Advertisement
E-Paper

রন্টু তোমাকে...

কোনও দিনই ভোলার নয়। মার্চ মাসটা এলে আরওই যেন হামলে পড়ে স্মৃতি। কাল কৃশানু দে-র চলে যাওয়ার ১৩ বছর। লিখছেন স্ত্রী শর্মিলা দেলাজুক-লাজুক গলায় ছোট্টখাট্ট চেহারার ছেলেটাই জবাব দিল, ‘‘নমস্কার, আমার নাম রন্টু। ভাল নাম কৃশানু। আমরা প্রভাত সংঘের জন্য চাঁদা তুলতে এসেছি। আপনার যা ইচ্ছা চাঁদা দিতে পারেন।’’ তখন কী আর ভেবেছি, এই ছেলেই পরের দশ বছরের মধ্যে আমার জীবনের সঙ্গে একেবারে ওতপ্রোত ভাবে জুড়ে যাবে! আমার সুখ-দুঃখের সঙ্গী হবে! আনন্দও যেমন দেবে, আবার সারা জীবনের মতো দুঃখে ভাসিয়ে সাততাড়াতাড়ি হুশ করে চলেও যাবে!

শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৬ ০০:০৩

কালীপুজোর আগের কথা।

সালটা ১৯৭৯-র কাছাকাছি।

আমরা তখন নাকতলায় থাকি। আমতলা রিকশা স্ট্যান্ডের পাশে।

সাতসকালে হঠাৎ দেখি কয়েকটা ছেলে এল বাবার কাছ থেকে চাঁদা নিতে।

তাদের একজন ছোটখাটো ফরসা মতো। চুলটা রাজেশ খন্নার মতো ছাঁটা। গালে দুটো তিল। ছোট এক চিলতে গোঁফ। বাবা দরজার সামনে গিয়ে বলল, ‘‘কে? কী চাও তোমরা?’’

লাজুক-লাজুক গলায় ছোট্টখাট্ট চেহারার ছেলেটাই জবাব দিল, ‘‘নমস্কার, আমার নাম রন্টু। ভাল নাম কৃশানু। আমরা প্রভাত সংঘের জন্য চাঁদা তুলতে এসেছি। আপনার যা ইচ্ছা চাঁদা দিতে পারেন।’’

তখন কী আর ভেবেছি, এই ছেলেই পরের দশ বছরের মধ্যে আমার জীবনের সঙ্গে একেবারে ওতপ্রোত ভাবে জুড়ে যাবে! আমার সুখ-দুঃখের সঙ্গী হবে! আনন্দও যেমন দেবে, আবার সারা জীবনের মতো দুঃখে ভাসিয়ে সাততাড়াতাড়ি হুশ করে চলেও যাবে!

• আমি তখন চোদ্দো, ও সতেরো

গোটা দেশ তাকে চিনেছে এমন একজন ফুটবলার হিসাবে যে মাঠে তার ঈশ্বরপ্রদত্ত দক্ষতার প্রমাণ রাখে। প্রতি মুহূর্তে মন্ত্রমুগ্ধ করতে পারে।

আমার কাছে কিন্তু তারও আগে ওর পরিচয় একজন অসম্ভব লাজুক, বিনয়ী, নম্র স্বভাবের মানুষ হিসেবে।

মাটির মানুষ বললেও কম বলা হয়।

গালিগালাজ তো কোন ছার, কোনও দিন উঁচু গলায় কথা বলতেও শুনিনি ওকে। ঔদ্ধত্য বলে কোনও শব্দ ওর অভিধানে ছিল না।

রন্টু এমনই।

মাঠের কৃশানুর থেকে একদম আলাদা। ওর খেলা দেখতে দেখতে বারবার অবাক হতাম। শান্তশিষ্ট ছেলেটা মাঠে নামলে কী ভয়ঙ্কর ভাবে পাল্টে যায়! লম্বা লম্বা শক্তপোক্ত চেহারার সব ডিফেন্ডারকে চোখের নিমেষে কী করে পেরিয়ে যায়! ওকে তখন প্রচণ্ড ক্ষিপ্র লাগে। অথচ বাড়িতে এলে সেই মানুষটারই মুখে ‘রা’ সরত না !

সে দিন চাঁদা তুলতে এসেও তো আমার বাবাকে ভয় পেয়ে এক সময় চলেও গেল। অথচ বাবা যে খুব রাশভারী ছিলেন, তা নয়।

সে দিনের পর থেকে কী যে হল আমার! ওই স্বভাবলাজুক, ভীরু চেহারাটা আমায় কেমন ঘোর ধরিয়ে দিল।

ওকে কেবল নজর করতাম। যাতায়াতের পথে দেখতাম। ছলছুতোয় বারান্দার দাঁড়িয়ে ওর হেঁটে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকতাম। আমার তখন কতই বা বয়স, বড়জোর চোদ্দো। ওর বছর সতেরো।

প্র্যাকটিস শেষে আমাদের বাড়ির পাশ দিয়েই ফিরত। কিছু দিন খেয়াল করতে করতে সময়টা বুঝে গিয়েছিলাম। ঠিক তাল বুঝে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতাম। দেখতাম, আড়চোখে ও-ও আমাকে খেয়াল করছে।

এমন দূরে দূরে থেকেও এ ভাবেই ওর সঙ্গে কেমন যেন জড়িয়ে পড়লাম। মনে মনে।

• চিঠিতে লেখা, আমি দেখা করতে চাই

কয়েক দিন বাদে ওকে একটা চিঠি পাঠালাম। ওর এক বন্ধু বাবুয়াকে দিয়ে। লিখলাম, ‘‘তুমি কি আমার সঙ্গে মিশবে? আমায় ভালবাসবে?’’ উত্তর আসার আগেই শুনলাম ওদের বাড়িতে ভয়ানক অশান্তি। তখনই বুঝলাম আমাদের সম্পর্কের কথা ফাঁস হয়ে গেছে।

এর পর এক বছর দু’জনেই চুপচাপ ছিলাম। এর মধ্যে ওর জ্যাঠতুতো ভাই টোটন বহরমপুর থেকে কলকাতায় এল। টোটন খুব ‘ফলো’ করত আমায়। আমি সন্দেহর চোখে দেখতাম। পরের বছর দুর্গাপুজোর সপ্তমী ছিল ২৮ সেপ্টেম্বর। টোটন আমাকে একটা চিঠি ধরালো। তাতে রন্টু লিখেছে— ‘‘আমি দেখা করতে চাই।’’

সেই শুরু। প্রথম-প্রথম চোখাচুখি আর চিঠি চালাচালিতে আমাদের ভালবাসা আটকে ছিল। চিঠি পাচার করত ওই টোটনই।

তার পর পাকাপাকি ভাবে প্রেমের লাইসেন্সটা পাওয়া গেল কিছুটা পরে।

সময় পেলেই আমরা একসঙ্গে হাঁটতাম। ঘণ্টা দুয়েক। ওরই মামাবাড়ির পেছন দিকটায়। কিন্তু বাড়ির বেঁধে দেওয়া সময়মতো ঠিক চলে আসতাম। ও-ই পৌঁছে দিয়ে যেত। গলির মুখ অবধি। ওদের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি হাঁটা পথে পাঁচ মিনিট।


নয়নজোড়ানো সেই শৈল্পিক ড্রিবল

• গোলকিপিং করে সোনার আংটি

ভারতীয় ফুটবলে কৃশানু প্লে-মেকার হিসাবে নাম করলেও নাকতলার রন্টুর শুরুটা কিন্তু একেবারে অন্য ভাবে। গোলকিপার খেলত ও।

ওর মুখেই শুনেছিলাম ওর ফুটবলে ঢোকার গল্প।

ছোটবেলায় খুব ক্রিকেট খেলত। ক্রিকেটই ধ্যানজ্ঞান। সব কিছু। পাড়ায় খেলা হলে ও-ই উইকেটকিপার।

তখন তো পাড়ায়-পাড়ায় টুর্নামেন্ট লেগেই থাকত। এমনি খেলাও হত প্রচুর। ফুটবল, ক্রিকেট সব।

রন্টু বেশির ভাগ সময় ক্রিকেটটাই খেলত। ফুটবলের দিকে অত ঝোঁকই ছিল না।

রন্টুর পাড়ার ক্লাবের নাম প্রভাত সংঘ। প্রভাত সংঘে তখন জিআর ধর শিল্ড বলে একটা টুর্নামেন্ট হত। ওর দাদাদের গ্রুপটা ছিল প্রভাত সংঘের আসল প্লেয়ার। রন্টু আর ওর কয়েকজন বন্ধু ছিল বাঁধা দর্শক। এই সময়ই সান্টুদা বলে একজনের সঙ্গে ও যায় ফুটবল-কোচ অচ্যুত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামের পাশের মাঠটায় ওঁর প্র্যাকটিস হত।

শোনা কথা, সেখানে একবার গোলকিপার হিসেবে খেলে ও সোনার আংটি পায়। সে আংটি এখনও আছে।

এক দিন অচ্যুতদা বুঝে ছিলেন, সোনার আংটি পেলেও গোলকিপিং রন্টুর আসল জায়গা নয়। উনি তখন ওকে খেলাতে লাগলেন মাঝমাঠে।

• মোহনবাগান থেকে ডাক

ময়দানে রন্টুর প্রথম ক্লাব ছিল ক্যালকাটা পুলিশ। সেখান থেকে পোর্ট ট্রাস্ট।

পোর্টে খেলার সময়েই শৈলেন মান্নার চোখে পড়েছিল ও। মান্নাদা-ই মোহনবাগানকে বলেছিল রন্টুর কথা। মোহনবাগান তার পরই প্রস্তাব দেয় রন্টুকে।

আমি শুনে খুশি হয়েছিলাম ঠিকই। সঙ্গে ভয়ও ছিল। এত অল্প বয়স ওর, অমন বড় ক্লাবে খেলতে যাবে! ধকল নিতে পারবে তো?

শুনতাম, ওখানকার সিনিয়র ফুটবলাররা খুব রাগী। তেড়েমেড়ে কথা বলে। অত ছোট বয়সে অমন একটা পরিবেশ ওর ওপর চাপ হয়ে যাবে না তো?

আশঙ্কার চোটে রন্টুকে বলেই ফেলি, ‘‘দেখো, মোহনবাগানে যাচ্ছ যাও। কিন্তু বেশির ভাগ সময়টা কিন্তু রিজার্ভ বেঞ্চেই কাটাতে হবে। তখন কিন্তু কষ্ট পেলে চলবে না। আর সব চেয়ে বড় কথা, এতে তোমার উন্নতি হবে?’’

রন্টু বলল, ‘‘চিন্তা কোরো না। দেখি না গিয়ে। এমন সুযোগ তো সবাই পায় না।’’

মোহনবাগানে গেল ও। ওখানেই প্রথম ওর সঙ্গে আলাপ হল লালুর। লালু মানে, বিকাশ পাঁজি।

ধীরে ধীরে ওদের মধ্যে এমন বন্ধুত্ব হয়ে গেল যে, সেটা শুধু মাঠ নয়, মাঠের বাইরেও চলে এল।

এমন অনেক সময় আমি সাক্ষী থেকেছি যে রন্টুর জন্য কম টাকায় খেলছে বিকাশ। আবার উল্টোটাও হয়েছে। দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব কতটা গভীর থাকলে অমনটা সম্ভব!

মাঠে ওদের যে বোঝাপড়া ছিল, তার জন্য এই বন্ধুত্বটাও খানিকটা কাজে দেয়। দু’জনে দু’জনকে এত ভাল চিনত যে হাবেভাবেই একজন বুঝে যেত, অন্যজন কী চায়।

প্রতিদিন মোহনবাগানের প্র্যাকটিসের পরে ওর সঙ্গে দেখা করতাম। পাড়াতেই।

আমার বাঁধা প্রশ্ন ছিল, আজ কী কী শিখলে?

আসলে ওই খটমট পরিবেশ নিয়ে আশঙ্কাটা আমার কিছুতেই কাটছিল না। কথা বলে বলে কেবলই বুঝে নিতে চাইতাম, ওর কোনও অসুবিধে হচ্ছে কিনা, ও ঠিক কতটা মানিয়ে নিতে পারছে। বা, আদৌ পারছে কিনা। এমনিতে এতই মুখচোরা, না জানতে চাইলে তো কিছুই বলবে না।

যত বার জানতে চাইতাম তত বার রন্টু বলত,‘‘সিনিয়ররা খুব ভাল, জানো! আমায় খুব খুব সাহায্য করে।’’

সেই সময় ও খুব সুরজিৎ সেনগুপ্তর নাম করত। যিনি প্রায় নিজের ছেলের মতো আগলে রাখতেন রন্টুকে। ভুল হলে ধরিয়ে দিতেন। আরও কী করে খেলায় উন্নতি করা যায়, বোঝাতেন।

বাবলুদা (সুব্রত ভট্টাচার্য) আবার ছিলেন উল্টো। বকাঝকা বেশি করতেন। কিন্তু ভাল খেললে প্রশংসা করতেও ভুলতেন না।

দু’জনকেই কিন্তু ও পছন্দ করত। শ্রদ্ধা করত।

• যেতেই হবে ইস্টবেঙ্গলে

মোহনবাগানে তিন বছর কাটল। তার পরই আমার প্রিয় ক্লাব ইস্টবেঙ্গল থেকে ডাক।

প্রস্তাব আসতেই আমি তো আত্মহারা প্রায়। প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে বললাম, ‘‘তোমাকে যেতেই হবে ইস্টবেঙ্গলে। ওখানেই দেখবে আরও উন্নতি হবে তোমার।’’

১৯৮৫। দলবদল। আমাদের তখনও বিয়ে হয়নি। তবে সম্পর্কের কথা কারও অজানা নেই! সবাই সব জানে।

সে দিন সিনেমা দেখে ফিরেছি। আমি, রন্টু, আমার দিদি আর জামাইবাবু। খেতে বসেছি। হঠাৎ পাড়ার ফটিকদা এসে বলল, ‘‘ইস্টবেঙ্গলের পল্টুদা এসেছেন। রন্টুকে খুঁজছেন। ওর বাড়িটা জানতে চাইছেন।’’

ফটিকদার গলা পেয়ে দোতলা থেকে বাবা আগেই নেমে গিয়েছিল নীচে। আমিও নামলাম। নেমে পল্টুদার লম্বাচওড়া, গম্ভীর চেহারাটা দেখে ঘাবড়ে গিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলাম।

বাবাও তখন খুব ভয় পেয়েছিলেন বোধহয়। দলবদল নিয়ে তখন কী যে হত, চাপা টেনশন সব সময় লেগেই থাকত। ভয় পাওয়ারই কথা। কোথা থেকে কী হয়ে যায়!

বাবা ইচ্ছা করেই ভুল ঠিকানা বলে দিলেন। তাতে কী আর পল্টুদাকে আটকানো যায়!

ঠিক খুঁজে খুঁজে বের করলেন রন্টুর বাড়ি। এর পর শুধু মোহনবাগান কেন, অন্য কোনও ক্লাব যাতে রন্টুকে তুলে নিয়ে যেতে না পারে, সে জন্য টানা তিন দিন বাড়ির সদর দরজার কাছে ইস্টবেঙ্গলের জীবনদা বসে বসে পাহারা দিতেন।

আমারও তখন একটুআধটু যে ভয় করেনি, তা নয়। কিন্তু মনে মনে আনন্দও হচ্ছিল। ভালয়-ভালয় সব মিটে গেলে রন্টুর তো এ বছর ইস্টবেঙ্গলে যাওয়া পাকা।

তাই-ই হল।

• পাস দুটো কেমন দিলাম বলো

রন্টুর ইস্টবেঙ্গলের কথা বলতেই আমার আজও চোখে ভাসে মহমেডানের সঙ্গে সেই ম্যাচটা।

’৮৫ সাল। বোধ হয় লিগের ম্যাচ। যুবভারতীতে। ওই ম্যাচটাই কৃশানু নামের এক ‘প্রতিভা’র জন্ম দিয়েছিল ভারতীয় ফুটবলে।

ইস্টবেঙ্গল কোচ তখন পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়। ওকে প্রথম দলে রাখা হয়নি বলে অভিমানে হাতে ক্রোসিন নিয়ে ‘জ্বর’ বলে রিজার্ভ বেঞ্চে বসেছিল রন্টু। পরে যে জন্য বকুনিও খায় মনাদার(মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য) কাছে। মনাদা না বললে সে দিন হয়তো ও নামতই না।

খেলা শুরুর একটু পরেই চিমার দূরপাল্লার কামান-দাগা শটে পিছিয়ে পড়ল লালহলুদ।

অনেক বাদে নামানো হল রন্টুকে। নেমেই দুটো পাস। তার থেকে দুটো গোল। মাঠে যেন সে দিন ফুল ফুটিয়েছিল রন্টু। ড্রিবলের পর ড্রিবল। নিখুঁত চেরা পাস। কিছুতেই রোখা যাচ্ছিল না ওকে।

ম্যাচের পর বাচ্চার মতো টগবগ করে ফুটছিল ও। অভিনন্দনে-আদরে-আবেগে ভেসে গিয়েছিল। কিন্তু আমার সঙ্গে কথা না বলা পর্যন্ত ওর স্বস্তি নেই।

পাড়ায় ফিরে দেখা করে বলল, ‘‘দেখলে? কেমন লাগল? পাস দুটো কেমন দিলাম বলো? সাপোর্টাররা তো আমাকে কোলে তুলে নিল।’’

‘‘ভাল খেলেছ। কিন্তু এই খেলাটা তোমায় প্রতিদিন খেলতে হবে। একদিন হলে চলবে না।’’

এর পরেই মারডেকায় রন্টুর হ্যাটট্রিক!

• ‘আনন্দ’ দেখলেই কেঁদে ভাসাত

আমার সঙ্গে রন্টুর বিয়ে হয়ে গেল ’৮৮-তে। ওর জন্মদিন ১৪ ফেব্রুয়ারির ঠিক ৬ দিন আগে। ৮ তারিখে।

বিয়ের পরে মনে আছে জীবনদা বলেছিলেন, ‘‘অনেক সামলে রাখসি তর রন্টুরে। এ বার পোলাডারে ক্লাবে রাখার দায়িত্ব তর।’’

ফুটবল ছাড়া রন্টুর জীবনের আর একটা প্যাশন ছিল— রাজেশ খন্না।

সিনেমা ও যে খুব দেখত, সে রকম না। কিন্তু বলিউডের নায়কদের মধ্যে রাজেশ খন্নার অন্ধভক্ত ছিল রন্টু।

‘আনন্দ’, ‘অমর প্রেম’, ‘সফর’, ‘হাতি মেরে সাথী’, ‘আপ কী কসম’, কোনও ছবি মিস করত না। ভিসিডি-তে বারই ‘আনন্দ’ দেখত, ততবারই চোখের জলে ভাসত। সে নিয়ে বাড়িতে কী হাসাহাসি!

রাজেশ খন্নার সিনেমা মানেই লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটা। সে এক-আধ বার তো প্রায় চার-পাঁচ ঘণ্টা লাইন দিয়ে। হেয়ার স্টাইলটাও রাজেশের মতো করে ফেলেছিল, সে তো আগেই বলেছি।

আমি ছিলাম পাঁড় অমিতাভ বচ্চন-ভক্ত। তাই নিয়ে ওর সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া লাগত।

ও বলত, ‘‘রাজেশ খন্নার মতো অভিনয় কেউ করতে পারে না! গানগুলোয় যখন রাজেশ খন্না লিপসিঙ্ক করে, মনে হয় ও নিজেই গাইছে। এতটাই নিঁখুত রাজেশ খন্না। বুঝলে?’’

আমিও ছাড়তাম না। ব্যস, লেগে যেত দু’জনের।

রাজেশ খন্নার সিনেমা এলেই হল, টানতে টানতে আমায়ও নিয়ে যেত। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ‘অমর প্রেম’-এর গান গাওয়া, রাজেশ খন্নার স্টাইলে ‘আই হেট টিয়ার্স পুষ্পা’ বলার চেষ্টা, কোনও কিছু বাদ ছিল না। মাঝে মাঝে এত হাসি পেত!

• ওই দ্যাখ ল্যাংড়াটা যাচ্ছে

বিয়ের সময় রন্টুর ফুটবলার জীবন একটু হলেও অন্ধকারে।

কার্টিলেজ ছিড়ে যাওয়ায় অপারেশন হয়েছে। খেলা বন্ধ। মাঠের বাইরে দমবন্ধ করা জীবন।

সে সময়েরই এক দিনের কথা কখনও ভুলব না।

গড়িয়াহাটে এক দিন আমরা শপিংয়ে গেছি। কয়েক জন ছেলে ওকে দেখতে পেয়ে যাচ্ছেতাই করে টিটকিরি দিল— ‘‘ওই দ্যাখ ল্যাংড়াটা যাচ্ছে। আরে, ওর ফুটবলজীবন শেষ।’’

বিখ্যাত এক জন কোচকেও বলতে শুনেছিলাম, ‘‘কৃশানু? মানে ওই ল্যাংড়াটা। ও আর কী ফুটবল খেলবে! ধুর।’’

প্রকাশ্যে কাউকে কিছু বলতে পারত না। প্রতিদিন কাঁদত শুধু আমার কাছে।

বলত, ‘‘পনি (আমার ডাকনাম), আমি কি সত্যি আর কোনও দিন ফুটবল খেলতে পারব না?’’

আমি যতটা পারতাম ভরসা দিতাম। কিন্তু ওকে দেখে, ওর কষ্টটা বুঝে মনে মনে আমিও কেমন দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছিলাম। এ সময় নইমদা ওঁকে রুটিন বেঁধে যা সাহায্য করেছিলেন, কোনও দিন ভুলব না।

কার্টিলেজ চোট থেকে সেরে ওঠার লড়াইটা ওর যে কী কঠিন ছিল! কষ্ট পেত। কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করতেও ছাড়ত না। তার প্রতি মুহূর্তের সাক্ষী আমি।

একটু যখন স্বাভাবিক হল, ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে শুরু হল ওর ফিরে আসার আরেক লড়াই।

প্রতিদিন কাকভোরে উঠে রেস কোর্সে প্র্যাকটিস। ওই সময়টায় আরেক জন— সুদীপদা (চট্টোপাধ্যায়)! প্রাণপাত করেছিল রন্টুর জন্য! এক কথায় বলতে গেলে, তখন রন্টুর কোচ হয়ে উঠেছিল সুদীপদা।

আমরা কয়েকটা পরিবার মিলে একসঙ্গে পুরী ঘুরতে গেলাম।

সেখানেও দেখতাম, সকালে সুদীপদা ওকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। তিন-চার ঘণ্টা ধরে সমুদ্রের ধারে দৌড় করাত।

বিকেলে নিয়ম করে এক্সারসাইজ। তার সঙ্গে আবার আইরন শ্যু পরা।

আমি কেবলই বলে যেতাম, ‘‘হার মেনো না। লড়াইটা চালিয়ে যাও। ঠিক ফিরবে তুমি। দেখে নিয়ো।’’

আমার বিশ্বাসেও কোনও খাদ ছিল না। ১৯৮৯-এ ইস্টবেঙ্গল থেকে প্রস্তাব এল।

অশ্রুদা বাড়িতে এসে বলল, ‘‘রন্টু তোকে পঁচিশ হাজার টাকা দেওয়া হবে। তুই খেলবি তো?’’

পঁচিশ হাজার! মাত্র! আমিও শুনে চমকে উঠেছিলাম।

তখন রন্টুর উত্তরটা আমার আজও কানে বাজে।— ‘‘টাকাটা রেখে দাও। আমার পয়সা লাগবে না। যদি ভাল খেলি তখন দিও।’’

কিন্তু ও বিনা পয়সায় খেলবে শুনে প্রচণ্ড খেপে গেল লালু।

ক্লাবকে বলল, ‘‘এত বছর ভাল খেলেছে রন্টু। একটা মরসুম খেলতে পারেনি বলে এ রকম। আমি আর রন্টু একই পেমেন্ট ছাড়া খেলি না। ওকে যদি কম টাকা দেওয়া হয় আমাকেও তা হলে কম টাকা দেওয়া হোক। না হলে খেলব না।’’

সেই মরসুমে মাঠে ফিরে দুর্দান্ত খেলল রন্টু। তাতে ওর ‘দর’ও গেল বেড়ে। এয়ারলাইন্স কাপে পাঁচজনকে কাটিয়ে গোল করে আখ্যা পেল ‘মারাদোনা’!

পরের বছর, মানে ১৯৯০-তে দলবদলে ওকে নিয়ে জমে গেল নাটক।

• রাত বারোটায় কড়া নাড়ার শব্দ

সন্তোষ ট্রফি খেলতে তখন বাংলা যাবে বেঙ্গালুরু। রন্টুর সঙ্গে আমিও গিয়েছি।

আমার পিসির বাড়ি চেন্নাই। এগ মোড়ে। পিসোমশাই আমাকে স্টেশন থেকে নিয়ে চলে গেল। ওরা বেঙ্গালুরু যাবে ট্রেনে।

ওদের পুরো প্ল্যানটা মোহনবাগানের অঞ্জনদা (মিত্র) কোনও একজনের মারফত খবর পেয়ে গেল।

আসলে আমরা যখন কলকাতা থেকে বেরচ্ছি, তখন এক জন সাংবাদিক ফোন করেন বাড়িতে।

রন্টু দেখি, ফোনে গড় গড় করে কবে কোথায় কী ভাবে যাবে, কখন কোথায় থাকবে, সব তাঁকে বলে দিচ্ছে। তখনই আমি ওকে বললাম, ‘‘আরে তুমি অত কথা ওঁকে বলতে গেলে কেন?’’

পিসির বাড়ি তো পৌঁছলাম। কিন্তু রাত প্রায় বারোটা নাগাদ হঠাৎ শুনি কড়া নাড়ার শব্দ। দরজা খুলতেই দেখি, অতনুদা (ভট্টাচার্য), লালুদা।

কী ব্যাপার?

আমার পিসিকে ওরা বলল, ‘‘ট্রেন মিস হয়েছে পিসি। পনিকে হোটেলে নিয়ে যাচ্ছি। রন্টু ওখানেই আছে। কাল সকালে ওকে আমরা পৌঁছে দিয়ে যাব।’’

এগ মোড়েই ওদের হোটেল। গেলাম ওদের সঙ্গে। গিয়ে দেখি, মোহনবাগানের অঞ্জনদা, বীরুদা বসে। সঙ্গে সেই সাংবাদিক। লালুও আছে। লালুর তখন সই করা হয়ে গেছে।

রন্টু বাড়িতে ফোন করছে। আমার ভাশুর আর শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলছে। শাশুড়ি বলে দিয়েছিলেন, ‘‘অ্যাডভান্স যে ক্লাব দিচ্ছে সেখানে যাও।’’

অঞ্জনদা আইসক্রিমের অর্ডার দিল। সই করার ঠিক আগের মুহূর্ত। হোটেল-ঘরের কলিং বেলটা বেজে উঠল। নির্ঘাৎ আইসক্রিম এসে গেছে।

দরজা খুলে পুরো চমকে উঠলাম সবাই। ইস্টবেঙ্গলের সুপ্রকাশ গড়গড়ি। খালি পা। এলোমেলো চুল। সিল্কের লুঙি। যাহোক-তাহোক করে চাপানো শার্ট। উদভ্রান্তের মতো সোজা ঘরে ঢুকে এল।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হাতজোড় করে অঞ্জনদার সামনে— ‘‘প্লিজ আমায় কৃশানু-বিকাশ দিয়ে দাও। তুমি চিমাকে নিলে নাও। এ বছরের মতো ছেড়ে দাও। নইলে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা আমার বাড়ি আগুন লাগিয়ে দেবে।’’

পুরো কান্নাকাটি শুরু করে দিল গড়গড়িদা। অনেক পরে অঞ্জনদা বললেন, ‘‘আচ্ছা, পনি বলো কী হবে।’’

আমি বললাম, ‘‘দেখুন আমি তো এত নিয়মটিয়ম জানি না, রন্টু যদি অ্যাডভান্স নিয়ে থাকে আপনাদের, তা হলে তো ওকে যেতেই হবে।’’

শুনে কে যেন বললেন, ‘‘না না, তা কেন! তিন দিনের মধ্যে অ্যাডভান্স তো ফিরিয়ে দেওয়া যায়। দলে থেকেও যাওয়া যায়।’’

তাতে আমি বললাম, ‘‘তা হলে রন্টু যাবে না।’’

অঞ্জনদা রাজি হলেন রন্টুকে ছেড়ে দিতে। বললেন, ‘‘ঠিক আছে। এতটাই যখন অসুবিধা রন্টুকে সই করাচ্ছি না। কিন্তু বিকাশ তো সই করে ফেলেছে। ওকে ছাড়া যাবে না।’’

এ দিকে লালু আবার কোনও দিন রন্টুকে ছেড়ে খেলেনি। ও বলল, ‘‘অঞ্জনদা আমাকে রাখছেন ঠিক আছে। কিন্তু রন্টু নেই। আমি খেলবই না। একটা ম্যাচ খেলে বলব, পায়ে চোট। তখন দেখি, কে আমায় খেলায়।’’

তখন লালুকে না ছেড়ে আর উপায় কী!

চুক্তিটা ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে ইস্টবেঙ্গলের দুই ঘরের ছেলে আবার ঘরেই থেকে গেল।

আমরা বেরিয়ে একটা হোটেলে উঠলাম। সবাই মিলে একটাই ঘরে। সারা রাত সবাই জেগে। হুল্লোড় চলল সারাক্ষণ। ভোরবেলা গড়গড়িদাকে চটি কিনে দেওয়া হল। আর আমাকে পৌঁছে দেওয়া হল পিসির বাড়ি।

অনেক পরে আমি গড়গড়িদা-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘‘আচ্ছা, তুমি জানলে কোত্থেকে রন্টুকে সই করাতে অঞ্জনদা এসেছে।’’

গড়গড়িদা বলেছিল, ‘‘আমি একটা আঁচ পেয়েছিলাম। চটি পরিনি। জামাপ্যান্ট পাল্টানোরও সুযোগ পাইনি। সাততাড়াতাড়ি দমদম এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখলাম অঞ্জনদা ফ্লাইট ধরতে যাচ্ছে। তখন কোনও ক্রমে গ্রাউন্ডের লোকদের ম্যানেজ করে উঠে পড়েছিলাম প্লেনে।’’

১৯৯০ বছরটাও তো ছিল রন্টুর কাছে স্মরণীয়। ইস্টবেঙ্গলের ত্রিমুকুট জেতা থেকে কপিল দেবের হাত থেকে সেরা ফুটবলার হওয়ার ট্রফি পাওয়া। সব মিলিয়ে সে এক এলাহি ব্যাপার।

তার উপরে আবার ডিসেম্বরে আমাদের ছেলে রুব্বার জন্ম।


মাঠে নামার আগে অতি পরিচিত ভঙ্গিটি

• বিকাশ-কৃশানুকে অপহরণ

দলবদলের থাবা আবার পড়ল পরের বছর। ’৯১-তে।

রন্টু তখন ইস্টবেঙ্গলে। কথাও দিয়ে দিয়েছে লালহলুদেই থাকবে। হঠাৎ ইস্টবেঙ্গল-কর্তা নীতুদা (দেবব্রত সরকার) খবর পেল ওকে আর বিকাশকে মোহনবাগান তুলে নিয়েছে অফিস যাওয়ার পথে।

রুব্বা তখন সবে চার মাস। সারা দিন অঞ্জনদা ফোন করে আমাকে বোঝাতে লাগলেন, রন্টু যাতে মোহনবাগানে যায়। আমি কেবল একটা কথাই বলতে লাগলাম, আমার রন্টুকে ফেরত দিন। রন্টু আসলেই লালু থাকবে, এটা জানতামই।

বিকেলবেলা হঠাৎ দেখি নীতুদা সমেত ইস্টবেঙ্গলের আরও অনেক কর্তা ছ’টা গাড়ি নিয়ে আমাদের বাড়ি হাজির। আমার শাশুড়ির অনুমতি নিয়ে রুব্বাকে রেখে চললাম ওদের সঙ্গে। রন্টু-বিকাশের খোঁজে।

এক জন কর্তার বাড়িতে গেলাম। সঙ্গে রন্টুর ভাই টোটনও। কিছুতেই সেই কর্তা বলতে চাইলেন না কোথায় আছে ওরা।

তখন বাধ্য হয়ে পার্ক স্ট্রিট থানায় গিয়ে সোজা এফআইআর করে দিলাম। —‘‘আমার স্বামীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’’

তার পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যেই রন্টু-লালু ফিরে এল পার্ক স্ট্রিট থানায়। তখন রাত একটা বেজে গেছে। তবু ওদের উদ্ধার করে ক্লাব-কর্তারা প্রায় উৎসবে মেতে উঠলেন ওই রাতেও।

• ‘বিশ্বাসঘাতক’ ‘বিশ্বাসঘাতক’

পরের বছর, মানে ’৯২-তে আর ধরে রাখতে পারলাম না। কোনও এক প্লেয়ারের মধ্যস্থতায় ওদের ছিনিয়ে নিল মোহনবাগান।

ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা তাতে এতটাই রেগে গিয়েছিল যে বাড়ির বাইরে থেকে ঢিল ছুড়তে শুরু করল।

পাঁচ দিন টানা পুলিশি পাহারা নিতে হয় আমাদের। তাতেও পরিস্থিতি সামলানো যায়নি। অকথ্য গালিগালাজ। সাপোর্টারদের। ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলতেও ছাড়েনি কেউ।

এমনই একদিন।

বাড়ির বাইরে তখন থিক থিক করছে ইস্টবেঙ্গেল সাপোর্টার। ‘বিশ্বাসঘাতক’ ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে সবাই চিত্কার করে যাচ্ছে টানা। আমি সেদিন আর মাথা ঠিক রাখতে পারিনি।

ছুটে বারান্দায় গেলাম। আমার তখন হাতে একটা বোতল। যার মধ্যে রন্টুর ছিড়ে যাওয়া কার্টিলেজ রেখে দেওয়া।

উত্তেজনার বশে শুধু একটা কথাই বলেছিলাম, ‘‘যখন কার্টিলেজ ছিঁড়ে গেল তখন তোমরাই তো ওকে ল্যাংড়া বলেছিলে। মনে পড়ে না সেই দিনগুলো? এ বারের মতো ওকে মোহনবাগানে খেলতে দাও। আমি ঠিক ইস্টবেঙ্গলে ফিরিয়ে আনব ওকে। কথা দিচ্ছি।’’

দলবদলে তখন রন্টু-লালুকে নিয়ে কী যে উন্মাদনা হত! ঘোড়ার গাড়ি চড়ে সই করতে যাওয়া। সমর্থকদের পিঠে বসে সই করতে যাওয়া।

এখনকার দিনে এ সব ভাবা যায়!

• ইলিশ, ক্রিকেট আর ছেলে

এফসিআই থেকে অবসর নিলেও রন্টু চেয়েছিল কোনও বড় ক্লাব থেকে প্রিয় ফুটবলকে ও বিদায় জানাবে। সে আর হল কই!

এই আক্ষেপটা ওর সারা জীবন থেকে গিয়েছিল।

খেলা ছাড়ার পর ওর চোখের মণি ছিল শুধু ছেলে। সারাক্ষণ রুব্বার সঙ্গে খেলা করে যেত। অফিস ছুটি থাকলেই ছেলে আর ভাইপো রনিকে নিয়ে ছাদে ক্যাম্বিস বলে ক্রিকেট। নীচের ঘরে ক্যারম। সে চলছে তো চলছেই। কোনও অনুষ্ঠানে ‘প্রধান অতিথি’ হয়ে গেলেও ছেলেকে কাছছাড়া করত না।

পরের দিকে সিনেমা হলে বেশি যেত না। কিন্তু ছেলে এক বার আব্দার করলেই হল— ‘মমি রিটার্নস’, ‘জুরাসিক পার্ক’... বাদ যেত না কিছুই।

রুব্বা ওর প্রাণের চেয়েও প্রিয়। গায়ে হাত দেওয়া দূরে থাক, কোনও দিন বকাঝকাও করেনি ওকে।

খুব ভালবাসত ইলিশ মাছ। আর ক্রিকেট। অবসর নেবার পর এই দুইয়েও যেন পেয়ে বসেছিল ওকে।

শনিবার হলেই আমার বাপের বাড়ি চলে যেত। মায়ের হাতের রান্না খেতে খুব ভালবাসত। সে লাল শাকই হোক, কী আলুভাজা, সব কিছুই খেত।

চিকেনও পছন্দ ছিল, কিন্তু ইলিশ মাছটা পেলে ওর আর কিছু চাই না। জামাই ষষ্ঠী মানেই মা ইলিশ করতই করত। চেটেপুটে খেত রন্টু।

ও চলে যাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত আর ইলিশ মাছ রাঁধে না মা।

ইলিশের মতোই ক্রিকেট পেলেও তখন রন্টুকে দেখে কে!

ভারতের ম্যাচ হলেই ছেলেকে নিয়ে বসে যেত টিভির সামনে। সৌরভ, সচিনের ভক্ত রন্টু খেলার খুঁটিনাটি বোঝাতে শুরু করত ওই এক রত্তি ছেলেকে।

দেখে আমিও মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যেতাম, এক জন ফুটবলার কী করে এত ক্রিকেট পছন্দ করে!

সে সময় নানা রকম কাগজে ইউরোপিয়ান ফুটবল নিয়ে লেখালেখিও করত। রুব্বা তখন বড় হয়েছে। পাঠভবনে পড়ছে। বাবার কথা শুনে শুনে ডিকটেশন নিত ও।

বাবা ছেলেকে বোঝাত, কে কোন ফর্মেশনে খেলছে। কী রকম ম্যাচটা হতে পারে। আরও অনেক কিছু। রুব্বা হাঁ করে গিলত সব।

আবার সেই বাবা-ই অঙ্ক পরীক্ষার আগে রুব্বার মাস্টারমশাই হয়ে উঠত।

১৯৯৮। ফুটবল বিশ্বকাপ দেখতে গেল রন্টু। ফিরে এসে সে কী উত্তেজনা! বলল, ‘‘জিদান, বুঝলে, জিদান। আমার চোখে দেখা সেরা বিদেশি। উফ কী খেলা!’’

ব্যাগ ভর্তি করে চকোলেট নিয়ে এসেছিল সুইত্জারল্যান্ড থেকে। রুব্বা আগেই বলে রেখেছিল, ‘‘বাবি, যাচ্ছ যাও। কিন্তু আমার জন্য কিছু নিয়ে ফিরতে হবে।’’

• ভারত জিতল, হেরে গেল রন্টু

২০০২, সেপ্টেম্বর।

আমার কাছে জীবনের সবথেকে পোড়া মাস।

দার্জিলিংয়ে অফিসের খেলা খেলতে গিয়ে পা ভেঙে ফিরল রন্টু।

তখন জানতামও না পাঁচ মাস পরে জীবনের সব কিছুই ভেঙেচুরে যাবে। আমার স্বপ্নের রাজাকে চিরদিনের মতো হারাতে হবে। টানা ছ’মাস প্রায় ভুগল ও। কিছুতেই পুরোপুরি সুস্থ হচ্ছিল না।

মার্চের ১৩। হঠাৎ ব্লাড প্রেসার প্রচণ্ড কমে গেল ওর।

ল্যান্সডাউন নার্সিং হোমে ভর্তি করা হল ওকে। অবস্থা ক্রমে খারাপের দিকে।

নার্সিংহোম বদলিও করা হল। উডল্যান্ডস। তাতেও কিছু হল না।

ওকে পালমোনারি এমবলিজমে ধরল। জমাট রক্ত আক্রমণ করে বসল ফুসফুসে।

২০ মার্চ ২০০৩। দুপুরবেলা। আমার জীবনটা কালো করে দিয়ে চলে গেল আমার রন্টু। আমার ছোটবেলার সাথি। আমার স্বপ্নের নায়ক।

রুব্বা তখন ক্লাস সেভেন। ক’দিন বাদেই ফাইনাল পরীক্ষা। ওকে নার্সিংহোমে যেতে দেওয়া হয়নি। তখন বিশ্বকাপ ক্রিকেট চলছে।

ভারত সেমি-ফাইনালে উঠল। কেনিয়ার সঙ্গে খেলা। রুব্বা খুব চেয়েছিল বাবার সঙ্গে খেলা দেখবে। ইন্ডিয়া জিতবে। খুব আনন্দ করবে।

ইন্ডিয়া জিতল। কিন্তু ওর বাবার আর জেতা হল না!

ওই কঠিন দিনগুলোর কথা ভাবলে আজও শিউরে উঠি। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। আচমকা এক এক সময় আমাদের দোতলার বারান্দা থেকে রাস্তাটার দিকে তাকালে মনে হয়, ওই তো মাথা নিচু করে আমার রন্টু হেঁটে যাচ্ছে। এখনই চোখ তুলে চাইবে। আমায় দেখে হাসবে।


১৯৯০। দলবদল। ক্লাবের কড়া পাহারায় সই করতে যাওয়ার মুহূর্তে

• এত তাচ্ছিল্যও কি ওর পাওনা

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা কোনও দিন ভুলব না।

রন্টু চলে যাওয়ার দিন তিনেক পরে আনন্দবাজারে একটা খবর পড়েছিলাম। তাতে লেখা ছিল, বিশ্বকাপে ভারতের যাবতীয় পারফরম্যান্স রন্টুর নামে উত্সর্গ করেছে ভারতীয় দলের অধিনায়ক সৌরভ।

মন ভরে গিয়েছিল। শ্রদ্ধায়। ওই অন্ধকার সময়টায় দাঁড়িয়ে একটু হলেও আমাকে আনন্দ দিয়েছিল এই খবরটা।

পরে ইস্টবেঙ্গলে রন্টুর শোকসভাতেও এসেছিল সৌরভ। সেই প্রথম আমার ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে ঢোকা। সৌরভ আমাকে বলেছিল, রন্টুর খেলা কতটা ভালবাসত ও। ছোটবেলার নায়ককেই যেন হারিয়েছে ও।

দীর্ঘ বারো বছর কেটে গিয়েছে রন্টু নেই। এক সময় যারা ওর ঘনিষ্ঠ সতীর্থ ছিল, তারা এখন এক বারের জন্যও খোঁজ নেয় না। অদ্ভুত লাগে!

আর অসম্ভব খারাপ লাগে, যখন দেখি কত ফুটবলার চার-পাঁচ বছর খেলেও আজকাল সব অর্জুন পাচ্ছে। কিন্তু ‘ভারতীয় মারাদোনা’র আজ অবধি কপালে কিচ্ছুটি জুটল না।

ওর মূর্তিও বসবে শুনেছিলাম। তারও কী হল কে জানে! একটা বেনিফিট ম্যাচ পর্যন্ত হল না ওর জন্য। এতটা তাচ্ছিল্য কি পাওনা ছিল মানুষটার?

তবে আজও যখন কেউ শোনে আমি রন্টুর স্ত্রী, যখন বলে, ‘‘কৃশানুর খেলা আজও মনে পড়ে। ওর সেই ড্রিবল করতে করতে বেরিয়ে যাওয়া আজও ভুলিনি।’’ মনটা ভরে যায়।

মোহনবাগান হোক বা ইস্টবেঙ্গল, মাঠে গিয়ে সমর্থকদের সঙ্গে দেখা হলেই তারা বলে, ‘‘বৌদি মাঠে আসি। কিন্তু আর একটা কৃশানুকে দেখতে পাই না।’’ তখন চোখের জল যে কী কষ্ট করে চাপি, সে-শুধু আমি জানি।

সমর্থকদের এই ভালবাসা পাওয়া তো কোটি টাকার চেয়েও দামি। অনেক সম্মানের চেয়ে বড় সম্মান। খুব কম খেলোয়াড়ের সৌভাগ্য হয় এমন ভাবে সমর্থকদের মনে ঠাঁই নেওয়ার। রন্টু সে দিক থেকে তো ভাগ্যবান।

আমার প্রিয় রন্টু, তুমি যেখানেই থেকো ভাল থেকো।

অনুলিখন: সোহম দে

Krishanu Dey Sharmila Dey
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy