E-Paper

ধ্যান-যোগে

নিয়মিত মেডিটেশন, যোগাভ্যাসে বাচ্চাদের শারীরিক ও মানসিক উন্নতি হয়। বাড়ে আত্মবিশ্বাস

কোয়েনা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৯:২৭

Sourced by the ABP

সিমলেপাড়ার নরেন্দ্রনাথ দত্ত তখনও স্বামী বিবেকানন্দ হননি। দত্ত বাড়ির ছোট্ট ছেলেটি তখন দুরন্ত বিলে। কিন্তু ধ্যানে বসলেই দস্যি বিলে একেবারে শান্ত হয়ে যেত। ভবিষ্যতে নরেনের বিবেকানন্দ হয়ে ওঠার বীজ বপন হয়েছিল সেই বাল্যকালেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সন্তানকে একজন সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে, অভিভাবককে তার মানসিক গঠনের ব্যাপারে শৈশবেই সচেতন হতে হবে। আর তার অন্যতম উপায় ধ্যান বা মেডিটেশন। যোগ প্রশিক্ষক তাপস মণ্ডল বলছেন, “ছোট্ট বয়স থেকে নিয়মিত ধ্যান করার অভ্যেস, বড় বয়সের অনেক সমস্যা থেকে সহজেই মুক্তি দিতে পারে।”

ধাপে ধাপে...

তাপস বলছেন, “বয়স অনুযায়ী বাচ্চাদের মেডিটেশনের ধরন আলাদা।” ২ থেকে ৪ বছরের বাচ্চাদের জন্য খেলার ছলে অল্প সময়ের মজাদার সেশন রাখুন। ৫ থেকে ৯ বছরের বাচ্চাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, পরিপূর্ণ চিন্তাভাবনা, কল্পনাশক্তি, নির্দেশ মেনে চলার অভ্যেস খানিকটা তৈরি হয়ে যায়। ফলে গল্পের ছলে নানা অ্যাক্টিভিটি করাতে পারেন। ১০ থেকে ১৫ বছরের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় ধ্যান, বিভিন্ন আসন করানো যায়।

  • মাইন্ডফুল ব্রিদিং: বাচ্চাদের অনুলোম-বিলোম করাতে পারেন। শ্বাস নেওয়া এবং ছাড়ার মাধ্যমে শরীরের উপরে নিয়ন্ত্রণ বাড়বে, মন শান্ত হবে, চিন্তাভাবনাও কেন্দ্রীভূত হবে।
  • মাইন্ডফুল লিসেনিং: এ ক্ষেত্রে আশপাশের বিভিন্ন শব্দ যেমন পাখির ডাক, বৃষ্টির শব্দ, কোনও মিউজ়িক ইত্যাদির দিকে বাচ্চাদের মনোযোগ দিতে বলা হয়। এতে একাগ্রতা বাড়ে।
  • কল্পনাপ্রবণ করে তুলুন: বাচ্চাদের পক্ষে নিজে থেকে মনকে শান্ত করা সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে তাঁদের চোখ বন্ধ করে বসিয়ে গল্পের মাধ্যমে কল্পনার জগতে নিয়ে যেতে পারেন। তবে এতে কিছু বাচ্চা যেমন অল্প সময়েই ধৈর্য হারায়, তেমন অনেকে ঘুমিয়েও পড়ে। সে ক্ষেত্রে বসে থেকে পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে। তাই শুয়েও বাচ্চাদের এই অভ্যেস করাতে পারেন।

যোগাসন

ধ্যানের পাশাপাশি বাচ্চাদের পদ্মাসন, বজ্রাসন, ভুজঙ্গাসন ইত্যাদির মতো কিছু সাধারণ যোগাসনও করানো যেতে পারে, বলছেন যোগ প্রশিক্ষক বরুণ দেব। তাঁর কথায়, “বিভিন্ন ধরনের স্ট্রেচে বাচ্চাদের পেশি শক্তিশালী হয়, তার নমনীয়তা বাড়ে। তিন-চার বছর বয়স থেকেই বাচ্চারা যোগাসন করতে পারে। কিন্তু খেয়াল রাখবেন, দশ-বারো বছর বয়সের আগে তাদের শারীরিক গঠন সম্পূর্ণ হয় না। তাই জোর করে স্ট্রেচ করতে গেলে কিছু সময়ে অস্থিসন্ধির ক্ষতি হতে পারে, কোনও মাসল বা টিসু ছিঁড়ে যেতে পারে, হাড় ভাঙতে পারে। তাই মনের খুশিতে নিজেদের ক্ষমতা মতো বাচ্চারা যতটুকু হাত-পা নাড়াচাড়া করতে পারে, সেটুকুই করতে দিন।”

আরও কিছু...

  • মজার ছলে: বিষয়টি গুরুগম্ভীর না করে, মজাদার করে তুলুন। প্রপস হিসেবে ব্লক, স্ট্র্যাপ বা ছোট খেলনা ব্যবহার করতে পারেন। অনুলোম-বিলোমের সময়ে বাচ্চাদের পেটের উপরে একটা ছোট খেলনা রাখতে পারেন। শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে খেলনার ওঠানামা বাচ্চাকে আনন্দ দেবে।
  • গল্প দিয়ে: ধ্যান বা যোগাসনগুলি গল্পের ছলে করাতে পারেন। যেমন– ধ্যানে মনোযোগ দিতে গল্প শোনান। বৃক্ষাসন বা ভুজঙ্গাসন করানোর সময়ে বলতে পারেন, ‘চলো সবাই একসঙ্গে জঙ্গলে যাই, গাছের মতো দাঁড়াই’।
  • রকমারি ভঙ্গিমায়: বাচ্চাদের ব্যায়াম করানোর জন্য নানা ধরনের অ্যানিমাল পশ্চার বেশি ব্যবহার করুন। ভুজঙ্গাসন, মার্জারাসন, সিংহাসন ইত্যাদি করাতে পারেন। এতে বাচ্চারা আনন্দ পাবে।
  • খেলতে খেলতে: যোগ ব্যায়ামের উপরে ভিত্তি করে ‘সাইমন সেজ়’, ‘যোগী ফ্রিজ় ডান্স’ ইত্যাদি খেলাও চলতে পারে। এতে মনঃসংযোগ বাড়বে। অন্যের নির্দেশ মেনে চলার অভ্যেস তৈরি হয়। বাচ্চাদের মধ্যে টিম স্পিরিটও গড়ে ওঠে।

নিজে উদাহরণ হয়ে দাঁড়ান

একা বাচ্চাকে মেডিটেশন না করিয়ে বরং দলে করান। এতে বাচ্চারা আনন্দ পাবে। তা ছাড়া, ছোটরা অন্যের দেখাদেখি কাজ করতে ভালবাসে, উৎসাহিত হয়।

  • একসঙ্গে অনুশীলন করুন: বাচ্চাকে নিয়ে মা-বাবা বা প্রশিক্ষক একসঙ্গে অভ্যেস করুন। এতে পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হবে, বাচ্চা উপভোগ করবে।
  • পুরস্কারের প্রলোভন: নির্দেশ না মানতে চাইলে বাচ্চাদের শাসন না করে বরং প্রশংসা করুন। ছোটখাটো উপহার, স্টার, স্টিকার ইত্যাদি দিয়ে উৎসাহ দিতে পারেন। এতে বাচ্চা নতুন কিছু শেখার গুরুত্ব বুঝবে।

উপকারিতা

  • একাগ্রতা বৃদ্ধি: ধ্যান শিশুদের মনোযোগ বাড়ায়। এতে একটানা দীর্ঘক্ষণ বাচ্চারা পড়াশোনা, কাজকর্মে মনোনিবেশ করতে পারে।
  • আবেগ নিয়ন্ত্রণ: এতে বাচ্চারা নিজেদের আবেগ, অনুভূতি চিনতে এবং নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে, যা তাদের রাগ, উত্তেজনা কমায়, শান্ত করে।
  • স্ট্রেস কমায়: নিয়মিত ধ্যান মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, অবসাদ কমায়। বাচ্চাদের মনঃস্থির করতে সাহায্য করে।
  • আত্মবিশ্বাস ও আত্মসচেতনতা বাড়ায়: বাচ্চারা নিজেকে চিনতে শেখে। তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ে, যা আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। ব্যক্তিত্ব গঠনে সহায়ক হয়। বাচ্চার দূরদৃষ্টি প্রখর হয়।

তা ছাড়া, নিয়মিত মেডিটেশন, যোগাভ্যাসে শিশুর শারীরিক ও মানসিক উন্নতি হয়। ফ্লেক্সিবিলিটি, স্টেবিলিটি বাড়ে। পজ়িটিভ মনোভাব তৈরি হয়। ঘুম ভাল হয়। মেডিটেশন অনেক সময়েই অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিজ়অর্ডার অর্থাৎ এডিএইচডিতে আক্রান্ত বাচ্চাদের শান্ত করতে পারে। নিয়মিত ধ্যান অভ্যেসে এই ধরনের বাচ্চারা নিজেদের উপরে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ গড়ে তুলতে পারে। অটিস্টিক বাচ্চাদের ফ্লেক্সিবিলিটিও খানিকটা বাড়ানো সম্ভব হয়।

ধ্যান নিয়মিত করা জরুরি। বাচ্চাদের মেডিটেশনের জন্য এখন বেশ কিছু অ্যাপ তৈরি হয়েছে। অনলাইন বিভিন্ন ভিডিয়োও সহজলভ্য। তবে বাচ্চা যা-ই করুক, প্রশিক্ষকের নজরদারিতে করতে হবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Meditation Health Tips

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy