বাঙ্ময়: রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজ। সম্প্রতি দেবভাষায়
লাইন বা রেখাই তাঁর একমাত্র প্রিয় সড়ক। প্রথম থেকেই যে পথে তাঁর গমনাগমন। ধীর মৃদুল, অথচ দৃঢ় কিন্তু আশ্চর্য এক প্রত্যয়ের পথ চলা তাঁর। তবু তাঁর ছবি চতুর্গুণ সমন্বয়ের চিত্রকল্প। প্রধানত চারটি বিশেষ গুণই চিত্রের অহঙ্কার ও আশ্চর্য এক অলঙ্কারও। ভলিউম, রিদম, পোয়েটিক লাইনস, কালার হারমনির সাহায্যে এক-একটি চিত্র যেন ধ্রুপদী জলসার এক নীরব আহ্বান। রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রায় ৫০টির কাছাকাছি ছবি নিয়ে দেবভাষা কর্তৃপক্ষ একটি প্রদর্শনী সম্পন্ন করলেন সম্প্রতি। নির্বাচিত কাজগুলিই শুধু নয়, তারও বহু আগে থেকেই ওই চতুর্গুণের সমন্বয়কে তিনি সন্তর্পণে আগলে রেখে, সৃষ্টির নীরব এক মগ্ন চৈতন্যে থিতু হয়ে আছেন। যখন শুধু মাত্র রেখাপ্রধান কাজ করছেন, রং যেখানে অনুপস্থিত—সেখানেও কিন্তু কাব্যিক রেখার গতিময়তার আলাপে ছন্দের বিস্তার মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন। এই ছন্দের ভেতরে-বাইরেও কখনও আয়তন-সর্বস্বতা ছবিকে মহার্ঘ করেছে।
প্রায় সবই অবয়বপ্রধান ছবি। স্পেস তাঁর কাছে বরাবর এমন এক পট— পটুয়া হিসেবে তিনি শুরুর লাইন ও থামিয়ে দেওয়া লাইনের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেন অন্য তিনটি গুণ। তৈরি হয় নিবিড় এক কাব্যিক দ্যোতনায় বিবিধ ছন্দের চালচলন, যা সম্পূর্ণ আয়তনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, কিন্তু অসীম। এই অসীমের মধ্যেই আত্মগোপন করে থাকে আরও অব্যক্ত কিছু। যেন নৈর্ব্যক্তিক অথচ শূন্য স্পেসটুকু রেখে দেন, যেন ওখানেই চিত্রের আরও অর্থবহ দৃশ্যকল্প অপেক্ষা করে আছে।
এই প্রদর্শনীতে রামানন্দ প্রধানত ড্রাই প্যাস্টেল, অয়েল প্যাস্টেল, ব্রাশ, নিব, পেন-ইঙ্ক, জলরং, চারকোল ইত্যাদি ব্যবহার করেছেন। প্যাস্টেলের যে নিজস্ব গুণ, তাকে চওড়া, প্রয়োজনে সরু ভাবে ব্যবহার করে আকাশ, জমি, ধান, ছোট গাছ, আবার জলরং চাপিয়ে টিলা বা গাঢ় খয়েরি পাহাড়ের আদল দিয়েছেন।
তিনি কি এ ছবি আঁকার আগে আল মাহমুদের ‘প্রত্যাবর্তন’ মনে রেখেছিলেন? হয়তো না। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে মিলে যায় ওই গভীর লাইন।
‘আমরা কোথায় যাবো, কতোদূর যেতে পারি আর/ ওই তো সামনে নদী, ধানক্ষেত, পেছনে পাহাড়/ বাতাসে নুনের গন্ধ, পাখির পাঁপড়ি উড়ে যায়/ দক্ষিণ আকাশ জুড়ে সিক্ত ডানা সহস্র জোড়ায়।’
খুদে গণেশই জননীক্রোড়ে কত রকম ভাবে বিন্যস্ত। মায়ের বিনুনি ধরে খুনসুটি করা ছবিতে সাদার ব্যবহার অসামান্য। ইঁদুর, কাঁচুলি, গণেশ-মস্তক ও পরনের কাপড়ে এই বর্ণসংশ্লেষ আপাত হালকা লালচে কমলা ও খয়েরি বিস্তারের মাঝে যেন এক সাঙ্গীতিক অনুরণন। ‘স্তন্যপায়ী গণেশ’ ছবিটিতে ভলিউম-সর্বস্ব শরীরী ছন্দের স্বল্প রেখা সমগ্র ড্রয়িং ও বাদামি বর্ণের মেদুরতাকে আলঙ্কারিক করেছে। গণেশের একক বাহাদুরির ড্রয়িংগুলি ভলিউম ও লাইনের যুগলবন্দি। বাদামি, খয়েরি, হলুদ, সবুজের আলাপ থেকে ঝালার ঝঙ্কার অবিশ্বাস্য। কাব্য, ছন্দ এ সব ছবির সার্চলাইটের আলো।
যামিনী রায়, কালীঘাট পট, লৌকিক শিল্পের গ্রাম্য সরল রূপ কোথাও যেন প্রত্যক্ষ হয়। ওই সব সরণি ধরেই তাঁর আজকের এই নিজস্ব ভুবনে প্রবেশ।
এই সারল্যময় অথচ তীক্ষ্ণ, সুচারু রেখার স্পন্দন বারবার তাঁর ছবিকে সচকিত করে। চেনা, কখনও অচেনা নতুন এক ছন্দকে আহ্বান করেন আয়তন-সর্বস্ব অবয়বের বহিরঙ্গে। বর্ণবিন্যাসের নিরীহ ব্যাপ্তি কিন্তু ওই প্যাস্টেল বা জলরঙের মেদুর ও ভীষণ রকম তারল্যে সীমাবদ্ধ। যেন ওই বর্ণচূর্ণ সমূহকে কাগজের টেক্সচারের উপরে কোমল ভাবে ঘষে একটি টোন তৈরি করে, তার উপর সমস্ত রকম লাইনে সৃষ্টি করেন জাদু-বাস্তবতা।
আসলে ড্রয়িংয়ের অন্তর্নিহিতে এই পৌত্তলিকতাসদৃশ স্টাইলাইজ়েশন একান্তই তাঁর দীর্ঘ কালের অধ্যয়ন ও অধীনতা। কালো প্যাস্টেলের চওড়া দিক ঘষে, সরু লাইনে যে নগ্ন মানবীর একলা বসে থাকার ছবি আঁকেন, সেখানেও চকিতে আল মাহমুদ—
‘আমার সৌন্দর্যে এসো শরীর জঘন/ অসহ আগুনে নিত্য জ্বলে যেতে চায়/ নটীর মুদ্রার মতো মন আর স্তন...।’
সাহসে, আঘাতে, স্পর্শে এ কাব্য কি রামানন্দের অবগত নয়? অনায়াস এই চলন তাঁর শিল্প-চৈতন্যকে যে আলো-বাতাস দিয়েছে, যে ছায়ার বিস্তার দিয়েছে, বর্ণ-আস্তরণের যে মোহিনী চমক দিয়েছে, তা ভোলার নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy