E-Paper

বাঁশির ধুনে মাতোয়ারা এক সন্ধ্যা

সন্ধ্যার দ্বিতীয় শিল্পী ছিলেন পণ্ডিত রাজেন্দ্র কুলকার্নি। ধরওয়ারের উৎকৃষ্ট সাঙ্গীতিক পরম্পরার সঙ্গে পিতা বালাসাহেব কুলকার্নি এবং পরবর্তী কালে নারায়ণরাও পটবর্ধনের কাছ থেকে তালিম পেয়েছেন রাজেন্দ্র কুলকার্নি, যা তাঁর শৈলীতে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে।

গৌরব দত্ত

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২৫ ০৭:৪২
বাঁশি উৎসবে প্রখ্যাত শিল্পীরা।

বাঁশি উৎসবে প্রখ্যাত শিল্পীরা।

সম্প্রতি শব্দম ট্রাস্ট এবং পণ্ডিত গৌর গোস্বামী মেমোরিয়াল কমিটির যৌথ উদ্যোগে জ্ঞান মঞ্চে অনুষ্ঠিত হল এক অনন্য বাঁশি উৎসব। কলকাতার বুকে শুধু বাঁশিকে কেন্দ্র করে সর্বভারতীয় স্তরের একটি উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের অনুষ্ঠান প্রায় এক দশকেরও বেশি আগে হয়েছিল। ভারতীয় মার্গসঙ্গীতে বাঁশিকে একক যন্ত্র হিসেবে প্রবর্তন করেছিলেন পণ্ডিত পান্নালাল ঘোষ। মূলত পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতের দুই প্রশাখায় বিভক্ত তাঁর উত্তরসূরিরা। সেই ঐতিহ্যের এবং স্বতন্ত্র শিল্পবোধের মিশেলে তৈরি চার ভিন্ন স্বাদের পরিবেশনার সাক্ষী রইলেন এ শহরের শ্রোতারা।

অনুষ্ঠানের সূচনা করলেন পণ্ডিত সুদীপ চট্টোপাধ্যায়, রাগ গাওয়াতি দিয়ে। খেয়ালের আঙ্গিকে বিলম্বিত একতালে বন্দিশ এবং পরে মধ্যলয় তিনতাল দিয়ে শেষ করলেন। তাঁর রাগ চয়ন, বড় খেয়ালের মধ্যে বিস্তার, তান, মীড়, গমকের ব্যবহারের মধ্যে ছিল পান্নালাল ঘোষের অন্যতম শিষ্য গৌর গোস্বামী এবং তাঁর শিষ্য ও দেবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শৈলীর সুস্পষ্ট ছাপ। গাওয়াতির স্বরবিন্যাসের মধ্যে পাওয়া গেল উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের গাম্ভীর্য ও বাংলার মাটির সুরের রোম্যান্টিকতার এক মনোমুগ্ধকর সমন্বয়, যা সুদীপ চট্টোপাধ্যায়ের বাজনার এক অননুকরণীয় বৈশিষ্ট্য। শিল্পী তাঁর পরিবেশনা শেষ করেন আদ্ধা তালে নিবদ্ধ, কাফি রাগাশ্রয়ী একটি ঠুমরি দিয়ে। শিল্পীকে তবলায় সহযোগিতা করেন পিণ্টু দাস।

এ দিন সন্ধ্যার দ্বিতীয় শিল্পী ছিলেন পণ্ডিত রাজেন্দ্র কুলকার্নি। ধরওয়ারের উৎকৃষ্ট সাঙ্গীতিক পরম্পরার সঙ্গে পিতা বালাসাহেব কুলকার্নি এবং পরবর্তী কালে নারায়ণরাও পটবর্ধনের কাছ থেকে তালিম পেয়েছেন রাজেন্দ্র কুলকার্নি, যা তাঁর শৈলীতে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। শুরুতে বিলম্বিত তিলওয়াড়ায় বাঁধা রাগ শ্রী-এর বড় খেয়াল এবং সেখান থেকে দ্রুত তিনতালে অবতরণের মধ্যে পান্নালাল ঘোষের বাদনশৈলীর গভীর ছাপ দেখা যায়। এর পরে রাজেন্দ্র কুলকার্নি বাজান খম্বাজ-আশ্রিত একটি টপ্পা। গায়নশৈলীর কঠিনতম আঙ্গিকগুলির একটি এই টপ্পা। বাঁশির কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে একটু ভিন্ন স্বাদের শোনালেও কোনও কোনও অংশে তা খুবই শ্রুতিমধুর ছিল। রাজেন্দ্র কুলকার্নি তাঁর পরিবেশনা শেষ করেন বহুশ্রুত এক মরাঠি অভং “তীর্থ বিট্টল, ক্ষত্র বিট্টল” বাজিয়ে। তাঁকে তবলায় সহযোগিতা করেন আদিত্য নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

তৃতীয় শিল্পী পণ্ডিত বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায়। দেবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে প্রথমে পান্নালাল ঘোষ ঘরানার তালিম নেন তিনি। পরবর্তীতে সমরেশ চৌধুরীর সান্নিধ্যে রামপুর সেনিয়া ঘরানার গায়কী অঙ্গের দীর্ঘ সঙ্গীতশিক্ষা বুদ্ধদেবের বাদনশৈলীকে সমৃদ্ধ করেছে। শিল্পী প্রথমে বাজালেন রাগ কেদার। বিলম্বিত একতাল, মধ্যলয় তিনতাল এবং দ্রুত তিনতাল। বাঁশিবাদকদের ক্ষেত্রে যন্ত্রের কাঠামোগত কারণে রাগ কেদার বাদন খানিক অপ্রচলিত। মধ্যসপ্তকে বাঁশি এবং মন্দ্রসপ্তকে শঙ্খ বাঁশির দ্বৈত ব্যবহারে উপস্থাপনা হয়ে উঠেছিল রোমাঞ্চকর। বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য শিল্পীর দুই শিষ্য, ঋক মুখোপাধ্যায় এবং স্বরজিৎ গুহের কথা, যাঁরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তাঁদের গুরুকে সহযোগিতা করলেন এবং একক বাদনের আঙ্গিকেও একটি সিম্ফনিক বাদনের ছাপ রেখে গেলেন। শিল্পী তাঁর উপস্থাপনা শেষ করলেন রাগ নায়কী কানাড়ার একটি তিনতালের বন্দিশ দিয়ে। তাঁকে তবলায় সহযোগিতা করেছেন সুব্রত মান্না।

এ দিনের অনুষ্ঠানের শেষ শিল্পী ছিলেন পান্নালাল ঘোষ ঘরানার সম্ভবত প্রবীণতম উত্তরাধিকারী পণ্ডিত নিত্যানন্দ হলদিপুর। প্রথম জীবনে পান্নালাল ঘোষের সাহচর্য এবং পরে অন্নপূর্ণা দেবীর কাছে দীর্ঘ তালিমের ফলে তাঁর বাদনশৈলীতে পাওয়া যায় পান্নালাল ঘোষ ঘরানা এবং সেনিয়া মাইহার ঘরানার শৈলীর এক অবিকৃত মিশ্ররূপ। তাঁর পরিবেশিত রাগ বাগেশ্রীর বিলম্বিত একতালের বন্দিশে যেমন পান্নালাল ঘোষ ঘরানার রীতি উজ্জ্বল, আবার দ্রুত তিনতালের বন্দিশ এবং অতিদ্রুত লয়ে নিয়ে গিয়ে ঝালা-র আঙ্গিক বাজানোর মধ্যে মাইহার ঘরানার প্রতিচ্ছবি সুস্পষ্ট। শিল্পীকে তবলায় যোগ্য সঙ্গত করেন ইন্দ্রনীল মল্লিক।

শুধু বাঁশিকে কেন্দ্র করে আয়োজিত এই সাঙ্গীতিক সন্ধ্যা এ দিন আবিষ্ট করে রেখেছিল শ্রোতাদের। ভারতীয় মার্গসঙ্গীতে বাংলার বাঁশির যে বিশ্বজনীন অবদানের ইতিহাস রয়েছে, তা এ দিন আরও একবার রোমন্থন করার সুযোগ পেলেন শ্রোতারা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Gyan Manch

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy