরকার, সেটা কিন্তু হয়নি এ কাজে। কারণ এ কাজে নিরাপদ বোধ করেননি মেয়েরা। জীবিকার প্রয়োজন ঘরের গণ্ডি টপকাতে বাধ্য হচ্ছেন কেউ কেউ। শুধু ক্যাফেতে খাবার পরিবেশন নয়, অসংগঠিত কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের অংশগ্রহণ বেড়েছে, এ কথা অনস্বীকার্য। তার পরও বলতে হচ্ছে, এখনই ‘বৈপ্লবিক’ বলার স্তরে পৌঁছয়নি বিষয়টি।’’
সে তো দক্ষিণাপণের ‘ডলিজ়’-এ সেই ৮০-র দশক থেকে চা-খাবার পরিবেশন করেন শুধুই মেয়েরা। আজ প্রতিষ্ঠাতা ডলি রায় নেই বটে। আছেন অনুজেরা। চা-বুটিকটির ম্যানেজার ইন্দ্রাণী সেন বলছেন, ‘‘যে সময়ে ডলিদি এই ব্যবসার কথা ভাবেন, তখন কিন্তু শুধু পুরুষেরাই রেস্তরাঁ চালাত, মেয়েরা নয়। কিন্তু ওঁর ইচ্ছাশক্তি, আত্মবিশ্বাসের সামনে কেউ কোনও দিন দাঁড়াতে পারেনি। আমাদেরও যে শিক্ষায় শিক্ষিত করে দিয়ে গিয়েছেন, নিজে হাতে চা বানিয়ে অতিথিদের পরিবেশন করতে সম্মানের কথা ভাবতে হয়নি। আন্তরিকতা, সুন্দর ব্যবহার, আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা, যত্ন করে কাজ করা তো মেয়েদের জন্মগত বৈশিষ্ট্য। এই কাজ করার সময়ে সে কথাই মনে রাখতাম আমরা।’’

দক্ষিণাপনের ‘ডলিজ়’-এ ৮০-র দশক থেকে চা-খাবার পরিবেশন করেন শুধুই মেয়েরা। ছবি: নিজস্ব।
তবে এ কথা সত্যি, বুটিকটি অবস্থিত দক্ষিণ কলকাতার সাজানো শপিং কমপ্লেক্সে। সেখানে হয়তো সমস্যা কম হয়েছে। কিন্তু এই গণ্ডির বাইরে বেরোলে কি বদল এত সহজে আসে?
বদল আসতে সময় লেগেছে বটেই। তবে সামান্য হলেও বদলটি চোখে পড়েছে ধীরে ধীরে। যে কোনও কর্মক্ষেত্রেই মেয়েদের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এখনও ভাবতে হয় অনেক। এ ক্ষেত্রও তার ব্যতিক্রম নয়। তবু বাঙালি চোখ ধীরে ধীরে ওয়েট্রেসদের কাজ দেখতে অভ্যস্ত হচ্ছে।