Advertisement
০৬ মে ২০২৪
Visva Bharati University

‘আত্মনির্ভর ভারত’ থেকে ‘ভোকাল ফর লোকাল’, রবীন্দ্র-দর্শনে আশ্রয় মোদীর

বিরোধী শিবির থেকে শুরু করে বিশিষ্ট জনেদের বড় অংশেরই মত হল, রবীন্দ্রবীক্ষার সঙ্গে মোদীর রাজনীতির দূরত্ব আলোকবর্যের।

শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে বিশ্বভারতীর শতবর্ষ অনুষ্ঠান। দিল্লি থেকে ভিডিয়ো বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বৃহস্পতিবার। ছবি বিশ্বভারতীর সৌজন্যে 

শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে বিশ্বভারতীর শতবর্ষ অনুষ্ঠান। দিল্লি থেকে ভিডিয়ো বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বৃহস্পতিবার। ছবি বিশ্বভারতীর সৌজন্যে 

নিজস্ব সংবাদদাতা 
নয়াদিল্লি ও কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২০ ০৪:৩০
Share: Save:

‘আত্মনির্ভর ভারত’ থেকে ‘ভোকাল ফর লোকাল’— রবীন্দ্র দর্শনের মধ্যে নিজের সরকারের নীতি খুঁজে পাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁর জাতীয়তাবাদের প্রধান আশ্রয় যে রবীন্দ্রনাথ, দাবি করছেন এমনও। ভোটমুখী বাংলায় আজ বিশ্বভারতীর শতবর্ষ অনুষ্ঠানে ভার্চুয়াল বক্তৃতায় সে কথাই বিশদে বোঝাতে চাইলেন মোদী। যদিও বিরোধী শিবির থেকে শুরু করে বিশিষ্ট জনেদের বড় অংশেরই মত হল, রবীন্দ্রবীক্ষার সঙ্গে মোদীর রাজনীতির দূরত্ব আলোকবর্যের। বিভাজন এবং বিদ্বেষের রাজনীতির বিরুদ্ধেই বরং রবীন্দ্রনাথের লেখনী ঝলসে উঠেছে বারংবার।

তবে উপলক্ষ যেহেতু বিশ্বভারতীর শতবর্ষ, তাই ‘গুরুদেব’-এর সঙ্গে গুজরাত এবং তাঁর নিজস্ব রাজনীতিকে সরাসরি সংযুক্ত করতে আজ কোনও রাখঢাক করেননি মোদী। তাঁর কথায়, ‘‘উনি আমাদের গ্রাম, কৃষি, বাণিজ্যে আত্মনির্ভর দেখতে চেয়েছিলেন। নয়া আত্মনির্ভর ভারতের ভাবনা চালু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথই। পৌষমেলায় বহু শিল্পী তাঁদের শিল্পকর্ম বিক্রি করে স্বনির্ভরতার দিশা পেতেন।’’

কোভিডের জন্য এ বছর পৌষমেলা হয়নি। বিশ্বভারতীর পডু়য়াদের কাছে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান, ‘‘এই পৌষমেলায় যে সব শিল্পী আসতেন, তাঁদের খুঁজে বের করে তাঁদের শিল্পকর্মকে অনলাইনে তুলে ধরার চেষ্টা করুন। বিক্রির জন্য তাঁদের উদ্বুদ্ধ করুন। প্রয়োজনে সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্য নিন। আমাদের ভোকাল ফর লোকাল হতে হবে।’’

আরও পড়ুন: এগ্রি গোল্ড দুর্নীতিতে ৪ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ইডি-র

রবীন্দ্রনাথের গুজরাত সফরের কথাও আজ সবিস্তার তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘কবিগুরুর বড়দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর গুজরাতে থাকতেন বলে সেখানে মাঝেমধ্যেই যেতেন গুরুদেব। গুজরাতের সংস্কৃতি তাঁর ভাল লাগত। আমদাবাদে থাকাকালীনই দু’টি কাব্যগ্রন্থ লিখেছিলেন। ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর কিছু অংশও সেখানেই লেখা।’’ ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে গুজরাতের যোগাযোগের কথা বলতে গিয়ে মোদী বলেছেন, গুজরাতি মহিলাদের থেকে শাড়ির আঁচল ডান দিকে দিতে শিখেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী।

আজকের বক্তৃতায় নিজস্ব উচ্চারণভঙ্গিতে মুহুর্মুহু রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান থেকে উদ্ধৃতি ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে। শুরু করেছেন, ‘হে বিধাতা, দাও দাও মোদের গৌরব দাও’ দিয়ে। শেষ করলেন ‘ওরে গৃহবাসী খোল, দ্বার খোল’ দিয়ে। শোনা গেল ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির’ও। মোদীর কথায়, ‘‘'গুরুদেব ভারতীয় পরম্পরা মেনে বিশ্বভারতী গড়ে তুলেছিলেন, তা দেশ গঠনে সহায়তা করেছে। বিশ্বভ্রাতৃত্ব, রাষ্ট্রবাদের চিন্তায় মুখর ছিলেন তিনি। বিশ্বভারতীকে গুরুদেব যে স্বরূপ দিয়েছিলেন, তা ভারতের জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে উদাহরণ হয়ে উঠেছে।’’ ‘লোকাল ফর ভোকাল’ এবং ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর লক্ষ্যে সবাইকে এগিয়ে আসতে আর্জি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।’ কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী পরে কটাক্ষ করে বলেন, ‘‘ভোটের আগে মোদীর রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়েছে। কিন্তু তাঁর মনে রাখা উচিত, রবীন্দ্রনাথ কিন্তু সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং উগ্র জাতীয়তাবাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন!’’

আরও পড়ুন: ব্রিটেনের পরে দক্ষিণ আফ্রিকার স্ট্রেন নিয়ে আতঙ্ক

রাজনৈতিক শিবিরের পর্যবেক্ষণ, ভোটের মুখে বাংলার মনীষী ও তাঁদের বাছাই করা বাণী এখন বারবারই প্রচারের কেন্দ্রে নিয়ে আসছেন মোদী। কখনও ঋষি অরবিন্দের দর্শন অনুসরণ করতে পরামর্শ দিচ্ছেন, কখনও বা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। কখনও বা উনিশ শতকের কবি মনোমোহন বসুর লেখা উদ্ধৃত করে আত্মনির্ভর হওয়ার কথা বলছেন। আজও শুধু রবীন্দ্রনাথে আটকে না থেকে ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, বীণা দাস, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নাম উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘ভারতের আত্মা, আত্মসম্মান, আত্মনির্ভরতা একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালিদের অবদান উল্লেখযোগ্য। এঁরা দেশের আত্মসম্মান বজায় রাখতে হাসতে হাসতে জীবন দিয়েছেন।’’ আবার এ-ও বলেছেন, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের চর্চা না করলে ভক্তি আন্দোলনের প্রকৃত রূপ বোঝা যাবে না। তবে বিশিষ্ট জনেদের বড় অংশের মতে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মনীষীদের প্রসঙ্গ টানছেন মোদী। বাস্তবে তাঁদের আদর্শের সঙ্গে তাঁর রাজনীতির মিল তো নেই-ই, বিরোধ আছে। এখনও জাতীয় সঙ্গীত বদলানোর দাবি উঠছে। গেরুয়া শিবির থেকে নানা সময়েই রবীন্দ্রনাথের লেখার বিরোধিতা করা হয়েছে।

বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য তথা ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায়ের কথায়, ‘‘প্রধানমন্ত্রী মুখে রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে আত্মনির্ভর ভারতের মন্ত্র ধার করার কথা বলছেন। কাজের বেলায় তিনিই বিশ্বভারতীতে কেন্দ্রীয় অনুদানে স্বাধীন সংস্কারকাজ এক রকম বন্ধ করে দিয়েছেন।’’ মনমোহন সিংহের আমলে ২০৭ কোটি অনুদান পাওয়ার কথা মনে করিয়ে রজতবাবু বলেন, ‘‘তখন হস্তক্ষেপ ছাড়াই আশ্রমের সব শিল্পকাজের সংস্কারে সহায়তা পেয়েছি।’’ উল্টো পিঠে মোদীর জমানায় শুধু রবীন্দ্র-উদ্ধৃতি শুনিয়ে বাগাড়ম্বর চলছে বলে রজতবাবুর আক্ষেপ। মোদী এ দিন রবীন্দ্রনাথ ও গুজরাত প্রসঙ্গ টানায় তিনি পাল্টা মনে করিয়ে দেন, রবীন্দ্রনাথ গাঁধীর বন্ধু ছিলেন। মোদীর গুজরাত আর গাঁধীর গুজরাত এক নয়।

আরও পড়ুন: পাল্টা কৃষক জমায়েতে আজ বক্তৃতা মোদীর

অর্থনীতিবিদ সৌরীন ভট্টাচার্যের পর্যবেক্ষণ, ‘‘এ তো দেখাই যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে ভোট সামনে বলে শেয়ারবাজারের মতো মনীষীদের দাম উঁচুতে চড়ছে।’’ তিনি এও মনে করিয়ে দেন, ‘‘বিশ্বভারতীর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকেই আচার্য হতে হবে এমন নয়। এর আগে গুজরাতি ভাষার কবি উমাশঙ্কর জোশী বিশ্বভারতীর আচার্য হয়েছিলেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Visva Bharati University Narendra Modi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE