Advertisement
E-Paper

পাটের দালালিও করেছেন

অর্থাভাবে। পঙ্কজ কুমার মল্লিকের প্রথমজীবন এমনই অদ্ভুত সব কাহিনিতে মোড়াঅর্থাভাবে। পঙ্কজ কুমার মল্লিকের প্রথমজীবন এমনই অদ্ভুত সব কাহিনিতে মোড়া

শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০৫

শুধু গানের টিউশানি করে বড় পরিবারের খাঁই আর মিটছিল না।

বন্ধু পশুপতির দোকানে দর্জির কাজ শুরু করলেন। রেলের অফিসে কেমিস্টও হলেন।

শেষমেশ বাবার ইচ্ছেয় বড়বাজারে ‘তুলসীদাস কিষণদয়াল’-এ পাটের দালালির কাজ নিলেন পঙ্কজ কুমার!

এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। বাবা মণিমোহন ছিলেন সে কালের নামকরা বিলেতি কোম্পানি বার্কমায়ার ব্রাদার্সের বড়বাবু। যথেষ্ট স্বচ্ছল তাঁর পরিবার।

নিত্যদিন ব্রিটিশ কর্তার বিনা কারণে অপমান আর গঞ্জনা সইতে না পেরে এক সময় চাকরিটাই ছেড়ে দেন মণিমোহন। সাহেব মালিকের সঙ্গে বচসা করে চাকরি ছেড়েছেন, তাই পরাধীন ভারতে অন্যত্র ভাল কাজও পেলেন না। দিনে দিনে অবসাদে আক্রান্ত হলেন তিনি। শেষ জীবনে পুজোপাঠেই সময় কাটাতেন।

বাবা-মায়ের চতুর্থ সন্তান পঙ্কজ তখন সবে সতেরো। দাদা মনোজ কিছু দিন আগেই মারা গিয়েছেন কালাজ্বরে। আয় করার মতো সংসারে বড় আর কেউ নেই। স্নাতক হওয়ার আগেই তাই কলেজ ছাড়তে হল। তার পরেই সংসারের জোয়াল কাঁধে। অর্থাভাবে এক সময় মা মনমোহিনীর গয়নাও বেচতে হয়েছে।

সতেরো-আঠারোটা বাড়ি গান ফিরি করে বাড়ি ফিরেছেন কখনও মধ্য রাতে। ফিরে দেখতেন মা জেগে বসে আছেন না খেয়ে। সকলকে দিয়েথুয়ে অল্প একটু দুধ বাঁচিয়ে রেখেছেন ছেলের জন্য। ছেলের এ দিকে সারা দিন গান গেয়ে গলা চিরে গেছে। ওই দুধটুকু মুখে দিলেও মুখ দিয়ে রক্ত উঠত।

কালে কালে গানই হয়ে উঠল যাঁর জীবন, শৈশবে তাঁকে গান শিখতে কম চড়াই পেরোতে হয়নি।

ছোট থেকেই পঙ্কজ গান-অন্ত প্রাণ। কিন্তু ছেলের এই গান-প্রীতি মণিমোহনকে চিন্তায় ফেলত। শাসন করতেন। তবু ‘গান-রোগ’ ছেলের কোনও দিন যায়নি।

মণিমোহনের জন্ম এক বণিক পরিবারে। কিন্তু ক্রমে তিনি বৈষ্ণব হয় ওঠেন। জগন্নাথের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন বাড়িতেই। দীক্ষাও নেন। সেই সূত্রেই পুজোপার্বনে, বিশেষ করে রথযাত্রার সময় বাড়িতে কীর্তন, ভজন হতই। ছোট্ট পঙ্কজ সেই সব গান গলায় ধরে মা-পিসি-কাকি-জেঠিদের শোনাত। তাঁরা মুগ্ধ হতেন। ভক্তিমূলক গানে মণিমোহনের কোনও আপত্তি ছিল না।

দশের দশকের গোড়াতেই পঙ্কজের স্কুলে ভর্তি হওয়া। সিটি ইনস্টিটিউশন মাইনার স্কুল। আর প্রথম বছরেই অনেক লোকের সমাবেশে হঠাৎই গান গাওয়ার সুযোগ।

ইংরেজ-রাজা পঞ্চম জর্জ ও তাঁর স্ত্রী রানি মেরী কলকাতায় আসবেন। তাঁদের সম্মান জানাতে তখন স্কুলে-স্কুলে সাজো-সাজো রব।

পঙ্কজের স্কুলের এক শিক্ষক রীতিমতো রাজবন্দনা করে গান লিখে ফেললেন— ‘হে ভারত আজি রাজার চরণে কর রে ভকতি দান’। গানটি গাইবার জন্য তিনি অনেকের মধ্যে পঙ্কজকেই বেছে নিলেন।

শৈশবে এ গানের কথা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি পঙ্কজ। পরে বলতেন, ‘‘তখন তো গান গেয়ে অভিবাদন পাওয়া আর সেজে গুজে মার্চপাস্ট করে ঠোঙা ভর্তি মুড়ি খাওয়ার আনন্দে মশগুল।’’

বড় হয়ে যখন অর্থ বুঝেছিলেন, লজ্জা পেয়েছিলেন খুব। বিশেষ করে যখন তিনি রবীন্দ্রনাথ, চিত্তরঞ্জন দাশ, মহাত্মা গান্ধীর সান্নিধ্য পেলেন।

স্কুলে গান গেয়ে ছেলে প্রশংসা পেয়েছে শুনে বাবা এ বার আর রাগ করলেন না। বরং একটু গর্বই হল তাঁর।

এই ঘটনার সময় বাড়িতে ছিলেন পঙ্কজের মেজো জামাইবাবু। তাঁর খুব গানের শখ। শ্বশুরবাড়ি এলেই তিনি শ্যালক-শ্যালিকাদের জড়ো করে আশপাশ থেকে একটা হারমোনিয়াম এনে একের পর এক গান শোনাতেন। পঙ্কজের গান গাওয়ার কথা শুনে তিনি কয়েকটি থিয়েটারের গান শেখানোর পরামর্শ দিলেন।

থিয়েটারের গান! শুনেই ছোট্ট পঙ্কজ ভয়ে একশা। বড়রা শুনলে বলবে কী! জামাইবাবু আশ্বস্ত করে বললেন, গানগুলো ঠাকুরদেবতার। ‘জয়দেব’, ‘কমলেকামিনী’, ‘বলিদান’-এর মতো উচ্চবর্ণ নাটকের।

গান শেখানোর সময় জামাইবাবু লক্ষ করলেন সঙ্গীতে পঙ্কজের আশ্চর্য ক্ষমতা। ‘জয়দেব’ গীতিনাট্যের বিখ্যাত গান ‘এই বলে নুপূর বাজে’ শেখানো সবে শেষ হয়েছে, পঙ্কজ তখনই পুরো গানটা হুবহু গেয়ে দিল! স্তম্ভিত জামাইবাবু আরও কিছু গান শেখালেন থিয়েটারের। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়েরও খানকতক।

জামাইবাবু গাইতেন হারমোনিয়াম বাজিয়ে। তাঁকে দেখে পঙ্কজেরও খুব শখ হারমোনিয়াম বাজানোর। কিন্তু হারমোনিয়াম কোথায়! তখন তো আর ঘরে-ঘরে হারমোনিয়াম নেই।

সে সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। পঙ্কজদের বাড়ির কাছেই থাকতেন তাঁর ছোটকাকার বন্ধু শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ। পঙ্কজের শৈলেনকাকা।

শৈলেনবাবু তখন কিছু দিন মেসোপটেমিয়ায় (আজকের ইরাক) চাকরির জন্য যান। বিদেশে যাওয়ার আগে তাঁর ঘরের চাবিটা রেখে গিয়েছিলেন পঙ্কজের মায়ের কাছে।

শৈলেন কাকার বিদেশযাত্রার কিছু পরেই পঙ্কজের খেয়াল হল, তাঁর ঘরেই একটা হারমোনিয়াম দেখেছে সে। তাতেই তো হাত পাকানো যায়!

কিন্তু চাবি যে মায়ের কাছে! পঙ্কজ জানে, মা কিছুতেই চাবি দেবেন না। তাকে সাহায্য করলেন তার এক বিধবা পিসিমা। পঙ্কজের যাবতীয় আদরে-আবদারে তিনিই ছিলেন সহায়।

পিসিমা সব শুনে বললেন, মায়ের আলমারি থেকে চাবি এনে দেবেন ঠিকই, কিন্তু শর্ত আছে। শৈলেনকাকার ঘরে আর কোনও জিনিসে পঙ্কজ যেন হাত না দেয়। এর পর সুযোগ পেলেই চলতে লাগল পঙ্কজের হারমোনিয়াম নিয়ে সাধনা। প্রথম দিকে কিছুতেই বাগে আসছিল না সুর। বহু কসরত করে এক সময় নিখুঁত বাজিয়ে ফেলল ‘এই বলে নুপূর বাজে’। এর পর যা যা গান শিখেছিল একে একে সব ক’টা।

তত দিনে বাড়িতে গান নিয়ে নিষেধাজ্ঞার আবহাওয়াটা একটু একটু করে শিথিল হল। গান গাইতে সরাসরি উৎসাহ হয়তো আসত না, কিন্তু তেমন বাধা আর দিতেন না কেউ। গ্রামাফোনে কলের গান শোনাও চালু হল বাড়িতেই। সকলে এক জোট হয়ে শুনতেন পান্নাময়ী, কে মল্লিক, মানদাসুন্দরী, নরীসুন্দরী…।

মেসোপটেমিয়া থেকে শৈলেনকাকা ফিরলেন। পঙ্কজ আগেই ঠিক করে রেখেছিল, যা হয় হোক, তাঁকে সব খুলে বলবে সে। পঙ্কজের কথা শুনে রাগ তো দূরের কথা, তাকে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান শোনাতে বললেন তিনি। গাইল পঙ্কজ।

এত আপ্লুত হলেন শৈলেনবাবু হারমোনিয়ামটি দিয়েই দিলেন পঙ্কজকে।

বাড়ির সব চেয়ে বড় অনুষ্ঠান রথযাত্রা। আট দিন ধরে চলত। নামী গায়করা আসতেন। কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত, রামপ্রসাদী, নিধুবাবুর টপ্পা হত।

এমনই এক অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে আনলেন পঙ্কজের এক পিসতুতো দাদা। তিনি তো গাইলেনই, কিন্তু অনুষ্ঠানে পঙ্কজের গান শুনে দুর্গাদাস অভিভূত। নিজে এগিয়ে গিয়ে তিনি মণিমোহনকে বললেন, পঙ্কজকে গান শেখাবেন।

দুর্গাদাসের গানের ইস্কুল ‘ক্ষেত্রমোহন সঙ্গীত বিদ্যালয়’-এ শুরু হল পঙ্কজের গান শেখা। এর পর পঙ্কজের গানজীবনে এলেন রবীন্দ্রনাথ, দিনেন্দ্রনাথ থেকে কৃষ্ণচন্দ্র দে।

এরকমই এক সময় মণিমোহনের সংসারে শুরু হল আর্থিক সংকট। তবু সেই জীবনেও পঙ্কজের এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে গেল।

ফিরছিলেন ‘তুলসীদাস কিষণলাল’-এর পাটের দালালির কাজ সেরে। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি। দেখতে দেখতে কলকাতা ভেসে গেল।

বড়বাজার থেকে হাঁটতে হাঁটতে কোনও ক্রমে ক্যানিং স্ট্রিট ধরে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ মোড়ের কাছাকাছি পৌঁছলেন। বৃষ্টির তোড় তখন আরও জোর।

মালকোঁচা মারা ধুতি, পাঞ্জাবি সামলে কোনও মতে একটা গাড়ি বারান্দাওয়ালা বাড়ির নীচে দাঁড়ালেন। পাশাপাশি মানুষ, কুকুর, গরু ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে। ভিড়ের ঠেলাঠেলি থেকে বাঁচতে গাড়িবারান্দার নীচে এক ডাক্তারবাবুর ডিসপেন্সারির রোয়াকে উঠে দাঁড়ালেন পঙ্কজ।

ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কখন যে আনমনা হয়ে গান ধরেছেন, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়/এমন ঘন ঘোর বরিষায়’…।

হঠাৎ পিঠে আলতো টোকা। ফিরে দেখেন সাদা স্যুট পরা এক ভদ্রলোক। নাম বললেন, ডঃ রামস্বামী আয়েঙ্গার। ওই ডিসপেন্সারিরই মালিক।

ভদ্রলোক পঙ্কজকে ভেতরে ডাকলেন। ঘরে বসে একটু বাদেই তিনি বললেন, অল্প আগে পঙ্কজের গলার গুনগুন করে গান তাঁর কানে গেছে। পঙ্কজ যদি পুরো গানটা তাঁকে গেয়ে শোনান।

সম্পূর্ণ অপরিচিত এক জনের কাছে এমন পরিস্থিতিতে এই আব্দার, পঙ্কজকে প্রথমে একটু অস্বস্তিতে ফেললেও গানটি গাইলেন তিনি। গান শেষে আরওই অবাক হওয়ার পালা। দেখেন ডাক্তারবাবু নিজে প্রথম কলিটা গেয়ে উঠেছেন!

ডাক্তারির পাশাপাশি তিনি নাকি গানেরও চর্চা করেন। ঘরোয়া অনুষ্ঠানে গাইতেও যান।

হঠাৎ চমকে দিয়ে ডাক্তারবাবু বললেন, ‘‘উড ইউ লাইক টু ব্রডকাস্ট? কলকাতায় নতুন রেডিয়ো স্টেশন হয়েছে— ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি। আমার জানাশোনা আছে, যদি গাইতে চান তো বলুন।’’

এই ঘটনার সপ্তাখানেক পরেই ডা. রামস্বামীকে দেখা গেল পালকি করে উত্তর কলকাতার চালতাবাগানে যুগল কিশোর দাস লেনে মল্লিকদের বাড়ির সামনে নামছেন।

লক্ষ্য, ও দিনই ও-বাড়ির ছেলে পঙ্কজকে তিনি কলকাতা হাইকোর্টের কাছে টেম্পল চেম্বারের বাড়িতে বেতার-অফিসে নিয়ে যাবেন!

Pankaj kumar mullick jute jute trader durga puja patrika tution
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy