E-Paper

কলেজ যাচ্ছে, ফিরবে তো?

বানতলা, সিঙ্গুর, কামদুনি, আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ— আতঙ্কের আঁচড়ে খোদাই হয়ে চলেছে এক মানচিত্র।

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০২৫ ০৭:৫৬

ভাড়া গাড়িতে উঠলে অচেনা ড্রাইভারের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিতে বেশ লাগে। কথাবার্তায় সময়টা কেটে যায়। সে দিনের চালক ছিলেন বেশ মিশুকে। বাসন্তী হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি চলেছে, সঙ্গে চলছে তাঁর বকর বকর। হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেলেন। কী হল? “এখানটা এলেই অনিতা ম্যাডামের কথা মনে পড়ে যায়।” কোন অনিতা? ওঃ, আমরা বানতলা এসে গিয়েছি নাকি? “এ দিকটাতেই উল্টে গিয়েছিল ওদের গাড়িটা। ওই খেত থেকে বডিগুলো পেয়েছিল।” বানতলা চলে গেল পিছনে। চালক ভারী গলায় জানালেন, তাঁর ভাড়ার গাড়িতে অনেক বার ফিল্ড ভিজ়িটে গিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য দফতরের কর্মী অনিতা দেওয়ান। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের হাতে সে দিন তিন মহিলা আধিকারিক ধর্ষিত হন, খুন হন অনিতা। তাঁর দেহ পরীক্ষা করার সময়ে চিকিৎসক নাকি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন।

পঁয়ত্রিশ বছর পর তেমন ভাবে মাথা ঘুরে গেল, যখন কসবার আইন কলেজের ধাতব দণ্ডের প্রাচীরের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ল পুলিশের হলুদ-কালো ফিতের পিছনে জানলা বন্ধ ঘরটা। এখন কত পুলিশ, কত রেলিং, কত সতর্কতা। সে দিন কে ছিল ভয়ার্ত, শ্বাসরুদ্ধ মেয়েটির পাশে? কলেজের বন্ধ গেটের সামনে প্রতিবাদী মেয়েরা জড়ো হয়েছেন। মেঘ-গোমড়া দুপুরে রাগী বক্তৃতা, ঘন ঘন স্লোগান, রেলিংয়ে পুলিশের লাঠিপেটা— সব মিলিয়ে যায়। মনে ভেসে ওঠে সেই মুহূর্তটা, যখন মেয়েটি উপলব্ধি করেছিল যে আজ তার নিস্তার নেই। উল্টে গিয়েছে তার জীবনের গাড়ি।

বানতলা, ধানতলা, সিঙ্গুর, কামদুনি, হাঁসখালি, আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ— ব্যথার দাগে, আতঙ্কের আঁচড়ে খোদাই হয়ে চলেছে এক মানচিত্র। প্রতিদিনের চলমান, কর্মব্যস্ত শহরের উপর শতসহস্র মন প্রতি মুহূর্তে ‘সুপারইমপোজ়’ করছে সেই যন্ত্রণার ম্যাপকে। ওই সেই ব্লক, যার সেমিনার রুমে মিলেছিল চিকিৎসকের দেহ। ওই রাস্তার ধারে কামদুনির সেই কারখানা, যেখানে গণধর্ষিত কলেজ-ছাত্রীর দেহ মিলেছিল। এই ম্যাপে প্রতিদিন যোগ হয় অগণিত ছোট ছোট বিন্দু— গলিতে, বাড়িতে, ক্লাবঘরে, মাঠে, ভেড়িতে। বাস, মেট্রো, লোকাল ট্রেনেও বিন্দুরা ছোটাছুটি করে। প্রশাসনিক মানচিত্রের উপর, রাজনৈতিক ধর্ষণের মানচিত্র।

রাজনীতি নয়? বানতলার ধর্ষণের পরে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রশান্ত শূর বলেছিলেন, ওই মহিলাদের ‘ছেলেধরা’ বলে ভুল করেছিল ‘এলাকার মানুষ’। পার্ক স্ট্রিটে নির্যাতিতাকে শাসক দলের সাংসদ বলেছিলেন ‘যৌনকর্মী’। কামদুনিতে যে মেয়েরা ধর্ষণের বিচারের দাবি করেছিল, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন ‘মাওবাদী।’ সন্দেশখালির মেয়েদের ধর্ষণের অভিযোগকে তিনি ‘রাজ্যের লজ্জা’ আখ্যা দিয়েছেন এক্স হ্যান্ডলে। মেয়েদের প্রতি এত সন্দেহ, ধর্ষকের প্রতি কোথায়? এক বারও কি তৃণমূল নেত্রী কোনও জনসভায় বলেছেন, ধর্ষকদের স্থান নেই তাঁর রাজ্যে? মা-বোন তুলে কথা বলা নেতাদের স্থান নেই তাঁর দলে? বরং দেখা গিয়েছে আর জি কর-এর প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের প্রতি তাঁর অন্তহীন প্রশ্রয়। আর আইন কলেজের ধর্ষণে অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা মনোজিৎ মিশ্রের বিষয়ে আশ্চর্য নীরবতা। ‘বিচার চাই’ আন্দোলন লিখেছিল, ‘শাসক তোমার কীসের ভয়, ধর্ষক তোমার কে হয়?’ না লিখে থাকা যায় না, তাই লেখা। নইলে সন্দীপ ঘোষ, মনোজিৎ মিশ্ররা শাসকের কে হয়, কে না বোঝে?

যা তেমন করে বোঝা যাচ্ছে না তা হল, মেয়েরা এ রাজ্যের, এ দেশের কে হয়। নেতা-মন্ত্রীরা তাদের কী মনে করে? বাহুবলী নেতার সেবাদাসী? কিছু মনুষ্যাকৃতি জীব, যারা কেবল স্লোগান দেওয়ার জন্য মুখ খোলে, আর ভাতা নেওয়ার জন্য হাত বাড়ায়? এমডি-পাঠরত চিকিৎসক, এলএলবি-পাঠরত ছাত্রী— পোশাকের মতো ছিঁড়ে নেওয়া যায় এ সব পরিচয়। অতীতে কৃষ্ণাঙ্গ দাসেদের গায়ে মালিকরা গরম লোহার ছ্যাঁকায় দাগিয়ে দিত পরিচয়। এখন তেমনই যন্ত্রণার অক্ষরে মেয়েদের কপালে রাজনীতি লিখছে ‘বিরোধী’। ‘বেশ্যা’। ‘বেয়াক্কেলে’। ‘ষড়যন্ত্রী’। ‘ছেলেধরা’।

কামদুনি, আর জি কর, কসবা... বারবার আক্রান্ত হচ্ছে ছাত্রীরাই। এটা আকস্মিক নয়, শিক্ষা নামক মহাসম্পদটি মেয়েদের নাগালে আনতে সহজে রাজি হয়নি বিশ্বের কোনও দেশ। উনিশ শতকের এই বাংলার কিছু মহামানব সমাজের চাইতেও বড় হয়ে উঠেছিলেন, তাই না স্কুল-কলেজের দরজা খুলেছিল। তবু অপমানের শেষ ছিল না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সেনেট সদস্য সরলা রায় যখন মিটিংয়ে যেতেন, ছাত্রেরা তাঁর সামনে থুতু ফেলে যেত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী ফজিলাতুন্নেছা জোহা হিজাব পরতেন না। তাঁর দিকে ছুটে আসত পাথর।

চল্লিশের দশকের একটা দিন। ভরদুপুরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী হস্টেলে ফিরছে কলেজ স্কোয়্যারের ভিতর দিয়ে। একটা লোক এগিয়ে এসে প্রশ্ন করতে লাগল, ‘কী পড়ো? কারা পড়াচ্ছেন?’ মাথায়, পিঠে ‘স্নেহের’ হাত, তার পর হাত ধরে হ্যাঁচকা টান। মেয়েটি মুহূর্তের মধ্যে পা থেকে চটি খুলে রুখে দাঁড়াল। পালিয়ে গেল লোকটা। সেই মেয়ে মণিকুন্তলা সেন। চটিকে অস্ত্র করার অভ্যাস তাঁর শুরু হয়েছিল বরিশালে কলেজে পড়ার সময় থেকেই। যত রাতই হোক, একা ফিরেছেন কলেজ থেকে বাড়িতে। এক কনিষ্ঠা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, “ছেলেরা ধারে-কাছে এগোতে পারত না। কখন চটি ছুড়ে মারে ঠিক নেই।” যখন স্কুলে পড়াচ্ছেন মণিকুন্তলা, তখন ডোভার লেনে বাড়ি ফেরার পথে একটি লোক তাঁকে গাড়িতে তোলার চেষ্টা করে। “আমি প্রস্তুতই ছিলাম। চট করে জুতো তুললাম। লোকটা কুকুরের মতন ভয়ে ভয়ে গাড়িতে উঠে চলে গেল।”

স্রেফ নিজের চটির ভরসায় একটি মেয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে, কর্মস্থলে যাতায়াত করতে পেরেছিল। দলীয় রাজনীতি তাঁকে স্থান দিয়েছিল দলে, বিধানসভায়। সহজে দেয়নি, তবু দিয়েছিল। তখন তেজস্বিনী মেয়েদের ‘শিক্ষা’ দিতে ইউনিয়ন রুম থেকে, ক্লাবঘর থেকে, রাস্তার গর্ত থেকে উঠে আসত না ছুঁচোর গোলামি-করা চামচিকেদের দল। বরং দলের মেয়ে, পাড়ার মেয়েকে কেউ উত্যক্ত করলে ‘রোমিয়ো’-টিকে এক হাত নিত পার্টির ছেলেরাও। ‘আর করব না’ কবুল করিয়ে, ক্ষমা চাওয়ানোর একটা রেওয়াজ ছিল। মেয়েদের স্বাতন্ত্র্য, নেতৃত্বক্ষমতা উপেক্ষা করেছে কংগ্রেস, কমিউনিস্ট, সব দল। কিন্তু দল-করা মেয়েদের উপর দলেরই ছেলেদের যৌনহিংসার প্রতি চোখ বুজে আছেন নেতারা, এতটা দেখা যেত না। আর আজ? ছাত্র রাজনীতির অছিলায় ভর্তি-দুর্নীতি, শিক্ষক নিয়োগ-দুর্নীতির মতোই নিয়মিত কার্যসূচি হয়ে উঠছে ছাত্রী নিগ্রহ। একটি জেলার নেত্রী একান্তে দুঃখ করছিলেন, কলেজ-ছাত্রীদের হোটেল-ঘরে নিয়ে গিয়ে ভেট দেওয়া হচ্ছে নেতাকে, এমন খবরও এসেছে তাঁর কানে।

কত ভাবে রাজনীতি ব্যবহার করছে মেয়েদের যৌনাঙ্গ। কখনও তা ভর্তি বা নিয়োগের জন্য ঘুষের অঙ্ক, কখনও কলেজে-কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকতে দেওয়ার ফি, কখনও বেয়াড়াপনার শাস্তি। কুপ্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের স্পর্ধা, দুর্নীতি ফাঁস করে দেওয়ার সাহস দেখানোর ‘উচিত শিক্ষা।’ অনিতা দেওয়ান স্বাস্থ্যের টাকা চুরি ফাঁস করার প্রমাণ সংগ্রহ করছিলেন। আর জি করে দুর্নীতির খবর প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন ‘অভয়া।’

তবে রাজ্য মানে তো রাজ্যের সরকার নয়, রাজ্যের মানুষ। বিয়াল্লিশের মন্বন্তরের সময়ে ক্ষুধা-উন্মত্ত পরিবার নারীদেহ কেনাবেচা করছে, দেখে শিউরে উঠেছিলেন মণিকুন্তলা। ক্রমে সেই বাজার আরও স্ফীত হল, কেউ বিচলিত হল না। “এখন বোধ হয় নিরুদ্বেগ, নিস্তরঙ্গ, অনুভূতিহীন মৌনতায় সবাই আমরা স্থবির হয়ে গেছি।” আজ রেশনে চাল ফ্রি, ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ দেশের মন্ত্র। তবু নারীমাংসের ভোজ দাবি করে চলেছে রাজনীতি, আর পালা করে তা মিটিয়ে চলেছে গৃহস্থ। ‘অনুভূতিহীন মৌনতা’ প্র্যাকটিস করছে রাজ্যের মানুষ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Kasba Rape Case

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy