E-Paper

শৈশবের সবটাই নিয়মহারা হিসাবহীন নয়

ঘুম, পড়াশোনা, খেলার সময়, স্ক্রিনটাইম... সব ক্ষেত্রেই সীমারেখা থাকা জরুরি

পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০২৫ ০৭:৫২

ছোটবেলায় দিদিমা প্রায়ই বলতেন, ‘হাঁসের মতো হও। দুধ থেকে জল আলাদা করতে শেখো।’ হাঁসের সত্যিই এমন গুণ আছে কি না, জানা নেই। তবে এখন বুঝি আসলে ছাঁকনি হতে বলতেন দিদিমা। খারাপটা ছেড়ে ভালকে আত্মস্থ করা। কিন্তু ছোটবেলায় এত হিসেবনিকেশ কে-ই বা বোঝে! পরিণত বয়সের যুক্তি, প্রজ্ঞা, বাস্তববোধ তখনও গড়ে ওঠে না। থাকে শুধু নিখাদ সারল্য, জীবনকে তার সবটুকু রং-আলো দিয়ে উপভোগ করার ইচ্ছে। তাকে জোর করে কঠোর নিয়মে বাঁধতে চাইলে বিপদ। কিন্তু রাশটা একেবারে ছেড়ে দেওয়াও কি উচিত? অন্তত আত্মসংযম, ভাল-খারাপের বিচার বোধ, একটা নির্দিষ্ট সীমায় নিজেকে বেঁধে রাখা— এই শিক্ষাগুলি তো অতি প্রয়োজনীয়। আর শৈশবই তার সেরা সময়।

অথচ এখনকার প্রজন্মের মধ্য়ে সেই সীমাবোধটাই তৈরি হচ্ছে না। একটা সময় যখন যৌথ পরিবারের প্রাধান্য ছিল, তখন বাড়ির ছোটদের একটা নিজস্ব জগৎ ছিল। নির্দিষ্ট সময়ে ভাইবোনেরা একসঙ্গে খেতে বসা, বিকেলে খেলতে যাওয়া, উপহার এলে ভাগ করে নেওয়ার মধ্য দিয়েই অনেক কিছু শিখে ফেলত। বয়সও তার নিজের গণ্ডি পেরোত না। অণু পরিবারে সেই গণ্ডি মেনে চলা সমস্যার। এ ক্ষেত্রে তবে কী করণীয়?

অভিভাবকদের দায়িত্ব

পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ বললেন, “এখনকার কর্মজীবনে দিনের অনেকটা সময়েই মা-বাবা দু’জনে ব্যস্ত থাকেন। সুতরাং, তাঁরা ক্লান্তির শিকার হয়ে পড়েন সহজেই। কাজের সময়টুকুর বাইরে টাইম ম্যানেজমেন্টে তাঁদের ঘাটতি থেকে যায়। শিশুদের মধ্যেও সেটা ছায়া ফেলে। অনেক সময়েই বলা হয়, ছোটদের ওদের মতো থাকতে দাও। পড়তে না চাইলে জোর কোরো না। ওরা নিজের মতো করে বড় হয়ে উঠুক। কিন্তু বাস্তব হল, ছোট থেকে একেবারেই কোনও শৃঙ্খলা না থাকলে সে কোনও দিনই ‘প্রোডাক্টিভিটি’ বুঝবে না, টাইম ম্যানেজমেন্ট শিখবে না। তাই নিয়মে কিছু ক্ষেত্রে বাঁধা প্রয়োজন অবশ্যই।”

ঘুমের সময় আলাদা হোক

স্কুলে পড়লে সকালে ঘুম থেকে উঠতেই হয়, কিন্তু রাতে ঘুমোনোর সময় কি নির্দিষ্ট থাকে ছোটদের? অনেক পরিবারেই ঘুমোতে যাওয়ার আগের সময়টুকুই মা-বাবাদের নিজস্ব সময়। সে সময়ে তাঁরা সারা দিনের আলোচনা করেন, সিনেমা দেখেন। তাঁদের দেখে অনেক সময়ে সন্তানরাও ওই সময়টুকু বেছে নেয় টিভি, মোবাইল দেখার জন্য। পায়েল ঘোষ বলছেন, “প্রথমত শিশুর শরীরে মেলাটোনিন বা ঘুমের হরমোনের প্রয়োজন বড়দের চেয়ে বেশি। ছোটদের নিয়মিত ঘুমের ঘাটতি হলে তার প্রভাব পড়াশোনায় সরাসরি পড়বে। তার পড়া মুখস্থ করতে, যুক্তি দিয়ে কোনও বিষয়কে ভাবতে অসুবিধে হবে। দ্বিতীয়ত, দাম্পত্য আলোচনায় শিশুটির উপস্থিত থাকাও কাম্য নয়। তাই ছোটদের ঘুমের সময় আলাদা করতে হবে। কেন তাদের ঘুমের সময় বড়দের মতো হবে না, সেটা মা-বাবাকেই সন্তানের কাছে স্পষ্ট করতে হবে। প্রয়োজনে শোয়ার সময়ে সন্তানকে গল্প বলে, গান শুনিয়ে, পাশে কিছুক্ষণ থাকতে হবে।” সন্তান ঘুমিয়ে পড়লে না হয় বড়রা নিজেদের জগতে ফিরে যাবেন।

বাঁধতে হবে স্ক্রিনটাইম

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছোটরা মোবাইল, ট্যাবে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস শেখার চেয়ে লঘু জিনিসপত্র দেখতেই ভালবাসে। জানার জন্য ইন্টারনেটের প্রয়োজন অবশ্যই, কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাতে বুঁদ হয়ে থাকলে মূল পড়ার সময় কমে। তাই পড়াশোনা এবং বিনোদনের সময়কে ভাগ করতে হবে। দরকারে মা-বাবাকেও সেই ভাগ মেনে চলতে হবে, অন্তত ওদের সামনে।

অপ্রয়োজনে লাগাম

ছেলেমেয়ে যখন যা চাইছে, তা-ই হাতের সামনে হাজির করা নয়। অনেক ছোট থেকেই এখন শিশুরা বুঝে যায় অনলাইন কেনাকাটা প্রদীপের দৈত্যের মতো সব কিছু মুহূর্তে হাজির করে। কিন্তু সেটা কিনতে যে পরিমাণ খরচ হয়, মাসের শেষে মোটা অঙ্কের ক্রেডিট কার্ডের বিল দিতে হয়, শিশু তার গুরুত্ব বুঝতে পারে না। এই বিষয়েও ছোট থেকে শিশুকে সচেতন করা জরুরি। কিছু পাওয়ার জন্য লক্ষ্য ঠিক করতে হবে, সময় নির্দিষ্ট করতে হবে, তবেই তো সে অপেক্ষা করতে শিখবে। এই অপেক্ষার অভ্যেস পরবর্তী কালে শিশুর মধ্যে ধৈর্য বাড়াতে সাহায্য করবে। বিশ্বে মিনিমালিস্টিক লাইফস্টাইল জনপ্রিয় হচ্ছে। কোনও কিছুই প্রয়োজনের অতিরিক্ত নয়। জাপান দীর্ঘ দিনই এই পথের শরিক। সেই পথের হদিস ছোটদেরও দিন।

বয়সোচিত আচরণ

সাইকোথেরাপিস্ট জলি লাহা জানালেন, শিশুদের বয়স অনুযায়ী তার সামাজিক, মানসিক, বৌদ্ধিক বিকাশ হয়। সেই ভাবেই বেড়ে উঠতে যদি সাহায্য করা যায়, তবে নিজে থেকেই তার মধ্যে বয়সোচিত আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। কিন্তু এখন পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে বয়সের তুলনায় শিশুটি এগিয়ে থাকলে, তার চেয়ে বেশি বয়সিদের অনুকরণ করলে প্রশংসা বেশি পায়। এই বিষয়টি সব শিশু সমান ভাবে আত্মস্থ করতে পারে না। ফলে ভারসাম্য নষ্ট হয়। বয়সের অনুপাতে তাকে আরও এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা, আরও সাফল্যের গাজরটি সামনে ঝুলিয়ে রাখা, তার ভিতরের প্রতিভা অন্যদের সামনে বারবার তুলে ধরে কৃতিত্ব নেওয়া— সব কিছুই বয়সোচিত স্বাভাবিক আচরণ প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে ওঠে। মা-বাবা নিজেরাই যদি সীমারেখা না মানেন, তবে সন্তান মানবে কী ভাবে? পরবর্তী কালে এর থেকেই অবসাদের জন্ম হয় ছেলেমেয়েদের মধ্যে।

তবে সন্তানকে সীমারেখা চিনিয়ে দেওয়া বা তারা কী করতে পারে না সেটা বলে দেওয়া— কোনওটিই জবরদস্তি চাপানো যায় না। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। বরং কেন সীমারেখা প্রয়োজন, তার পিছনের যুক্তিটি সরাসরি সন্তানকে বোঝান। প্রথম দিকে বাধা আসবেই, কিন্তু কথা বলা, বোঝানোর জায়গাটুকু যেন নষ্ট না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।


(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Screen Time

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy