Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

রাজ্য নয় কাশ্মীর, আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লাদাখ, পুরোপুরি বলবৎ সংবিধান

দ্বিতীয়বার সরকারে এসেই কাশ্মীর সমস্যার ‘স্থায়ী’ সমাধানে তৎপর হন মোদীরা। ঠিক হয় সংসদের চলতি অধিবেশনেই ওই প্রস্তাব ও বিলগুলি পাশ করানো হবে।

হাতে ‘টপ সিক্রেট’ নথি। সংসদে ঢুকছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সোমবার। ছবি: এএফপি।

হাতে ‘টপ সিক্রেট’ নথি। সংসদে ঢুকছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সোমবার। ছবি: এএফপি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৯ ০৪:০৮
Share: Save:

সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ কার্যত রদ করার প্রস্তাব আজ রাজ্যসভায় পাশ করিয়ে নিল সরকার। ফলে বিশেষ মর্যাদার অধিকার হারানোর মুখে দাঁড়িয়ে জম্মু-কাশ্মীর। একই সঙ্গে ওই রাজ্যকে জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ— এই দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভেঙে দেওয়ার বিলটিও রাজ্যসভায় পাশ হয়েছে। আগামিকাল ওই দু’টি বিল লোকসভায় পাশ হলেই বিশেষ রাজ্যের অধিকার হারিয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ। সেখানকার আর্থিক ভাবে দুর্বল শ্রেণির জন্য ১০% সংরক্ষণ বিলটিও এক ধাক্কায় পাশ করিয়ে নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহেরা।

দ্বিতীয়বার সরকারে এসেই কাশ্মীর সমস্যার ‘স্থায়ী’ সমাধানে তৎপর হন মোদীরা। ঠিক হয় সংসদের চলতি অধিবেশনেই ওই প্রস্তাব ও বিলগুলি পাশ করানো হবে। তার জেরে সম্ভাব্য অপ্রীতিকর ঘটনা সামাল দিতে গত এক সপ্তাহে কাশ্মীরে বিপুল সংখ্যক আধা-সেনা মোতায়েন করা হয়। গত কাল রাতে রাজ্যের নেতাদের গৃহবন্দি করার পাশাপাশি উপত্যকার প্রত্যন্ত থানাগুলির দখল নেয় আধা-সেনা।

আজ সকালে প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে মন্ত্রিসভার বৈঠকের পরে সরকারি সূত্রে বলা হয়, ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পরিকল্পনা হয়েছে। রাজ্যসভায় এই সংক্রান্ত ঘোষণার পাশাপাশি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরির কথা ঘোষণা করেও চমকে দেন অমিত শাহ। তবে একই সঙ্গে তাঁর আশ্বাস, পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক’ হলে ‘যথোপযুক্ত’ সময়ে জম্মু-কাশ্মীরকে ফের পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হবে।

এ বার কী: সর্বদল বৈঠক ডাকা থেকে জম্মু-কাশ্মীরে স্বরাষ্ট্রসচিবকে পাঠানো— তৈরি ‘রোডম্যাপ’।

কংগ্রেসের গুলাম নবি আজাদের মতো কাশ্মীরি নেতার আক্ষেপ, ‘‘মহারাজ, প্রধানমন্ত্রী হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পরে এ বার উপ রাজ্যপাল শাসন করবেন কাশ্মীর! এর থেকে লজ্জার কী হতে পারে।’’ প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরমের মতে, কাশ্মীরকে ভারতের উপনিবেশে পরিণত করেছে বিজেপি সরকার। আগামী দিনে কাশ্মীর ভারত থেকে বেরিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন অনেক বিরোধী।

জবাবে অমিত বলেন, ‘‘যত নষ্টের গোড়া ৩৭০ অনুচ্ছেদ।’’ তাঁর যুক্তি, এর ফলে গোটা দেশের সঙ্গে মিশতে পারেননি কাশ্মীরিরা। ব্যবসায়ীরা, শিল্পপতিরা উপত্যকায় জমি কিনতে পারেননি। ফলে লগ্নিও হয়নি। মানুষ গরিবই রয়ে গিয়েছেন। ওই অনুচ্ছেদ উঠে গেলে কাশ্মীর ভারত থেকে বেরিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, আরও ভাল করে দেশের সঙ্গে তার আত্তীকরণ ঘটবে। অমিতের দাবি, অনুচ্ছেদ ৩৭০-কে হাতিয়ার করেই উপত্যকায় সন্ত্রাসে উস্কানি দিয়েছে পাকিস্তান। গত তিন দশকে ৪১ হাজার মানুষের মৃত্যুর পিছনে অনুচ্ছেদ ৩৭০ রয়েছে বলেই মত অমিতের। তাঁর দাবি, কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ নন, সে রাজ্যের তিনটি পরিবার যারা এ যাবৎ রাজত্ব করে এসেছে, তারাই সবচেয়ে আতঙ্কিত।

যে অনুচ্ছেদে কোপ

৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ কী?

• ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রতিরক্ষা, বিদেশ, অর্থ এবং যোগাযোগ ছাড়া অন্য কোনও বিষয়ে জম্মু-কাশ্মীরে হস্তক্ষেপের অধিকার ছিল না কেন্দ্রের
• জম্মু-কাশ্মীরে কোনও আইন প্রণয়নের অধিকার ছিল না সংসদেরও। আইন প্রণয়ন করতে হলে রাজ্যের সম্মতি নিতে হত
• আলাদা পতাকা ছিল জম্মু-কাশ্মীরের
• আর্থিক জরুরি অবস্থা জারি করা যেত না
• সাধারণ জরুরি অবস্থা জারি করা যেত না
• বিধানসভার মেয়াদ ছিল ৬ বছর

৩৫এ অনুচ্ছেদ কী?

• এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিশেষ সুবিধে পেতেন জম্মু-কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দারা
• কে স্থায়ী বাসিন্দা, তা স্থির করতে পারত জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভা
• স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া কেউ কাশ্মীরে জমি কিনতে পারতেন না
• স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া কেউ ওই রাজ্যে চাকরির আবেদন করতে পারতেন না। দিতে পারতেন না ভোটও
• রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা কোনও মহিলা বাইরের কাউকে বিয়ে করলে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হতেন
• ওই মহিলার উত্তরসূরিও ওই সম্পত্তির অধিকার বা মালিকানা পেতেন না

সরকার যে ভাবে এগিয়েছে, তা ব্যতিক্রমী বলেই মত রাজনৈতিক শিবিরের। নেহরুর আমল থেকে চলে আসা সমস্যা কী ভাবে মোদী-শাহের হাত ধরে সমাধানের পথে এগোচ্ছে, কী ভাবে ৩৭০ অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে অখণ্ড ভারত গঠনে বিজেপি দায়বদ্ধ— সেই বার্তা তারা পৌঁছে দিতে চেয়েছে ঘরে-ঘরে। বিজেপির এক নেতার কথায়, ‘‘কাশ্মীরের বিষয়টি সামনে রেখে দেশপ্রমের জোয়ার বইয়ে দিতে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে দল।’’ যার শুরু হবে ৭ অগস্ট। সংসদ অধিবেশনের শেষ দিনে অন্তত একটি কক্ষে বক্তব্য রাখার কথা রয়েছে মোদীর। তার পর থেকে স্বাধীনতা দিবস পর্যন্ত গোটা দেশে জাতীয়তাবাদের হাওয়া তোলার পরিকল্পনা হয়েছে। কাশ্মীরের প্রতিটি পঞ্চায়েতে যাতে পঞ্চায়েত প্রধানেরা পতাকা তোলেন, সে বিষয়ে প্রশাসনকে পদক্ষেপ করতে বলা হয়েছে। বিজেপির একটি সূত্রের দাবি, লালকেল্লায় পতাকা তোলার পরে কাশ্মীর যেতে পারেন মোদী। তিনি না গেলে, পাঠানো হতে পারে অমিতকে।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

যদিও বিরোধীদের একাংশের মতে, দেশে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ। বর্ষা আশানুরূপ হয়নি। গোটা বিশ্বে মন্দার ছায়া। ফলে আরও খারাপ সময় আসছে। জাতীয়তাবাদের হাওয়া তুলে অর্থনীতির খারাপ ছবি লুকোতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদীরা। আর গুলাম নবি আজাদের মতে, এ হল ভারতীয় সংবিধানের অন্যতম কালো দিন। এর ফলে উপত্যকায় আরও হিংসা বাড়বে। দেশের মূলস্রোত থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে কাশ্মীর। তাঁদের আরও প্রশ্ন, এখন সেনা নামিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা গেলেও কত দিন সেনা মোতায়েন থাকবে?

যদিও বিজেপি শিবিরের দাবি, স্বাধীনতার সাত দশক পরে দেশের অখণ্ড অংশ হল কাশ্মীর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE