Advertisement
E-Paper

পদ্মের মাঝে বজ্র

ভগিনী নিবেদিতা বলতেন, ‘প্রেমের জন্যেই প্রেম, কর্মের জন্যেই কর্ম...’। ভারতের সেবাব্রতে তাঁর দুর্নিবার আত্মত্যাগ এই অনুভবকে সত্য করে তুলেছিল। লিখছেন হর্ষ দত্তভগিনী নিবেদিতা বলতেন, ‘প্রেমের জন্যেই প্রেম, কর্মের জন্যেই কর্ম...’। ভারতের সেবাব্রতে তাঁর দুর্নিবার আত্মত্যাগ এই অনুভবকে সত্য করে তুলেছিল।

শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৯ ০৮:৩৫
শিল্পী: বিমল দাস

শিল্পী: বিমল দাস

তাঁর মহান জীবন কোনও চিত্রকলা নয়। ফলে এই স্বল্প পরিসর ফ্রেমে তা ধরে দেওয়া অসম্ভব। সেই অপচেষ্টা থেকে বিরত হয়ে কয়েকটি পর্ব আমরা বেছে নিয়েছি। রক্তে আইরিশ, লোকমুখে ইংরেজ রমণী। বিবেকানন্দের সঙ্গে তাঁর লন্ডনে আলাপ। বয়সে তখনও তরুণী। ওয়েস্ট এন্ডের এক বৈঠকখানায় বিবেকানন্দের একটি অভিভাষণ শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল তরুণীটির। সময় ১৮৯৫, নভেম্বর। তাঁর পোশাকি নাম মার্গারেট এলিজাবেথ নোবল। যে জীবন তিনি এত দিন খুঁজছিলেন, যে সন্ধানী মন নিয়ে তাঁর আকুলতা কোথাও শমিত হতে পারছিল না, বৃত্তিতে শিক্ষয়িত্রী এই মহৎপ্রাণ অন্বেষণ করছিলেন তাঁর পরিসর, তাঁর আত্মোৎসর্গের সঠিক জায়গা, বিবেকানন্দের ধারাবাহিক আলোচনা চক্রে উপস্থিত থেকে তিনি পেয়ে গেলেন সেই মহানভূমির ঠিকানা— ভারতবর্ষ।

বিবেকানন্দ প্রথমে মার্গারেটকে নিরুৎসাহিত করেছিলেন। নিদারুণ দারিদ্রপীড়িত, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, ইংরেজ শাসনের উৎপীড়নে রক্তাক্ত দেশটিতে এসে, অনালোকিত নারীদের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে দিতে চাওয়া উইম্বলডনের এই শিক্ষিকাকে প্রবল ভাবে হতাশ হতে হবে। পরিষ্কার ভাষায় একটি চিঠিতে মার্গারেটকে লিখলেন, “এ-দেশে যে কী দুঃখ, কী কুসংস্কার, কী দাসত্ব— সে তুমি কল্পনাতেও আনতে পারবে না। এ-দেশে এলে দেখবে, চারদিকে অর্ধনগ্ন অগণিত নর-নারী, — ‘জাতি’ ও স্পর্শ সম্বন্ধে তাদের উদ্ভট ধারণা, শ্বেতাঙ্গরা মনে করবে, তোমার মাথা খারাপ, তোমার প্রতিটি গতিবিধি তারা সন্দেহের চোখে দেখবে। তা ছাড়া দারুণ গরম। আমাদের শীতকাল অধিকাংশক্ষেত্রে তোমাদের গ্রীষ্মকালের মতো। দক্ষিণে তো সবসময় আগুনের হল্‌কা। শহরের বাইরে ইউরোপীয় সুখস্বাচ্ছন্দ্য পাবার কোনও সম্ভাবনা নেই। ...এসব সত্ত্বেও যদি তুমি কর্মে প্রবৃত্ত হতে সাহস করো— স্বাগত তুমি, শতবার স্বাগত।”

স্বামীজির ওই ‘স্বাগত’ শব্দটিই মার্গারেটকে উদ্দীপিত করেছিল, ভারতের ভয়াবহ চরিত্রচিত্র নয়। নভেম্বর ১৮৯৫ থেকে তাঁর স্বপ্নযাত্রা ধরলে তা চূড়ান্ত হল জানুয়ারি ১৮৯৮-এ। ঠিক তিন বছর পরে মার্গারেট তখনকার বন্দর নগরী কলকাতার মাটিতে পা রাখলেন। কলকাতায় সে সময়ে শীতের আমেজ। শহরের কোনও ঘিঞ্জি অঞ্চলে নয়, আপাতত তখন তিনি থাকছেন চৌরঙ্গি অঞ্চলের একটি হোটেলে। ব্যবস্থাপনা অবশ্যই স্বামীজির। কোন হোটেল, তা এখনও জানা যায়নি। তবে যে জাহাজে মার্গারেট কলকাতায় এসেছিলেন, তার নাম ‘মোম্বাসা’। জানুয়ারির শেষ থেকে মার্চের একেবারে মাঝামাঝি সম্ভবত মার্গারেট কলকাতা ও চারপাশ ঘুরে দেখেছেন, তাঁর জীবনদেবতা বিবেকানন্দের অন্যান্য গুরুভ্রাতা ও অনুরাগীদের সান্নিধ্য লাভ করেছেন। সম্ভবত বলছি এই কারণে, ওই কয়েক মাসের মধ্যে লেখা নিবেদিতার কোনও চিঠি পাওয়া যায়নি। এর সম্ভাব্য কারণ, তখন মিস ম্যাকলাউড ও শ্রীমতী ওলি বুল ভারতে। বিবেকানন্দের বন্ধু ম্যাকলাউডকেই প্রাণ খুলে চিঠি লিখতেন মার্গারেট। সর্বাধিক পত্রপ্রাপিকার সঙ্গে তাঁর দেখাসাক্ষাৎ সে সময়ে যেখানে হাতের মুঠোয়, সেখানে পত্রপ্রেরণ অবান্তর। তবু এই পর্বে লেখা (১০ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৮) একটি চিঠিতে সমসময়ের ইতিহাস খানিকটা চিত্রিত করেছেন মার্গারেট। প্রাপক তাঁর অন্যতম বন্ধু নেল হ্যামন্ডের স্ত্রী। তাঁকে লেখা সেই চিঠিতে তিনি জানাচ্ছেন, “...মঙ্গলবার স্বামীজির সাক্ষাৎ পেলাম। গতকাল তাঁর অতিথি হিসাবে পিকনিক করলাম সুন্দর এক নদীর তীরে (গঙ্গাতীরে), যে-জায়গাটি মিস মূলার মঠ তৈরির জন্য স্বামীজিকে কিনে দিচ্ছেন। জায়গাটা ঠিক উইম্বলডন কমনের কোন একটি অংশের মতোই— গাছপালাগুলোকে খুব খুঁটিয়ে নজর না করলে তফাৎ ধরা পড়ে না।...” এখানে বলে রাখা ভাল, অন্তরঙ্গ বন্ধু নেল হ্যামন্ডকেই পরবর্তী সময়ে লেখা একটি চিঠিতে অকপটে মার্গারেট লিখেছিলেন, “Oh, Nell, Nell, India is indeed a holy land.”

এ বছরের মার্চ মাসেই তাঁর জীবনের দু’টি অবিস্মরণীয় ঘটনা ঘটে গেল। ১৭ মার্চ বাগবাজার পল্লির বোসপাড়া লেনের ১০/২ নং বাড়িতে তাঁর গুরুর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের সহধর্মিণী শ্রীমা সারদা দেবীর দর্শন লাভ করে তিনি ধন্য হলেন। সারদা দেবী তখনও প্রায় অবগুণ্ঠিতা, মৃদুভাষিণী, সর্বসাধারণের কাছে অপরিচিতা। শুধু শ্রীরামকৃষ্ণের ত্যাগী শিষ্য ও গৃহী ভক্তরা তাঁর অপার মাতৃত্ব একটু একটু করে উপলব্ধি করছেন। বিকশিত হচ্ছে সারদার বিশ্বমাতৃকা শক্তি। অন্তরালে নির্মিত হচ্ছে তাঁর সর্বগ্রাহ্য, সর্বজনীন জননীর রূপপ্রতিমা। মা সারদার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের দিনটি মার্গারেটের ভাষায় ‘Day of days’। শ্রীমা সম্পর্কে তাঁর মনে হয়েছিল, “তিনি অনাড়ম্বর, সহজতম সাজে পরম শক্তিময়ী মহত্তমা এক নারী।” সারা জীবন শ্রীমা সম্পর্কে এই পাবনীভাবনা তাঁকে প্রাণিত করেছিল। বলা যায়, নিবেদিতার অন্তরের নিভৃত কোণে জুঁইফুলের মতো বিরাজ করতেন সারদা, হৃদয়ে অমলিন শ্বেতপদ্মের মতো অধিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ, আর মননে-চিন্তনে, কর্মে বজ্রাগ্নির মতো প্রতিভাত হতেন বিবেকানন্দ।

শ্রীমা সারদা দেবীর সঙ্গে ভগিনী নিবেদিতা

মিস নোবলের জীবনে দ্বিতীয় এবং অভাবনীয় ঘটনার দিনটি এল ঠিক সাত দিন পরে অর্থাৎ ২৫ মার্চ। ওই দিন মার্গারেটকে নীলাম্বরবাবুর বাগানবাড়িতে অবস্থিত অস্থায়ী বেলুড় মঠে স্বামীজি দীক্ষা দিলেন। বিবেকানন্দের স্নেহাশ্রয়ে ও আন্তরিক উপদেশে প্রাণিত মার্গারেট শিবপুজো করলেন। খুব সংক্ষিপ্ত পুজো, মন্ত্র, স্তোত্র। ব্রহ্মচর্য ব্রতে দীক্ষিত বিদেশিনীর কাছে এই দিনও আর এক অভিধায় ভূষিত— ‘The day of Annunciation’। এই দিনটিতেই তো স্বর্গের দেবদূত যিশুজননী মেরিকে স্বপ্নে জানিয়েছিলেন— তোমার গর্ভে ঈশ্বর জন্মলাভ করবেন! দীক্ষার অন্তে মার্গারেটের হৃদয়ের ‘রাজা’ বিবেকানন্দ প্রত্যয়ের সঙ্গে তাঁর নতুন নাম রাখলেন— নিবেদিতা। মার্গারেট রূপান্তরিত, নিবেদিত হলেন, লাভ করলেন নবজন্ম। এখানে বলা যেতেই পারে, ১৮৯৮ সালের প্রেক্ষাপটে ‘নিবেদিতা’ নামটি ভীষণ ভাবে আধুনিক। ‘ডেডিকেশন’ যাঁর রক্তস্রোতে নিয়ত প্রবাহিত, তাঁকে এ ছাড়া আর কোন নামেই বা চিহ্নিত করা সম্ভব? তখনকার দিনে নারীদের নাম যেন পুরাণকল্পের সম্ভার কিংবা ছন্দের পারম্পর্য। তার চেয়েও বিপজ্জনক, চরিত্র বা ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সঙ্গতিবিহীন নামাবলি— তাতে না আছে সম্মান, না আছে মর্যাদা। এই সব ক’টি দিক বিচার করলে ‘নিবেদিতা’ নামটি অবিকল্প। কেননা স্বামীজি মর্মে মর্মে জানতেন, তাঁর এই মানসকন্যাটি সর্ব অর্থেই ‘আত্মাহুতির সমিধ’।

কে এই বিদেশিনী

যাজকদের মতো প্রায় পা অবধি ঢাকা শ্বেতশুভ্র গাউন, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, কোমরে দড়ির মতো পাকানো রিবন, মাথায় লম্বা চুল— তবে এলায়িত নয়, খোঁপার আকারে পিছনে বেঁধে রাখা চুলের গুচ্ছ। সমস্ত দেহ থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে সকালবেলার রৌদ্রদীপ্ত আলো। মুখ বিরক্তিহীন, জগৎ ও পারিপার্শ্বিকের প্রতি প্রসন্নতায় পূর্ণ। বৈরাগ্যের প্রতীক গৈরিক বসন তিনি কখনও পরেননি। বরং ব্রহ্মচর্যের নিষ্কলুষ পোশাককে সারা জীবনে মহত্তর করেছেন। পুরুষদের দেউড়ি থেকে মহিলামহল পর্যন্ত আলোচনার কেন্দ্রস্থলে তিনি। সমস্ত ঔৎসুক্যের নির্যাস প্রচারিত হতে সময় লাগল না। সংস্কারে আচ্ছন্ন উত্তর কলকাতার বোসপাড়া অঞ্চলের মানুষ জেনে গেল, এই বিদেশিনী বিবেকানন্দের শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতা বা সিস্টার নিবেদিতা। হিন্দু ধর্মের ‘টলারেন্স’ ও ‘অ্যাকসেপ্ট্যান্স’-এর চিরসত্যকে যিনি আমেরিকায় প্রতিষ্ঠা দিয়ে এসেছেন, এই তরুণীকে তিনিই নিয়ে এসেছেন এ দেশের সেবাব্রত সম্পাদনের জন্যে। তাঁরা এও জানলেন, এঁর ভিতরে তিনি জাগিয়ে তুলেছেন এক মহীয়সী সত্তা, যে সত্তার কাছে সিমলার নরেন দত্তের আহ্বান— “জগৎকে আলো দেবে কে? আত্মবিসর্জনই ছিল অতীতের ধারা; হায়! যুগ যুগ ধরে তা চলতে থাকবে! পৃথিবীর যারা বীরোত্তম ও সর্বোত্তম, তাদের আত্মোৎসর্গ করতে হবে ‘বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়।’ ...নিঃস্বার্থ, অগ্নিজলন্ত প্রেম যাঁদের মধ্যে— তাঁদের এখন জগৎ চায়। সেই প্রেম প্রতিটি উচ্চারিত শব্দকে বজ্র করে তুলবে।”

এত দূর জানার পরেও পল্লিসমাজের ভ্রুকুঞ্চন থেকেই গেল। কেননা এই নারী যে বিধর্মী, ম্লেচ্ছ, বিদেশ থেকে এসেছেন! এঁর ছোঁয়াছুঁয়িতে জাত রাখাই যে বড় দায়! রেনেসাঁস ঋদ্ধ কলকাতা তখনও এই ঘন অন্ধকারে আচ্ছাদিত। এখন গল্পের মতো শোনাচ্ছে। কিন্তু এটাই সত্যি। এর পরেও প্রশ্ন জাগে, চতুর্দিকের এই বিরূপতা, অসহযোগিতা, লুকোনো ঘৃণা, অপমানজনক চক্রান্ত সত্ত্বেও নিবেদিতা তাঁর কোন মাধুর্য, কোন সৌন্দর্যকে দৃপ্ত পদক্ষেপে ধূলিধূসরিত পথে পথে বয়ে নিয়ে নির্ভীক ভাবে চলতেন? এর উত্তরে মহান শিল্পী অবনীন্দ্রনাথের একটি আলাপচারিতার উল্লেখই যথেষ্ট। এক বর্ণময় বর্ণনায় নিবেদিতার বাহ্যিক ও অন্তঃস্থিত রূপকে তিনি ছবির মতো এঁকে দিয়েছেন। হ্যারিংটন স্ট্রিটে মার্কিন কনসুলেটে একটি সান্ধ্য আসরে আমন্ত্রিতদের মধ্যে নিবেদিতাও একজন। শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথের তুলিতে নিবেদিতা, “সন্ধে হয়ে এল, এমন সময় নিবেদিতা এলেন। সেই সাদা সাজ, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, মাথার চুল ঠিক সোনালি নয়, সোনালি রূপালিতে মেশানো, উঁচু করে বাঁধা। তিনি যখন এসে দাঁড়ালেন সেখানে কি বলব, যেন নক্ষত্রমণ্ডলীর মধ্যে চন্দ্রোদয় হল।... ‘সুন্দরী সুন্দরী’ কাকে বল তোমরা, জানিনে। আমার কাছে সুন্দরীর সেই একটা আদর্শ হয়ে আছে। কাদম্বরীর মহাশ্বেতার বর্ণনা— সেই চন্দ্রমণি দিয়ে গড়া মূর্তি যেন মূর্তিমতী হয়ে উঠল। ...সাজগোজ ছিল না, পাহাড়ের উপর চাঁদের আলো পড়লে যেমন হয় তেমনি ধীর স্থিরমূর্তি তাঁর। তাঁর কাছে গিয়ে কথা বললে মনে বল পাওয়া যেত। ...নিবেদিতার কি একটা মহিমা ছিল; কি করে বোঝাই সে কেমন চেহারা। দু’টি যে দেখিনে আর, উপমা দেব কি।”

১৬ নং বোসপাড়া লেন

প্রথমে ঠিক হয়েছিল, বোসপাড়া লেনের যে বাড়িতে মা ঠাকুরানি থাকেন, সেখানেই হবে নিবেদিতার আশ্রয়। কিন্তু এই প্রচেষ্টায় বাধা দিল তখনকার কলকাতার গোঁড়ামি। ব্রাহ্মণী সারদার সঙ্গে একই বাড়িতে নিবেদিতা! এ তো জাতধর্মের উপরে আঘাত শুধু নয়, সরাসরি সমাজবিরোধিতা! অথচ এই সমাজরক্ষকরা হয়তো জেনেও জানতেন না, এই বিদেশিনীকে সারদা দেবী নিজের মেয়ের মতো দেখেন, তাঁকে ‘আদরের খুকি’ বলে ডাকেন। শত ইচ্ছে থাকলেও নিবেদিতা বুঝতে পারছিলেন, বাধার পরিমাণ বিপুল। তা ছাড়া তিনি ভারতে এসেছেন নারীশিক্ষা বিষয়ে স্বামীজির স্বপ্নকে সাকার করে তুলতে। একটি ছোট বিদ্যালয় করতে হলেও তাঁকে অন্য বাড়ির সন্ধান করতে হবে। রক্ষণশীল সমাজের বিরোধিতাকে উপেক্ষা করে আর একটি বাড়ি খোঁজার চেষ্টায় বিবেকানন্দের অনুরাগীরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সমগ্র হৃদয় দিয়ে নিবেদিতা অনুভব করতেন, অজ্ঞ ও শিক্ষাশূন্য নারীজাতিকে শিক্ষাদানের মাধ্যমে জাগিয়ে তোলাই হবে তাঁর কর্মপ্রবাহের সূচনা। অনেক চেষ্টার পরে পাওয়া গেল বোসপাড়া লেনেই একটি বাড়ি। মা সারদার বাড়ির প্রায় উল্টো দিকে। ঠিকানা ১৬ নম্বর। বিরাট কোনও প্রাসাদ বা প্রাসাদোপম বাড়ি নয়। নিতান্তই মধ্যবিত্তের বাড়ি। দোতলায় শোওয়ার ঘর। পাঁচ ধাপওয়ালা সিঁড়ি। একতলায় দু’দিকে দু’টি ঘর। খিড়কি দুয়ার, মাঝখানে একটি ছোট উঠোন। বাগবাজারের জীবনযাত্রা ও এই সামান্য হতশ্রী বাড়িটিকে ভালবেসে ফেলেছিলেন নিবেদিতা। বাগবাজারও এর পরে গ্রহণ করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল তাঁর আন্তরিকতা, ভালবাসা, নিরবচ্ছিন্ন পরিশ্রম আর দীপ্র ব্যক্তিত্বকে। ১৬ নম্বর বাড়ির প্রতি তাঁর মমতার কথা নিবেদিতা লিখেছেন একটি পত্রে, “আমার বাড়িতে একটি আঙিনা আছে। ...বাড়ির মধ্যে এই জায়গাটি আমার আকাশ ও তারার সঙ্গে মিলনের স্থান। দিনের বেলা এখানে শীতল ছায়া বিছিয়ে থাকে, রাতে এটি হয়ে ওঠে অসীমের পূজামন্দির।”

১৬ নং বোসপাড়া লেন

বিবেকানন্দের আশীর্বাদ, অনুপ্রেরণায় নিবেদিতার স্কুল ধীরে ধীরে রূপ পরিগ্রহ করল। রক্ষণশীল হিন্দু পরিবার থেকে ছাত্রী জোটানোই হয়ে উঠেছিল প্রধান অন্তরায়। স্বামীজি একটি সভা করে তাঁর বন্ধুবান্ধব ও অনুরাগীদের নিবেদিতা-পরিকল্পিত বিদ্যালয়ে পাঠানোর অনুরোধ জানালেন। গুরুভাইদের দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বললেন, “এরপর দেখবি নিবেদিতার কার্যকরী শক্তি। নিবেদিতার প্রাণ অতি মহৎ। তার ভেতর কোথাও প্রতিষ্ঠা, যশঃ কি মুরুব্বিয়ানা নেই। তার হৃদয় অতি উদার, পবিত্র। জানবি, এর কথা শুনে সবার তাক লেগে যাবে। নিবেদিতা প্রাণ দিতে এসেছে, গুরুগিরি করতে আসেনি।”

অবশেষে এল সেই মহালগ্ন। ১৮৯৮ সালের ১৩ নভেম্বর। রবিবার। সে দিন কালীপুজো। ১৬ নং বাড়িতে এলেন স্বয়ং শ্রীমা। এলেন বিবেকানন্দ, ব্রহ্মানন্দ ও সারদানন্দ এবং আরও কেউ কেউ। প্রথাগত পূজাপাঠ সমাপন করে শ্রীমা সারদা মৃদুকণ্ঠে উচ্চারণ করলেন আশীর্বাণী, “আমি প্রার্থনা করি এই বিদ্যালয়ের ওপর জগন্মাতার আশীর্বাদ বর্ষিত হোক। এখান থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত মেয়েরা আদর্শ কন্যা হয়ে উঠুক।” স্কুলের নাম নিবেদিতা দিলেন ‘রামকৃষ্ণ স্কুল ফর গার্লস’। যদিও লোকমুখে প্রচলিত হল— সিস্টারের স্কুল। নিবেদিতার কাছে ‘ধ্রুবমন্দির’। দুঃখের বিষয়, অর্থাভাবে ১৮৯৯ সালে ১৬ নং বাড়ি নিবেদিতাকে ছেড়ে দিতে হল। অপর দিকে প্রাণঘাতী প্লেগরোগে আক্রান্ত কলকাতার সেবাকার্য ছেড়ে, স্বামীজির পরামর্শে টাকাপয়সার সংস্থান করার জন্য তিনি পাশ্চাত্যে চলে গেলেন। ফিরে আসার পরে (১৯০২) তিনি ভাড়া নিলেন ১৬ নম্বরের পিছনে অবস্থিত ১৭ নং বাড়ি। ১৯০৪-এ স্কুলের কাজ বেড়ে যাওয়ায় এবং পল্লির বিধবা এবং বাড়ির বধূদের জন্য ‘পুরস্ত্রী বিভাগ’ শুরু করার তাগিদে তাঁকে আবার ভাড়া নিতে হল ১৬ নম্বর বাড়ি। কিন্তু টাকার অভাব নিবেদিতার পিছু ছাড়েনি। অতএব পুনরায় ছেড়ে দিতে হল আদি বাড়িটি।

এই ১৬ ও ১৭ নম্বর বাড়িতে বাংলার বহু মনীষী এসেছেন কখনও স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে, কখনও নিবেদিতার হিতব্রতের আকর্ষণে, কখনও বা তাঁর আমন্ত্রণে। আলো-বাতাসবিহীন এমন একটি বাড়িতে তাঁর মতো তেজস্বিনী মনীষা কী ভাবে বাস করছেন? তাঁরা শিউরে উঠেছেন। অনেকেই তাঁকে আরও ভাল কোনও স্থানে বসবাস করার জন্যে উৎসাহিত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কারও কথাই এই সাধিকা, আরাধিকা শোনেননি। নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন ‘আমার মেয়েদের’ ভাল-মন্দের গহনে, ওই দু’টি বাড়ির ভূগোলে, ইতিহাসে, মানুষ নির্মাণের (Man making) যজ্ঞে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনন্যসাধারণ প্রবন্ধ ‘ভগিনী নিবেদিতা’য় অকপটে লিখেছেন, “আশৈশব তাঁহার সমস্ত সংস্কার ও অভ্যাসকে মূহূর্তে মুহূর্তে পীড়িত করিয়া তিনি প্রফুল্লচিত্তে দিনযাপন করিয়াছেন— ইহা যে সম্ভব হইয়াছে এবং এই-সমস্ত স্বীকার করিয়াও শেষ পর্যন্ত তাঁহার তপস্যাভঙ্গ হয় নাই— তাহার একমাত্র কারণ, ভারতবর্ষের মঙ্গলের প্রতি তাহার প্রীতি একান্ত সত্য ছিল, তাহা মোহ ছিল না। মানুষের মধ্যে যে শিব আছেন সেই শিবকেই এই সতী সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করিয়াছিলেন।” তথ্যের দিক থেকে বলা যায়, এ দেশের মনীষীদের মধ্যে নিবেদিতাকে যাঁরা কাছ থেকে নিবিড় ভাবে দেখেছেন, তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ অন্যতম। আর সম্ভবত প্রধানতম, রবীন্দ্রনাথেরই অন্তরঙ্গ সুহৃৎ বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু। নিবেদিতা ও জগদীশচন্দ্রের শ্রদ্ধাময়, পুণ্য সম্পর্ক আর এক দীর্ঘ ইতিহাস।

সংগ্রাম ও মুক্তির চিরপ্রতীক

প্রয়াত অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসু তাঁর শ্রমসাধ্য ও অপূর্ব বিশ্লেষণাত্মক মহাগ্রন্থ ‘নিবেদিতা লোকমাতা’য় নারীবজ্র নিবেদিতার সমগ্র চরিত্রের পরিচয় তুলে ধরেছেন এক একটি শব্দবন্ধে। তাঁর বিশ্লেষণে নিবেদিতা “শিক্ষাতাত্ত্বিক ও শিক্ষাব্রতী, শিল্পতাত্ত্বিক, বিজ্ঞান-সহায়ক, প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক, সমাজবিজ্ঞানী, বাগ্মী, রাজনীতিক, ভারতীয় সংস্কৃতির ব্যাখ্যাতা।” এর সঙ্গে আরও যুক্ত হতে পারে এই অভিধাগুলি— সাহিত্যস্রষ্টা, জাতীয়তাবাদী, সেবিকা, নিঃশঙ্ক চিত্ত, অনুবাদিকা, অসামান্য পত্রলেখিকা ইত্যাদি। মাত্র চুয়াল্লিশ বছর তাঁর জীবৎকাল, অথচ প্রতিভা এমন অগণিত যে, তাঁকে ছোট একটি রচনায় চিত্রিত করা দুঃসাধ্য। সে প্রচেষ্টার জায়গাও এখানে নেই। নিবেদিতার এই বহুমুখী প্রতিভার একটি অপূর্ব ব্যাখ্যা আমরা পাই সমাজতাত্ত্বিক বিনয় সরকারের একটি মন্তব্যে— “নিবেদিতা মানবতাবাদী, সর্বক্ষেত্রে কর্মী— দেশাত্মবোধক কার্য, শিক্ষা, রাজনীতি, জাতীয়তা, শ্রমশিল্প, ইতিহাস, নৈতিক সংস্কার, সমাজকল্যাণ, নারী-উন্নয়ন, এবং কীসে নয়! বাংলার গৌরবময় বিপ্লবের কালে (১৯০৫-১০) তরুণ বাংলার কাছে তাঁর নাম যাদুমন্ত্রের তুল্য। কলকাতায় ঐকালে প্রতিটি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছোটবড় যে-কোনো মানুষের তিনি সহযোগী। বিবেকানন্দ আর কিছু না ক’রে যদি কেবল নিবেদিতাকে এনে ভারতীয় কার্যাবলীর সঙ্গে যুক্ত ক’রে দিতেন, তাহলেও তাঁর কর্মজীবন সফল ও যুগসৃষ্টিকারী, একথা বলা যেত। নিবেদিতা ভারতের জন্য বিবেকানন্দের অলৌকিক আবিষ্কার। নিবেদিতা ভারতীয় জনগণের জন্য মহাসম্পদ।” দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনালগ্নে নিবেদিতার ভূমিকা কত দূর বিস্তৃত ছিল, তার পরিমাপই আমরা করিনি। দেশাত্মবোধে পূর্ণ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য তিনি অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সংশ্রব পর্যন্ত ত্যাগ করেছিলেন (১৯০২)। যদিও আত্মিক যোগ কখনও ছিন্ন হয়নি। ‘বজ্র’ চিহ্নকে তিনি বিপ্লব-আন্দোলনের প্রতীক মনে করতেন। তাঁর দৃষ্টিতে বজ্র উজ্জ্বলতম শক্তির উৎস, মুহূর্তের মধ্যে আত্মবলিদানে প্রস্তুত। বজ্র নিঃশঙ্ক, সতত আলোকময়। চেয়েছিলেন, স্বাধীন ভারতের জাতীয় পতাকায় যেন থাকে বজ্রচিহ্ন। এ কথা জোরের সঙ্গে বলার সময় এসেছে, আমরা নিবেদিতাকে যে ভাবে বিস্মৃত হয়েছি, তা বিস্ময়কর! বিবেকানন্দের সঙ্গে একই পঙ্‌ক্তিতে যাঁর নাম উচ্চারিত হয়, তাঁকে আমরা যথাযোগ্য মর্যাদায় শিক্ষাক্ষেত্রে তো নয়ই, জীবনের অন্য কোনও অন্ধকার ঘোচানোর কাজেও স্মরণ করিনি। অথচ ভারত তাঁর কাছে ছিল মাতৃভূমিরও অধিক। আমরা ছিলাম তাঁর আত্মার আত্মীয়। ‘INDIA’ শব্দটিই তাঁর কাছে আদ্যন্ত মন্ত্রস্বরূপ। ‘ভারত’ তাঁর কাছে উপাস্য দেবতা। এ আমাদের দুর্ভাগ্য। তাঁর নামে একটা সরু গলি, কী পার্ক, কী সেতু, কী বিশ্ববিদ্যালয় বাইরের দিক থেকে মূল্যহীন আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। এর বেশি কিছু নয়। নিজেদের জীবনচর্যায় আজও আমরা তাঁর বাণী ও আত্মত্যাগকে প্রয়োগ করার কোনও প্রচেষ্টা নিইনি। একমাত্র তাঁর রোপিত বিদ্যালয়টি নানা ঝড়-ঝাপটা সামলে আজ মহীরুহ। এই প্রতিষ্ঠান একশো কুড়ি বছরের উপরে নিবেদিতার নাম সম্মানের সঙ্গে রক্ষা করছে।

তাঁর প্রতি এই অপরিসীম উপেক্ষা নিবেদিতাকে কখনও স্পর্শ করবে না। আমরাই ছোট হতে হতে শূন্যে বিলীন হয়ে যাব। হয়তো অন্তিম মুহূর্তে হাহাকারের মতো মনে পড়বে, এক আলোকদূতীর হাতে অনির্বাণ আলো জ্বলে উঠেছিল, তা আমাদেরই শুভকামনায়! রবীন্দ্রনাথ তাঁর সেই বিখ্যাত প্রবন্ধে নিঃসংকোচে বলেছেন— “ভগিনী নিবেদিতা আমাদিগকে যে জীবন দিয়া গিয়াছেন তাহা অতি মহৎজীবন; তাঁহার দিক হইতে তিনি কিছুমাত্র ফাঁকি দেন নাই— প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তেই আপনার যাহা সকলের শ্রেষ্ঠ, আপনার যাহা মহত্তম, তাহাই তিনি দান করিয়াছেন, সেজন্য মানুষ যতপ্রকার কৃচ্ছ্রসাধন করিতে পারে সমস্তই তিনি স্বীকার করিয়াছেন। এই কেবল তাঁহার পণ ছিল, যাহা একবারে খাঁটি তাহাই তিনি দিবেন— নিজেকে তাহার সঙ্গে একটুও মিশাইবেন না— নিজের ক্ষুধাতৃষ্ণা, লাভলোকসান, খ্যাতিপ্রতিপত্তি কিছু না— ভয় না, সংকোচ না, আরাম না, বিশ্রাম না।” নিবেদিতার এই আত্মবলিদানকে আমরা গ্রাহ্যের মধ্যেই আনিনি। স্পষ্টতই চলমান সময় বলছে, বজ্রে যাঁর বাঁশি বেজে উঠেছিল, হৃৎপদ্ম যিনি মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করেছিলেন, সেই নিবেদিতাকে যথাযোগ্য স্থান দিতে বড্ড দেরি করে ফেলেছে এই দেশ ও দেশের মানুষ। অথচ ভারতই ছিল তাঁর প্রাণভূমি।

ছবি সৌজন্য: রামকৃষ্ণ সারদা মিশন সিস্টার নিবেদিতা গার্লস স্কুল, অদ্বৈত আশ্রম

Sister Nivedita Margaret Elizabeth Noble Swami Vivekananda
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy