Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
India Lockdown

ফেরার টিকিট লটারির চেয়েও দামি

দেশজোড়া লকডাউন চালু হওয়ার ৫০তম দিনে আজ পৌনে পাঁচটায় দিল্লি থেকে হাওড়াগামী প্রথম ট্রেনটি ছাড়ল।

পিপিই পরে স্টেশনের পথে। বুধবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: প্রেম সিংহ

পিপিই পরে স্টেশনের পথে। বুধবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: প্রেম সিংহ

অগ্নি রায়
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০২০ ০৪:২৬
Share: Save:

পটাশপুরের বুড়ো বটগাছতলার উল্টো দিকের পুকুর পেরিয়েই এক চিলতে জমি। সেটাই ওদের বিকেলে বল খেলার মাঠ। দরিয়াগঞ্জের সরু গলির একটা ছোট কামরায় টানা ৫০ দিন আটকে থাকার সময় মন খারাপ হলেই নির্মল চোখ বুজে মাঠটার কথা ভাবত। ওটাই ছিল কষ্ট সহ্য করার অক্সিজেন। আজ সেই স্বপ্নের মাঠে ফেরার জন্য বাবা মা-র হাত ধরে নয়াদিল্লি স্টেশনের ৬ নম্বর প্ল্যাটফর্মে বেলা একটার মধ্যে পৌঁছে গেছে ও। ট্রেন যেন কোনও মতেই ছেড়ে না যায়!

দেশজোড়া লকডাউন চালু হওয়ার ৫০তম দিনে আজ পৌনে পাঁচটায় দিল্লি থেকে হাওড়াগামী প্রথম ট্রেনটি ছাড়ল। নির্মলের বাবা গোপাল সরকারের মুখে ছেলের মতো হাসি না থাকলেও স্বস্তির ছাপ। পাশে দাঁড়িয়ে স্ত্রী বীণা সরকার। মুখোশের ওপার থেকে বলছেন, “অমৃতসর বেড়াতে গিয়েছিলাম। ২৬ মার্চ বাড়ি ফেরার টিকিট কাটা ছিল দিল্লি থেকে। সেই মতো ক’দিন আগেই দিল্লি এসে দরিয়াগঞ্জের হোটেলে ছিলাম একটু ঘুরে দেখব বলে।’’ থাকার কথা ছিল তিন দিন, থাকতে হল প্রায় সাত সপ্তাহ! বলছেন, “পুলিশ সাহায্য না করলে পারতাম না। ওরা এসে হোটেলের সঙ্গে কথা বলে সব ব্যবস্থা করেছিল। আমরা একটা থোক টাকা দিয়ে একটা ঘরে থাকতে পেরেছি। হোটেল মালিক থাকতে দিয়েছেন পুলিশের হুমকিতে। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও করে পুলিশই।’’

আজ যাঁরা ফেরার টিকিট হাতে পেয়েছেন, তাঁদের বক্তব্য, লটারি পেলেও এত আনন্দ হত না। গোপালবাবু বলছেন, “আমি জম্মুতে সেনাবাহিনীতে কাজ করি। আমার কষ্ট সহ্য করার অভ্যাস আছে। কিন্তু স্ত্রী-সন্তানদের কষ্ট দেখা যায় না।’’

আরও পড়ুন: লাগামছাড়া যাত্রীরা, বাসের সঙ্গে বাইক-পুলিশ

রেলস্টেশনের প্রবেশদ্বারের প্রায় ১ কিলোমিটার আগে থেকেই সাদা রং দিয়ে গোল গোল করা আছে। সেই গোল দাগ সব প্ল্যাটফর্মেও। হাওড়া ছাড়াও লুধিয়ানা, পটনা-সহ সাতটি গন্তব্যের ট্রেন ছাড়ল আজ। ফলে সকাল থেকেই সাপের মতো এঁকে বেঁকে এগিয়েছে লাইন। পুলিশ, রেলকর্মী, প্রশাসনিক অফিসারেরা প্রবল রোদ্দুরে যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন যাত্রীদের মধ্যে পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখার। মাঝে কংগ্রেস এবং বিজেপির টি-শার্ট পরা কিছু যুবকও নেমেছেন সেবা প্রতিযোগিতায়। হাতে স্যানিটাইজ়ার, জল, কলা। তবে এই সর্পিল লাইন প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে কিন্তু ফের জমায়েত। রেল ক্যান্টিনের কাউন্টারের সামনে পরিচিত হুড়োহুড়ি সামোসা-চায়ের জন্য।

“যদি কিছু হয় ফিরে গিয়ে হবে। নিজের মাটিতে নিজের লোকের সামনে হবে,’’ বললেন নদিয়ার মলয়কুমার দাস। করোলবাগে সোনার দোকানে কাজ করতেন। “কী ভাবে কাটিয়েছি লকডাউনে, তা না বলাই ভাল। আমাদের তো হাতে টাকা দেওয়া হয় না, সোনার লেনদেন হয়। অর্থাৎ বেতনের সমপরিমাণ সোনার কুচি কেটে দেয় মালিক। হঠাৎ সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, খাওয়ার টাকাও ছিল না। শেষ দিকে একবেলা খেতাম। বাড়ি থেকে টাকা পাঠানোয় টিকিট কাটতে পেরেছি।’’

আরও পড়ুন: পড়শিদের মানবিকতায় আপ্লুত ‘বন্দি’ কাশ্মীরিরা

ইউপিএসসি-র প্রস্তুতি নিতে দিল্লি এসেছিলেন অশোকনগরের সেলিম আহমেদ। আজ দু’হাতে কলার দু’টো বড়ো কাঁদি নিয়ে দৌড়চ্ছেন প্ল্যাটফর্মের দিকে। “দিল্লিতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার খবর পেয়ে বাড়িতে কান্নাকাটি। ফেরার জন্য সবচেয়ে বেশি চাপ দিচ্ছিলেন আমার নানি, যাঁর হাতে বড় হয়েছি। তাই ফিরে যাচ্ছি, পরীক্ষা পরে হবে।’’

নিজের রাজ্যে ফিরলেও লড়াইটা শেষ হচ্ছে না। এই ট্রেন হাওড়ায় পৌঁছলে ওঁরা কেউ নদিয়া, কেউ মেদিনীপুর, কেউ বা জলপাইগুড়ি যাবেন। হাওড়া স্টেশন থেকে কী ভাবে যাবেন, স্পষ্ট উত্তর পাওয়া গেল না কারও কাছেই। সবাই হাতড়াবেন যানবাহনের জন্য। কিন্তু বাড়ি ফেরার আনন্দে যাত্রীরা আজ অন্তত তা নিয়ে ভাবতে চাইছেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

India Lockdown New Delhi Special Train
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE