Advertisement
E-Paper

স্মরণবিন

মান্না দে। ১ মে জন্মদিনের আগে তাঁর বহু স্মরণীয় গানের আঁতুড় ঘরের গল্প শোনাচ্ছেন দীর্ঘ দিনের সহযোগী সঙ্গীত পরিচালক শান্তনু বসুপড়োশন’ ছবির গান নিয়ে কাজ চলছে। ‘এক চতুর নার...’। এ গান এক দিনে হয়নি। মান্নাদা, কিশোরকুমার, মেহমুদ, বাসু মনোহারীদের নিয়ে একটা বড়সড় দল দিনের পর দিন বসেছেন রাহুলদেব বর্মনের বাড়িতে। সে দিনও সবাই এসে গেছেন। শুধু কিশোরকুমার নেই। আরডি-র বাড়ির কাজের লোক এসে মান্নাদাকে বলল, ‘‘আপনার ফোন আছে।’’

শান্তনু বসু

শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০৬
শ্রী৪২০

শ্রী৪২০

পড়োশন’ ছবির গান নিয়ে কাজ চলছে। ‘এক চতুর নার...’।

এ গান এক দিনে হয়নি। মান্নাদা, কিশোরকুমার, মেহমুদ, বাসু মনোহারীদের নিয়ে একটা বড়সড় দল দিনের পর দিন বসেছেন রাহুলদেব বর্মনের বাড়িতে।

সে দিনও সবাই এসে গেছেন। শুধু কিশোরকুমার নেই। আরডি-র বাড়ির কাজের লোক এসে মান্নাদাকে বলল, ‘‘আপনার ফোন আছে।’’

ফোনটা কিশোরকুমারের বাড়ি থেকেই। ফোনের ও পাশ থেকে কেউ এক জন খবর দিলেন, কিশোরকুমারের শরীর খুব খারাপ। আজ আসতে পারবেন না। উনি যেন রাহুলদেবকে খবরটা দিয়ে দেন।

শোনা মাত্র সবাই ঠিক করলেন, কিশোরকুমারের বাড়ি যাওয়া হবে। প্রায় ছ’-সাতটা গাড়ির কনভয় পৌঁছল ওঁর বাড়ি।

দরজা খুলতেই দেখা গেল, পায়ের ওপর পা তুলে খবরের কাগজ পড়ছেন স্বয়ং কিশোরকুমার। মান্নাদা অবাক হয়ে বললেন, ‘‘কী ব্যাপার কিশোর? তোমার নাকি খুব শরীর খারাপ!’’

শুনে মিটিমিটি হাসছেন কিশোরকুমার। আর খবরের কাগজটা এক বার করে নামাচ্ছেন। আবার মুখ ঢাকছেন। রাহুলদেব ঘরে ঢুকতেই তড়াক করে লাফিয়ে মাটিতে পড়ে তাঁর থুতনি ধরে নাড়িয়ে কিশোরকুমার বললেন, ‘‘মিউজিক ডিরেক্টর, না! তাই রোজ তোমার বাড়িতে সবাই যাবে রিহার্সালে। কেন আমাদের বাড়িঘর নেই। ইচ্ছে করেই তাই এমন ফন্দি করলাম, যাতে মিউজিক ডিরেক্টরকে আমার বাড়িতে আসতে হয়।’’

কলকাতার বাড়িতে বসে গল্পটা বলতে বলতে হো হো করে হেসে উঠেছিলেন মান্নাদা। তারপর বললেন, ‘‘এই হল কিশোর। এ তো তাও রেকর্ডিং-এর আগে। রেকর্ডিং-এর দিনে আবার অন্যরকম। এমন সব কাণ্ড করতে লাগল, যেগুলো রিহার্সালে করেনি। গাইব কী, শুধু ওকে দেখে যাচ্ছি। গানটা তৈরির সময় মনে হচ্ছিল, ওকে উড়িয়ে দেব। গান যখন শেষ হল, মনে হল, আমি কিছুই করিনি। যা করার ও করেছে। এক এক সময় মনে হচ্ছিল, গানটাকে ও নিজের সম্পত্তি করে ফেলেছে।’’

এলোমেলো কাজের শিরোনামে বারবার যদি আসেন কিশোরকুমার, তো খুঁতখুঁতে, পারফেকশনিস্ট চিত্র পরিচালক হিসেবে মান্নাদা খুব নাম করতেন রাজকপূরের।

ছবির নাম ‘শ্রী৪২০’। বৃষ্টির মধ্যে ছাতা মাথায় রাস্তায় হেঁটে চলেছেন রাজকপূর-নার্গিস। গাইছেন ‘পেয়ার হুয়া ইকরার হুয়া’। মান্নাদা-লতা মঙ্গেশকরের ডুয়েট।

ওই গানের মহলা চলছে রাজকপূরের রিহার্সাল রুমে। হাজির আছেন শঙ্কর-জয়কিষান, লতা মঙ্গেশকর, মান্নাদা, নার্গিস। সঙ্গে অবশ্যই রাজকপূর। গান চলছে। বিভোর হয়ে শুনছেন তিনি। মাঝে মাঝে ‘এক্সপ্রেশন’ নিয়ে কিছু বলছেন। হঠাৎ গান থামিয়ে দিলেন রাজকপূর। এক জনকে কাছে ডেকে কিছু একটা বললেন। কিছুক্ষণ বাদেই দেখা গেল, লোকটি ছাতা নিয়ে ঢুকলেন ঘরে। সবাই অবাক! নার্গিসকে ডাকলেন রাজকপূর। কিছু বললেন ওঁকে, তারপরই গান শুরু করার ইশারা। এ বার দেখা গেল, ছাতা নিয়ে রাজকপূর-নার্গিস ছবির দৃশ্যের অভিনয় করে চলেছেন। গানের রিহার্সাল চলল ও ভাবেই।

এ বার রেকর্ডিং। তার ঠিক আগে দেখা গেল, রাজকপূর যেন একটু আনমনা। গানটা দু’বার টেক-ও হল। তার পরেও বললেন, ‘‘সব ভাল হচ্ছে, কিন্তু কী একটা যেন নেই।’’ বোঝালেন, ওঁর পিকচারাইজেশনের ভাবনা অনুযায়ী প্রথম অন্তরার পরে একটা আলাপ বা কিছু একটা করে মুখরায় আসতে হবে। শুনে সবাই সাজেশন দিতে লাগলেন। রাজকপূরের মনে ধরছে না। শেষে মান্নাদা গুনগুন করে একটা আলাপ করতেই লাফিয়ে উঠলেন— ‘‘এই তো, এটাই চাই।’’ সেটাই রেকর্ড হল।

গানে লিপ দেওয়া নিয়েও রাজকপূরের অসম্ভব প্রশংসা করতেন মান্নাদা। ‘দিল হি তো হ্যায়’ ছবিতে ‘লাগা চুনরী মে দাগ’ যেমন। গানে তারানার একটা বড়় অংশ ছিল। মান্নাদা বলতেন, ‘‘রাজসাহেব এত নিখুঁত লিপ দিয়েছেন, মনে হয় নিজেই গাইছেন!’’

শচীন দেববর্মনের গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে। সাতসকালে মান্নাদার কাছে শচীনকর্তার ফোন।

তাঁর এক জন্মদিনে

‘‘আজ কি ফ্রি না কি রে ভাই?’’

‘‘আজ রেকর্ডিং নেই।’’

‘‘তোর লিগা দরবারির উপর একটা গান বাঁধছি। এক বারটি চইল্যা আয়।’’

দরাবারি। মধ্য রাতের রাগ। খুব মিষ্টি রাগ। মান্নাদার অসম্ভব পছন্দের। শচীনদেবের মুখে শুনেই রেওয়াজে বসে গিয়েছিলেন। না জানি কী গান পাবেন ওঁর কাছে!

বিকেলে কর্তার বাড়ি যেতেই শুনলেন, গানটা মেহমুদের লিপে যাবে। মান্নাদা আমায় বলেছিলেন, ‘‘দেখি একটা মজার গান শোনাচ্ছেন। বললাম, আরে আমায় কোনটা গাইতে হবে শোনান।’’

‘‘এই গানটাই গাইবি।’’

কী গান? ‘জিদ্দি’ ছবির ‘পেয়ার কি আগ মে তনবদন জ্বল গয়া’। দরবারি কানাড়ার মতো একটা ভাবগম্ভীর রাগে অমন কৌতুক গান কী করে যে বেঁধেছিলেন উনি! মান্নাদা বারবার বলতেন, ‘‘ওটা শচীনদার পক্ষেই সম্ভব।’’

‘পুছনা ক্যায়সে’ গানটার গল্প এক বার শুনলে ভুলতে পারা মুশকিল। ছবির নাম ‘মেরি সুরত তেরি আঁখে’।

রাত প্রায় সাড়ে ন’টা। বাড়ির পোশাকে শচীনকর্তা হাজির মান্নাদার ‘আনন্দন’-এ। তখন রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ। তাতে কী! শচীনদেব এসেই বললেন, ‘‘মনা, হারমোনিয়ামটা লইয়া বইস্যা বড়।’’ শেখালেন আহির ভৈরবী রাগের ওই গান। যাওয়ার সময় বললেন, ‘‘কাল রেকর্ডিং। গানটা তোর মতো করে যে ভাবে ভাল হয় গাইবি।’’

এ ছবির অন্য গান মহম্মদ রফিকে দিয়ে গাইয়েছিলেন শচীনদেব। তাতে মান্নাদার খুব অভিমান হয়েছিল। ‘পুছনা ক্যায়সে’ গাইতে হবে শুনে বলেছিলেন, ‘‘আবার আমায় কেন! বেশ তো রফি ছিল।’’ এক ধমকে থামিয়ে দিয়েছিলেন শচীনকর্তা, ‘‘তুই অত কথা কস ক্যান? এইডা তর গান। তুই-ই গাইবি।’’

যে বছর এই গান বেরোয়, সে বছর জাতীয় পুরস্কার ঘোষণার সময় শচীনদেব হাসপাতালে। মান্নাদা দেখা করতে গিয়েছেন। দেখামাত্র প্রশ্ন, ‘‘কী হইল, পাইলি তুই?’’

ঘটনাটা বলতে গিয়ে মান্নাদা আমায় বলেছিলেন, ‘‘আমার মুখে ‘না’ শুনে শচীনদা বললেন, ‘এই গানের পরও তরে দিল না! কথা শেষ হতে দেখি, শচীনদার চোখে জল।’’

রেকর্ডিং-এর সময় মান্নাদা বরাবরই খুব নিয়মনিষ্ঠ। রিহার্সালে যা করতেন, ‘টেক’-এ তার বাইরে যেতেন না। কিন্তু গান মনে ধরলে ওঁর একটা মেতে ওঠার ব্যাপার থাকত। তার প্রকাশগুলো এক-এক সময় এক-এক রকম হত।

সুরকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে শোনা একটা ঘটনা বলি। তিলোত্তমা ছবির ‘গোলাপের অলি আছে’ গানের রেকর্ডিং। অভিজিৎদা আমায় বলেছিলেন, ‘‘গান তো আগেই তুলিয়ে দিয়ে এসেছি। স্টুডিয়োতে এসে তবলিয়া রাধাকান্ত নন্দীকে পেয়ে গানটা নিয়ে এমন মেতে গেলেন, ভাবা যায় না। যতই বলি, চলুন রেকর্ড করা যাক। কেবলই বলেন, দাঁড়ান, আরেকটু পাকিয়ে নিই। এই করতে করতে রেকর্ডিং যখন শেষ হল, তখন দু’ঘণ্টা ওভারটাইম হয়ে গেছে। তখন আমি যে গানের সুরকার মনেই হচ্ছে না। যেন নিছক এক শ্রোতা।’’

এই সে দিন তরুণ মজুমদারের ‘ভালবাসার বাড়ি’র সঙ্গীত পরিচালনার কাজ করতে গিয়ে ফ্লোরে বসে আছি। তখন কথা প্রসঙ্গে নতুন গান নিয়ে মান্নাদার ‘মেতে ওঠার’ গল্প শোনালেন এই ছবির পরিচালক।— ‘‘গণদেবতা ছবির গান রেকর্ড করছি। বম্বের রাজকমল স্টুডিয়োয়। মান্নাবাবু এলেন গাইতে। হঠাৎ দেখি উনি স্পটরান করছেন। হেমন্তবাবু (মুখোপাধ্যায়) বললেন, ‘কী হচ্ছে?’’ হেসে মান্নাবাবু বললেন, ‘দাঁড়ান, দাঁড়ান এই গানটার আগে গা-টা একটু গরম করে নিই।’’

তরুণ মজুমদারের কথায় সে দিন ‘গণদেবতা’রই আরেকটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। মান্নাদার কাছে শোনা। বলেছিলেন, ‘‘হেমন্তবাবুর ডাকে বিকেলে ওঁর বাড়ি গেছি। দেখলাম তরুণবাবুও এসেছেন। ছবির গান তৈরি হচ্ছে। আমায় বাউলাঙ্গের একটা গান তোলাচ্ছেন হেমন্তবাবু। গানের মাঝে অদ্ভুতভাবে ঢুকে পড়ছিলেন তরুণবাবু। একটা সময় ওঁর চাহিদামতো এক্সপ্রেশন দিয়ে গানটা বোঝাতে লাগলেন। রাতে বাড়ি ফিরে হেমন্তবাবুকে ফোন করলাম, ‘কী মশাই কোনটা ফলো করব? আপনার আধুনিক বাউল, না তরুণবাবুর মেঠো বাউল?’ হেমন্তবাবু বললেন, ‘মাস্টারমশাই যা বলছেন, তাই করবেন।’’’ অসাধারণ ছবি হয়েছিল ‘গণদেবতা’। মান্নাদা খুব তৃপ্তি পেয়েছিলেন কাজ করে।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মান্না দে’র অদ্ভুত একটা সম্পর্ক ছিল। শ্রদ্ধার। অথচ অনেকেরই ধারণা তার ঠিক উল্টো। এক বার সরাসরি মান্নাদাকে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম। উত্তরে বলেছিলেন, ‘‘দূর, সব তৈরি করা গালগল্প। রটনা। অমন যাঁর কণ্ঠ, তাঁর সঙ্গে দ্বন্দ্ব করে কোনও লাভ হয় না। উনি স্বর্ণকণ্ঠী। যখন যে দিকে এগিয়েছেন, সোনা ফলিয়েছেন।’’

‘স্ত্রী’ ছবির রেকর্ডিং-এর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। স্টুডিয়োয় সেকেন্ড হাফে মান্নাদার কাজ। ফার্স্ট হাফে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সঙ্গীত পরিচালক নচিকেতা ঘোষ।

মান্নাদা একটু আগেই পৌঁছে গিয়েছেন। তখন ‘সাক্ষী থাকুক ঝরা পাতা’ গানের রেকর্ডিং করছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তার পরই ‘যেমন সাপিনীকে পোষ মানায় ওঝা’। আড়াল খুঁজে চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনছেন মান্নাদা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রেকর্ডিং শেষ হলে নচিকেতা ঘোষ খেয়াল করলেন মান্নাদাকে। বললেন, ‘‘চলুন এ বার আপনারটা ধরি।’’ প্রায় তন্দ্রাচ্ছন্ন মান্নাদা বিড়বিড় করে বলেছিলেন, ‘‘দাঁড়ান, দাঁড়ান। হেমন্তবাবুর এই গানের পর কি কোনও গান হয়!’’

নচিকেতা ঘোষের আরেকটি ঘটনা বলি। আগেরটির মতো এটিও সুপর্ণদার (সুপর্ণকান্তি ঘোষ) কাছে শোনা। সময়ের ব্যাপারে মান্নাদা ছিলেন অসম্ভব পাক্কা। ঘড়ি ধরে চলতেন। সে দিন নচিকেতা ঘোষের গানের রেকর্ডিং। গ্রামাফোন কোম্পানিতে।

মান্নাদা এসে অপেক্ষা করছেন। নচিকেতা ঘোষ আর আসেন না। রেগে যাচ্ছেন, বিরক্ত হচ্ছেন মান্নাদা। প্রায় ঘণ্টা তিনেক বাদে এলেন নচিকেতা ঘোষ। ওঁকে দেখেই মান্নাদা বলে উঠলেন, ‘‘কী ব্যাপার নচিবাবু, এত দেরি?’’ গম্ভীর গলায় উত্তর এল, ‘‘শুনুন, আপনাকে আজ যতটা অপেক্ষা করতে হল, আজকের গানগুলো শোনার জন্য মানুষ আপনার জন্য তার থেকে অনেক বেশি সময় অপেক্ষা করবেন।’’

দুপুর বারোটা নাগাদ কাজ শুরু হল। ছ’টার মধ্যে শেষ। তার মধ্যে চারটে গান— ‘যদি কাগজে লেখো নাম’, ‘ওগো বর্ষা তুমি ঝোরো না গো’, ‘এক জনই শুধু বন্ধু আমার’ আর ‘ভালবাসার রাজপ্রাসাদে’। আপ্লুত মান্নাদা। তখন রাগ বিরক্তি সব কোথায়! দু’জনে আবার সেই হরিহর আত্মা।

তারিখটা ছিল ৭ অগস্ট। নচিকেতা ঘোষের এক মেয়ের জন্ম দিন। মান্নাদাকে উনি বললেন, ‘‘চলুন, আজ বাড়িতে। মেয়ের জন্মদিন। একটু পানাহার করা যাক।’’

হঠাৎ মুম্বইতে সুধীন দাশগুপ্ত মান্নাদার কাছে গিয়ে হাজির। খুব অল্প কয়েকদিনের মধ্যে একটা রেকর্ডিং করে দিতে হবে। সঙ্গে লতা মঙ্গেশকরকেও চাই। লতাজিকে ফোনে ধরলেন মান্নাদা। রাজি হলেন লতাজি। কিন্তু মুশকিল হল, কোনও স্টুডিয়ো পাওয়া যাচ্ছে না। কোনও উপায় না দেখে শেষে মান্নাদা ওঁর বহু দিনের বন্ধু রেকর্ডিস্ট শর্মাকে ফোনে ধরলেন। ওঁর কাছে শুনলেন, বম্বে ল্যাব স্টুডিয়োয় কাজ করছেন নৌশাদসাব। যদি ওঁকে বলে কোনও সময় পাওয়া যায়।

নৌশাদ সব শুনে এক দিন সকালে দু’ঘণ্টার জন্য সময় করে দিলেন। ঠিক হল আটটা থেকে রেকর্ডিং হবে। মিউজিশিয়ানদের সেই অনুযায়ী বলা হল। সঙ্গে অনুরোধ, কেউ যাতে দেরি না করে। সাড়ে আটটার মধ্যে লতাজিও চলে এলেন। এগারোটার মধ্যে গান তোলা থেকে রেকর্ডিং সব শেষ। তা’ও আবার কি গান? ‘শঙ্খবেলা’ ছায়াছবির অলটাইম হিট— ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’!

ঘটনাটা আমি মান্নাদার কাছে শুনে কেমন থ হয়ে গিয়েছিলাম। ওই গান মাত্র তিন ঘণ্টায়!— ‘‘আপনারা কি আগে শিখে রেখেছিলেন?’’

উত্তরে মান্নাদা বলেছিলেন, ‘‘না, না, লতার তখন সময় কোথায়? ও কোনওরকমে একটা সময় বার করেছিল। আর আমি সুধীনবাবুর কাছে এক বার শুনেছিলাম। যা হওয়ার স্টুডিয়োতেই হয়েছিল।’’

লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে নিয়ে মান্না দে যে কত বার উচ্ছ্বসিত হতেন! কেবলই বলতেন, ‘‘ওই দুই বোন সিম্পলি আনপ্যারালাল। ওদের গান শুনলে কেবলই মনে হয়, শুধু শুনে যাই। অমন তো আর গাওয়া হবে না এ জীবনে।’’

কোনও একটা গান, কথাটা মনে নেই। লতাজির সঙ্গে রিহার্সালে বসেছেন মান্নাদা। সুরের মধ্যে একটা জায়গা আছে, যেখানে তীব্র মধ্যম লাগাতে হবে। মান্নাদা বলেছিলেন, ‘‘আমি বারবার চেষ্টা করছি। পারছি না। সুরের এমন চলন ছিল আমার গলা চলে যাচ্ছে শুদ্ধ মধ্যমে। অথচ লতা প্রতিবার ঠিক লাগাচ্ছে। এক সময় থাকতে না পেরে বলে ফেললাম, ‘তুম ক্যায়সে আরাহি হো? মুঝকো তো কুছ নেই আতা।’ উত্তরে সেই অননুকরণীয় মধুমাখা গলায় লতা বলল, ‘নেহি, নেহি মান্নাদা। আপ ক্যায়া বোল রাহে হ্যায়! অ্যায়সে অ্যায়সে যাইয়ে না....’ বলে আবার অবলীলায় গানটা গেয়ে দিল। বহু চেষ্টাচরিত্র করে তবে আমার সুরটা রপ্ত হল।’’ এক জন শিল্পীর কতটা উদারতা, কতটা শ্রদ্ধাবোধ, সম্ভ্রম থাকলে সহশিল্পীর এতটা প্রশংসা করা যায়!

আরেক জনকে নিয়েও মান্নাদা অসম্ভব উদ্বেল হতেন। সলিল চৌধুরী। সলিল চৌধুরীর অতি পরিচিত ধারার বাইরে যে ক’টা গান পাই, তার অন্তত একটা মান্নাদার গাওয়া। — ‘কুয়াশা আঁচল খোলো উসষী ঊষা’। ওই গানের রেকর্ডিং-এর গল্পও অদ্ভুত।

মান্নাদা বলেছিলেন, ‘‘আগের রাত অবধি জানি না, কী গান গাইব। পরের দিন দুপুর দুটোয় রেকর্ডিং। সলিল যখন আমার বাড়ি এলেন, তখন সকাল প্রায় এগারোটা। আমি কিছু বলার আগেই উনি গানটা পড়তে শুরু করলেন। বেশ কয়েক বার শোনার পর আমি বললাম, ‘কথা তো শুনলাম, সুরটা কী?’ সলিল বললেন, ‘হারমোনিয়ামটা নিন না।’ নিলাম। কিন্তু যখনই ওঁকে বলছি, সুরটা কেমন হবে, জিজ্ঞেস করছেন, ‘বলুন না, সুরটা কেমন হলে ভাল হয়?’ কিছুক্ষণ পরে বুঝলাম, ওঁর আমার ওপর সম্পূর্ণ ভরসা আছে। সেটা এমন একটা সময় যখন আমি মেহেদি হাসানের গজলে বুঁদ হয়েছিলাম। সলিলের কথা নিয়ে হারমোনিয়ামের রিডে হাত বোলাতে বোলাতে হঠাৎই চলে এল ওই ধাঁচের একটা সুর। সলিলকে শোনাতেই বললেন, ‘দারুণ হচ্ছে মান্নাদা।’ এ ভাবেই একটু চলতে চলতে সুর হয়ে গেল। সলিল ওয়াজ্ জিনিয়াস। আর অমন জিনিয়াসের পক্ষেই সম্ভব অমন সব কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলা। এমন শিল্পীর সঠিক মূল্যায়ন কি হল? জানি না।’’

সলিল চৌধুরীর আরেকটা গানের কথা মনে পড়ছে। কাবুলিওয়ালা ছায়াছবির ‘অ্যায় মেরে পেয়ারে বতন’। গান শেখা হয়ে গেছে। রেকর্ডিং-এ গেছেন মান্নাদা। ছবির পরিচালক বিমল রায় অদ্ভুত একটা আব্দার করে বসলেন। বললেন, ‘‘অনেকে এক ঘরে শুয়ে আছে। তার মধ্যে এক জনের দেশের কথা, ছোট্ট মেয়ের কথা মনে পড়ছে। সেই রকম সিচ্যুয়েশনে সে গানটা গাইবে। কিন্তু কাউকে বিরক্ত না করে।’’ শুনে মান্নাদা বলে ফেললেন, ‘‘সেটা কী করে সম্ভব, গান হবে, আবার কারও ঘুমের ব্যাঘাত হবে না!’’

তবু চ্যালেঞ্জটা নিয়ে নিলেন। গলাটাকে পুরো না ছেড়ে হালকা একটা টোন বার করে শোনালেন। রেকর্ডিং-এ বসে বহুকালের বন্ধু শর্মাজি অবাক— ‘‘ইয়ার তুমহারা আজ কেয়া হুয়া! কুছ শুনাই নেহি দেতা!’’ বিমল রায় সিগারেটে সুখটান দিয়ে অতি পরিচিত ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, ‘‘শর্মা, মান্না যো গা রাহা হ্যায়, ওহি চাহিয়ে।’’ গানটা শুনে শচীন দেববর্মন অভিভূত হয়েছিলেন। অদ্ভুত একটা মন্তব্যও করেছিলেন, ‘‘হ্যাঁরে, গানটা তুই গলার কোন দিক দিয়া গাইলি, ক’ তো। এই দিক দিয়া, না ওই দিক দিয়া?’’

মান্নাদা সারা জীবনে যা প্রশংসা পেয়েছেন, তার পাশাপাশি, অপমান আঘাত তো কম পাননি। বহু বার বিশ্বাসহীনতা, কৃতঘ্নতার শিকার হয়েছেন। আর অদ্ভুত, তার থেকেও বিচিত্র সব গান বেঁধে ফেলেছেন।

এক বারের কথা বলি। পুণেতে লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলাল নাইট। কে নেই সেখানে! মহম্মদ রফি, মুকেশ, লতা মঙ্গেশকর, মান্নাদা সবাই। অনুষ্ঠান বেশ কিছুক্ষণ চলার পর কোনও এক বিশেষ কারণে অভিমানবশত মান্নাদা ফিরে গেলেন হোটেলে। খুব বিধ্বস্ত। শরীরে, মনে। সময় আর কাটতে চায় না।

হঠাৎ পকেট হাতড়াতে হাতড়াতে একটা চিঠি হাতে পেলেন। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। চিঠির শেষে একটা গান লিখে পাঠিয়েছেন উনি। হারমোনিয়ামটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ভাঙা মন নিয়ে সুর বসিয়ে ফেললেন তাতে! বেদনাতুর ওই সুরের মধ্যে কোথাও মান্নাদার আঘাতের দাগটা আজও স্পষ্ট দেখতে পাই। গানটি ছিল— ‘এ তো রাগ নয় গো এ যে অভিমান’।

যে মানুষ অপমানে ভেঙে পড়েছেন এক-এক বার, ফুঁসেও উঠেছেন অন্য কোনও সময়।

২০০৬ সালে একটি রেকর্ড কোম্পানি থেকে মান্নাদার গানের সিডি বেরোল। কোনও বিজ্ঞাপন নেই। প্রচার নেই। খুব কষ্ট পেয়েছিলেন।

আবার উল্টোটা দেখুন। ’৫৭-’৫৮ সালের ঘটনা। সেই একই কোম্পানি। পুজোর গান রেকর্ডিং হবে। ঠিক করলেন রেকর্ডের এক দিকে থাকবে ‘এই কূলে আমি ওই কূলে তুমি’, অন্য পিঠে ‘চাঁদের আশায় নিভায়ে ছিলাম’। কোম্পানির কর্তা প্রথম গানটি শুনে মন্তব্য করলেন, ‘‘এটা কোনও গান! এ একেবারে আপ টু দ্য মার্ক নয়।’’ শুনে এত খেপে গিয়েছিলেন মান্নাদা, মুখের ওপর বলে দিয়েছিলেন, ‘‘শুনুন, যদি এই গান করেন তো করবেন, আমি নতুন কোনও গান গাইতে পারব না।’’ মান্নাদার জেদের কাছে হার মেনে ছিলেন কর্তাটি। ভাগ্যিস মেনেছিলেন!

বেঙ্গালুরুতে মান্নাদার কাছে শেষ বার যাওয়ার ছবিটা আজও আমার চোখে ভাসে। অসহায় রোজনামচার সে যে কী ভয়ঙ্কর সময়, তাও কিনা জীবনের উপান্তে! কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলছিলেন বারবার। গলা বুজে আসছিল। এক বার জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘এখনও কোনও বিশেষ গান মনে আসে?’’ প্রৌঢ় কিংবদন্তি উত্তরে বলেছিলেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গান আজও আমাকে যে কোথায় নিয়ে যায়! কী সব তৈরি করে গেছেন উনি!’’ বলেই অশক্ত গলায় গাইতে লাগলেন, ‘কাল রাতের বেলায়...’।

গলা সায় দিচ্ছে না। কিন্তু ভাবের কোথাও খামতি নেই এতটুকু। এর পরেই ধরলেন, ‘তুমি একটু কেবল বসতে দিয়ো কাছে/ আমায় শুধু ক্ষণেক তরে/ আজি হাতে আমার যা কিছু কাজ আছে/আমি সাঙ্গ করব পরে।’

দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে হু হু করে। সুরের সঙ্গে কান্না মিশে চাপা হাহাকারে ভরে যাচ্ছে চারপাশ! তখনও বুঝতে পারিনি ওঁকে এ দেখাই আমার শেষ দেখা হয়ে থাকবে!

(সাক্ষাৎকারভিত্তিক রচনা)

manna dey shantanu bose singer music director Kishor Kumar sachin dev burman Hemanta Kumar Mukhopadhyay padosan
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy