সঠিক নিয়ম না মেনে অলিভ অয়েলের অধিক ব্যবহারে বিপদ অনিবার্য।
চিকিৎসকেরা বলছেন, অলিভ অয়েল খাওয়ার দরকার নেই৷ সর্ষে, সয়াবীন, সূর্যমুখী, রাইসব্র্যান বা বাদাম তেল যেমন খাচ্ছিলেন, তেমনই খান৷ এক এক পদ এক এক রকম তেলে রান্না করুন বা এক এক দিন এক এক তেলে, সব মিলে দিনে জনপ্রতি ৫–৬ চা–চামচের বেশি না হলেই হার্ট–ব্রেন–কোলেস্টেরল সব ভাল থাকবে৷ কিন্তু কে শোনে কার কথা? ইতালিয়ান সব কিছুই যে আমাদের বড় প্রিয়, তা সে ফেরারি হোক কি অলিভ অয়েল, তার উপর আছে মেডিটেরিয়ান ডায়েটের তুমুল প্রচার৷ না, সে ডায়েট খারাপ নয়, সব নিয়ম মেনে খেতে পারলে সত্যিই তার তুলনা নেই৷ কিন্তু আমরা কি তা মানি? স্যালাড, বাদাম, সঁতে করা সব্জি–মাছ খেয়ে পেট ভরাই? রুটিতে–স্যালাডে মাখাই এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল? শাক–সব্জি খাই পর্যাপ্ত? প্রসেস্ড ফুড ছেড়েছি? মাত্রা রাখতে পারি রেড ওয়াইনে?
না–পারার তালিকা অনেক লম্বা৷ কাজেই সব ছেড়ে শুধু অলিভ অয়েলকে বেছে নিয়ে ঝালে–ঝোলে–অম্বলে ব্যবহার করতে শুরু করলে যে খুব একটা কাজ হবে না, তা বলাই বাহুল্য৷ বরং অ–কাজ হতে পারে৷ কখনও আবার হতে পারে বিপদও৷ আবার সৌন্দর্যচর্চায় প্রবল ভাবে তাকে ব্যবহার করতে শুরু করলেও কিছু ক্ষেত্রে বিপদ অনিবার্য৷
অলিভ অয়েলের সমস্যা
শুনেছেন এক্সট্রা ভার্জিন খুব উপকারি, কাজেই সাবেক তেলেদের বিদায় দিয়ে, গলা–কাটা দাম দিয়ে তাকে কিনে শুরু করলেন রান্না৷ ডাল–ভাজা–মাছ–তরকারি...৷ তেলটা গরম কড়াইতে দেওয়ামাত্র যে হু হু ধোঁয়ার সঙ্গে উড়ে গেল অনেক উপকার, সে খবর জানা নেই বলে ধোঁয়া গলাধঃকরণ করেও আনন্দের সঙ্গে রান্না সারলেন৷ তার পর খেতে বসে বুঝলেন পণ্ডশ্রম হয়েছে৷ কারণ, খাবারটা ঠিক জমেনি৷
তা-ও শুধু সেটুকু হলেও হত৷ কিন্তু ওই যে ধোঁয়াটা ঢুকল শরীরে, তাতে ছিল তেল ভেঙে তৈরি হওয়া ফ্রি–র্যাডিক্যালস, প্রদাহের প্রবণতা বাড়িয়ে দিতে সে একাই একশো৷ ফল, হৃদরোগ থেকে শুরু করে ক্যান্সার ও আরও অনেক রোগের দরজা খুলে যাওয়া৷ আবার অতিরিক্ত তাপে তেলের মধ্যেও তৈরি হয়েছিল তারা৷ ফলে খাবারের মাধ্যমেও তাদের গ্রহণ করেছেন শরীরে৷
না, এক–আধ দিনে তত ক্ষতি নেই ঠিকই, কিন্তু এই ভুল নিয়মিত করে গেলে উপকারের বদলে বিপদ যে বাড়বে না, সে গ্যারান্টি দিতে পারছেন না পুষ্টিবিদেরা৷ কাজেই অলিভ অয়েলই খাবেন বলে স্থির করলে কোন ধরনের খাবেন, কোনটা দিয়ে কী রান্না করলে উপকারের পাল্লা অটুট থাকবে, কোনটা মোটে করা যাবে না, সঙ্গে আর কী করতে হবে সে সব জেনে নিন আগে৷
ভুল তেল, ভুল পদ্ধতি, প্রচুর ক্ষতি
নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন–এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধ অনুযায়ী, যে তেলে ‘মুফা’ বা মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড বেশি থাকে, তা রক্তের কোলেস্টেরল ও ইনসুলিন লেভেলকে নির্দিষ্ট মাত্রায় ধরে রাখতে সাহায্য করে৷ আর তাদের দৌলতে হার্ট ও ব্রেনের সুস্থতা নিশ্চিত হয় বেশ কিছুটা৷ অলিভ অয়েলে মুফা আছে ৫৫–৮৩ শতাংশ, ‘পুফা’ বা পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড আছে ২১ শতাংশ৷ সঙ্গে আছে ২০ শতাংশ স্যাচুরেটেড ফ্যাট৷ ফলে শরীরের অভ্যন্তরে যে প্রদাহের কারণে হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার ইত্যাদির আশঙ্কা বাড়ে, তা ঠেকাতে অনবদ্য হলেও তার ক্যালোরি–মূল্য যে যথেষ্ট বেশি, অন্যান্য তেলের মতোই, তা নিয়ে সন্দেহ নেই৷ কাজেই উপকারি ভেবে লাগাম–ছেড়ে খেতে শুরু করলে বেশ কয়েকটি সমস্যা হতে পারে৷ যেমন,
১) ওবেসিটির আশঙ্কা খুব বেশি৷ ওজন খুব বাড়তে শুরু করলে তার হাত ধরে হাই কোলেস্টেরল, সুগার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ব্রেস্ট, কোলন ও আরও কিছু ক্যান্সারের আগমন ঘটতে পারে যখন–তখন৷
২) গলস্টোনের আশঙ্কা বাড়ে৷
৩) রক্তচাপ কমে গিয়ে মাথা ঘুরতে পারে৷
৪) হতে পারে হজমের গোলমাল ও ডায়েরিয়া৷
আরও পড়ুন:
ডায়াবিটিসে ভুগছেন, দেখিয়ে নিন চোখও
রস করে নয়, গোটা ফল খান, কেন জানেন?
ধরা যাক, পরিমিতি রাখলেন, দিনে ৫–৬ চা–চামচের বেশি খেলেন না, কিন্তু এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েলে গুণপনা সবচেয়ে বেশি আছে বলে যদি রান্না শুরু করেন তা দিয়ে, বিপদ আছে৷ কারণ, এ তেলের স্মোক পয়েন্ট কম, মোটে ৩২০ ডিগ্রি ফারেনহাইট৷ এই তাপমাত্রায় পৌঁছনোর আগেই তেলের উপকারি উপাদান ভাঙতে শুরু করে বিপদ বাধায়৷ কাজেই যাঁরা এক্সট্রা ভার্জিন তেল খেয়ে নীরোগ থাকতে চান, তাঁদের খেতে হবে কাঁচা৷ স্যালাডে মিশিয়ে, ব্রেডে মাখিয়ে৷ বড়জোর হালকা তাপে প্যান ফ্রাই করতে পারেন বা রোস্ট করার আগে সব্জি–চিকেন–মাছে মাখিয়ে নিতে পারেন৷ ভারতীয় রান্নায় ব্যবহার করতে গেলে কিনতে হবে ভার্জিন বা রিফাইন্ড তেল৷ এর স্মোক পয়েন্ট বেশি বলে রান্নার সময় চটজলদি ভেঙে যায় না৷ তবে তৈরির সময় উচ্চ তাপ ও রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় বলে গুণেও সে কিছুটা খাটো৷
‘সমস্যা আছে আরও,’ জানালেন পুষ্টিবিদ বিজয়া অগ্রবাল বলেন, ‘‘অলিভ অয়েলে ওমেগা থ্রি নামের ফ্যাটি অ্যাসিড খুব একটা থাকে না বলে এর সঙ্গে তৈলাক্ত মাছ খাওয়া বাধ্যতামূলক৷ নিরামিষাশী হলে তিষি, আখরোট ইত্যাদি খেতে হবে নিয়ম করে৷ তা না করলে হার্ট ও ব্রেনের স্বাস্থ্য খারাপ হতে পারে৷ খুলে যেতে পারে ক্যান্সারের দরজা৷ এ সব কারণে অলিভ অয়েলের বদলে সাবেক সর্ষে, সয়াবীন, রাইসব্র্যান, বাদাম তেল ইত্যাদিই ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে খেতে বলি আমরা৷ তার মধ্যে কেউ যদি এক–আধ চামচ অলিভ অয়েল স্যালাডে বা ব্রেডে মাখিয়ে খেতে চান তো খেতে পারেন৷’’
‘‘তার পাশাপাশি আরও একটি বিষয় মাথায় রাখা দরকার’’, বললেন অগ্রবাল, ‘‘অত দাম দিয়ে এক্সট্রা ভার্জিন বলে যে তেলটি কিনছেন সেটি সঠিক তো? আজকাল প্রচুর ভেজাল বেরিয়েছে৷ সাধারণ রিফাইন্ড অয়েলে কৃত্রিম স্বাদ, গন্ধ ও রং মিশিয়ে দেদার বিকোচ্ছে তেল৷ তার উপর স্প্যানিশ, ইতালিয়ান, গ্রিক, ফ্রেঞ্চ ও ক্যালিফোর্নিয়ান অলিভ অয়েলের স্বাদ–বর্ণ–গন্ধ এতই আলাদা যে অভিজ্ঞতা না থাকলে তার মধ্যে থেকে সঠিক জিনিসটি চিনে নেওয়া মুশকিল৷’’
অলিভ অয়েলের গ্রেড ও গুণ
তেল কেমন হবে তা নির্ভর করে কী ধরনের অলিভ ব্যবহার করা হচ্ছে, কোন দেশে, কোন সময় ও কী ধরনের মাটিতে ও কী পদ্ধতিতে তার চাষ হয়েছে, অলিভ কতটা পেকেছে, চাষ হওয়ার কত দিন পর তা থেকে তেল বার করা হচ্ছে, কী পদ্ধতিতে বার করা হচ্ছে, সে তেল কী ভাবে প্যাকেটজাত ও স্টোর করা হচ্ছে ইত্যাদি সব কিছুর উপর৷ ইন্টারন্যাশনাল অলিভ অয়েল কাউন্সিল তেলের গুণমান বিচার করে৷ আমেরিকাতে বিচার করে ইউএস ডিপার্টমন্ট অব এগ্রিকালচার তেলের গ্রেড ঠিক করে৷
তিন গ্রেডের তেল হয় মূলত, এক্সট্রা ভার্জিন, ভার্জিন ও অলিভ অয়েল৷ এক্সট্রা ভার্জিনে আবার দু’টি সাবটাইপ আছে, প্রিমিয়াম এক্সট্রা ভার্জিন ও এক্সট্রা ভার্জিন৷ এই তেল বানানো হয় পুরোপুরি যান্ত্রিক উপায়ে পিষে৷ রাসায়নিক বা তাপ দেওয়া হয় না বলে এর মধ্যে উপকারি উপাদানের এক কণাও নষ্ট হয় না৷ এর পর রয়েছে ভার্জিন তেল, তার উপকারও কম নয়৷ তার তিনটি সাবটাইপ, ফাইন ভার্জিন, ভার্জিন এবং সেমি ফাইন ভার্জিন৷ ভার্জিন এবং সেমি ফাইন ভার্জিন দিয়ে রান্না করা যায়৷ অলিভ অয়েলের দু’টি সাবটাইপ— পিওর অলিভ অয়েল ও রিফাইন্ড অয়েল। গুণমানের নিরিখে এরা খানিকটা নীচে৷ এদের দিয়ে রান্না করা যায় এবং সবচেয়ে বড় কথা, এই তেল অন্য উচ্চ গুণের তেলের মতো চট করে খারাপ হয়ে যায় না৷ যত্নআত্তি একটু কম করলেও বছর দু’য়েক আরামসে ঠিক থাকে৷ সব শেষে আছে অলিভ পমেস অয়েল৷ প্রায় ৯০ শতাংশ তেল নিংড়ে বার করে নেওয়ার পর যে অলিভ পেস্ট পড়ে থাকে তাকে উচ্চ তাপে ও রাসায়নিক দিয়ে প্রসেস করে এই তেল বানানো হয়৷ খাবারে ব্যবহৃত হওয়ার যোগ্যতা না থাকলেও বহু প্রসেস্ড ফুডে সে উপস্থিত থাকে বেশ ভাল মাত্রায়৷ এই তেলও বিশেষ যত্নের ধার ধারে না৷
অলিভ অয়েলের যত্ন
ঘরের সবচেয়ে অন্ধকার ও ঠান্ডা কোণটি হল এক্সট্রা ভার্জিন ও ভার্জিন অলিভ অয়েলের জায়গা৷ ফ্রিজেও রাখা যেতে পারে৷ কারণ আলো, তাপ, বাতাস সবের প্রভাবেই সে ঝট করে খারাপ হয়ে যায়৷ সে জন্য ছোট বোতল কেনা ভাল৷ কেনার আগে ‘ইউজ্ড বাই’ ও ‘বেস্ট বাই’–এর তারিখগুলি দেখে নিতে ভুলবেন না৷ ব্যবহার করে ফেলবেন সেই সময়সীমার মধ্যেই৷ প্রতি বার ব্যবহারের পর সিল ভাল করে বন্ধ করতে হবে৷ সিল খোলার পর অধিকাংশ অলিভ অয়েল এক–দু’বছর ঠিক থাকে৷ কিন্তু যদি দেখেন স্বাদ, গন্ধ ও স্বচ্ছতায় পরিবর্তন এসেছে, সে তেল আর না খাওয়াই ভাল৷ তবে ছিপির কাছে খারাপ গন্ধ কিন্তু ভিতরে তেলের গন্ধ ঠিক থাকলে, তা খুব তাড়াতাড়ি ব্যবহার করে ফেললে ক্ষতি নেই৷ এমনকী রূপচর্চায় যে তেল ব্যবহার করবেন, তার ক্ষেত্রেও এই নিয়ম মেনে চলা ভাল৷
রূপচর্চায় অলিভ অয়েল
রূপচর্চার উপকরণ হিসেবেও যে অলিভ অয়েল সর্বগুণান্বিত এমন বলা যায় না৷ কিছু ক্ষেত্রে তো বিশেষ করে৷ যেমন,
১) নিয়মিত ব্যবহারে ব্রণ হতে পারে৷ তৈলাক্ত ত্বক হলে ঝামেলা হতে পারে প্রথম ব্যবহারেই৷ কারণ অলিভ অয়েল খুব ভারী৷ চট করে ত্বকে শুষে যায় না৷ ফলে এর উপর ঘাম–ময়লা ইত্যাদি বসে রোমকূপের মুখ বন্ধ হয়ে গিয়ে সমস্যার সূত্রপাত হয়৷
২) অ্যালার্জির ধাত থাকলে এই তেল মাখলে কন্ট্যাক্ট ডার্মাটাইটিস, একজিমা, অ্যালার্জিজনিত কাশি–শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি হতে পারে৷ হতে পারে খেলেও৷
৩) ত্বক লাল হয়ে যেতে পারে৷ র্যাশ বেরিয়ে হতে পারে চুলকানি৷ তৈলাক্ত ত্বকে সমস্যা বেশি হয়৷ নবজাতকদের অনেক সময় এই জাতীয় সমস্যা বেশি হয়৷ সে ক্ষেত্রে নারকেল তেল বা এক্সট্রা ভার্জিন তেল লাগানো যেতে পারে৷
৪) ওলেয়িক অ্যাসিড থাকার কারণে এই তেল শুষ্ক ত্বকের জন্যও খুব উপযোগী নয়৷
৫) ব্ল্যাক হেডের সমস্যা থাকলে এই তেল মুখে মাখবেন না৷ সমস্যা বেড়ে যেতে পারে৷
ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy