• মাঝে মাঝে বেশ ক্লান্ত লাগত রঞ্জার। কাজের চাপ বা আবহাওয়ার দোহাই দিয়ে ব্যাপারটা মোটেও গম্ভীর ভাবে দেখেননি তিনি। রুটিন হেল্থ চেকআপের পরে দেখা গেল রঞ্জার হিমোগ্লোমিনের মাত্রা ছয়!
• ছিপছিপে চেহারার সঞ্জয় একবারে দু’প্লেট বিরিয়ানি দিব্যি খেয়ে ফেলতে পারেন। অফিসের সকলেই মেনে নিয়েছেন এটা সঞ্জয়ের ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা। কিন্তু রুটিন মেডিক্যাল চেকআপের পরে সঞ্জয়ের মাথায় হাত। কোলেস্টরল ৩০০ ছাড়িয়েছে, ট্রাইগ্লিসারাইডও সেই পথে।
• প্রেগন্যান্সির সমস্যা নিয়ে চিত্রা ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পরে এবং কয়েকটি পরীক্ষা করার পর জানতে পারলেন, তাঁর ওভারিতে সিস্ট বাসা বেঁধে আছে।
• রজত নিয়ম করে যোগব্যায়াম আর ডায়েট ফলো করেন। শরীরে সে রকম কোনও সমস্যা নেই। অফিসের মেডিক্যাল টেস্টের পর জানা গেল তাঁর কোলনে ক্যানসার। (ব্যক্তিনাম পরিবর্তিত)
‘‘এই রকম কেসের কথা বলে শেষ করা কঠিন। এখন আর রোগ বুড়ো বয়সের জন্য অপেক্ষা করে না। সদ্য তিরিশের যুবকের কার্ডিয়ো অ্যাটাক, পঁয়তাল্লিশে হাঁটু প্রতিস্থাপন, পঁচিশেই হাই কোলেস্টরল বা ডায়াবেটিস, স্পন্ডিলোসিস এখন আকছার। স্বাস্থ্য সচেতন হওয়া মানে শুধু কড়া ডায়েট বা নিয়মিত শারীরচর্চা নয়। এগুলো তো করতেই হবে, পাশাপাশি তিরিশ পেরোলেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বছরে এক বার হেল্থ চেকআপ করানো জরুরি। মলমূত্র, রক্তপরীক্ষা কিংবা ইসিজি, চোখ, নাক, কান, দাঁতের পরীক্ষা— আশা করা যায়, এতেই শরীরে বাসা বাঁধা রোগ ফাঁদে পড়বে। মনে রাখবেন, প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিয়োর,’’ বললেন চিকিৎসক চয়ন গঙ্গোপাধ্যায়।
এক নজরে
‘‘জেনারেল হেল্থ চেকআপের পরে আমাদের এখানে যে সমস্যাগুলো বেশি পাওয়া যাচ্ছে তা হল, কার্ডিয়ো সমস্যা এবং গলস্টোন। ১০০ জনের মধ্যে ৯৫ জনের ফ্যাটি লিভার পাওয়া যাচ্ছে। বেড়েছে দাঁতের সমস্যাও,’’ জানালেন নাইটিঙ্গল হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ। একটু অন্য চিত্র পাওয়া গেল কোয়াড্রা মেডিক্যাল সার্ভিস প্রাইভেট লিমিটেডের কর্তৃপক্ষের কথায়, ‘‘এখানে জেনারেল চেকআপের পরে সমস্যাগুলির মধ্যে সিংহভাগ জুড়ে আছে ক্যানসার। কয়েক বছরের মধ্যে মহিলাদের স্তন, জরায়ু ও পুরুষদের প্রস্টেট ক্যানসারের মাত্রা বেশ বেড়েছে। এদের মধ্যে অধিকাংশ ছোটখাটো কোনও সমস্যা নিয়ে হেল্থ চেকআপ করিয়েছিলেন। তবে প্রথম স্টেজে ধরা পড়ায় চিকিৎসা শুরু করে দিতে পেরেছেন অনেকে। তাঁদের অনেকেই আজ সুস্থ। আমাদের এখানে পেট (PET) স্ক্যানের ব্যবস্থাও আছে।’’ আবার ‘‘কর্পোরেট প্যাকেজ, কার্ডিয়ো বা ডায়াবেটিক প্যাকেজের পাশাপাশি শুধু মাত্র মেয়েদের জন্য কিছু প্যাকেজ আছে আমাদের। এখানে জেনারেল প্যাকেজ শুরু হচ্ছে ২০০০ টাকা থেকে,’’ বললেন উডল্যান্ডস মাল্টিস্পেশ্যালিটি নার্সিংহোমের কর্তৃপক্ষ।
প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিয়োর
সুষম আহার ও নিয়মিত শারীরচর্চার পাশাপাশি এই ‘প্রিভেনশন’-এর তালিকায় অবশ্যই রাখতে হবে বছরে এক বার হেল্থ চেকআপ। বিশেষ করে যদি ঘাড়ে ভীষণ ব্যথা, মাঝে মাঝে জ্বর, টানা কাশি, বারবার টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন হয়, ক্রমাগত ওজন বেড়ে বা কমে যায়, তখন অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে চেকআপ করা উচিত। এখন যে ধরনের জীবনযাত্রায় আমরা অভ্যস্ত, তাতে অধিকাংশ চিকিৎসক মনে করেন শরীরে অসুবিধে থাক বা না থাক, বছরে এক বার হেল্থ চেকআপ করা দরকার। সরকারি হাসপাতালে ব্যবস্থা থাকলেও তা সময়সাপেক্ষ। রুটিন চেকআপের ব্যবস্থা আছে প্রতিটি বেসরকারি হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলিতে। ‘বেসরকারি হাসপাতাল মানেই অনেক খরচ’— ধারণাটি একেবারে কল্পনার উপরে দাঁড়িয়ে নেই। এ ব্যাপারে নাইটিঙ্গলের ডিরেক্টর সোনালি ঘোষাল বললেন, ‘‘বেসরকারি হাসপাতাল শুনলেই মানুষ ভয়ে পিছিয়ে আসেন। তার একটা কারণ হল অতিরিক্ত বিলের বোঝা। কিন্তু ব্যতিক্রমও আছে। আমাদের হাসপাতালে একাধিক প্যাকেজ আছে। কোনওটা কার্ডিয়ো বা ডায়াবেটিকদের জন্য। ওভারঅল হেল্থ চেকআপের জন্য বেসিক প্যাকেজ আছে। তাতে রক্ত, মলমূত্র, ইউরিক অ্যাসিড পরীক্ষা, ইসিজি থাকে। খরচ ১২০০ টাকার মধ্যে।’’ শুধু কলকাতা নয়, বাংলার বিভিন্ন জেলা, সিকিম, উত্তর-পশ্চিম ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে প্রচুর মানুষ নাইটিঙ্গলে চিকিৎসা করাতে আসেন। এই সংস্থার স্রষ্টা (বর্তমানে সিএমডি) শ্যামলেন্দু ঘোষাল ১৯৮৯ সালে যখন শুরু করেন, তখন নাইটিঙ্গল ছিল স্রেফ একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার। ‘‘কলকাতায় সে সময়ে এত ডায়াগনস্টিক সেন্টার ছিল না। তবে সেই সময়ে কলকাতার মধ্যে সবচেয়ে উন্নত মেশিন এখানেই ছিল। আমাদের কাছে এটা শুধু ব্যবসা নয়। সেবা আমাদের মূল উদ্দেশ্য,’’ বললেন সোনালি। ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে ২০০৬ সালে ১০০ বিছানার হাসপাতালে পরিণত হয় নাইটিঙ্গল। এখন অবশ্য বিছানার সংখ্যা অনেক বেশি। ‘‘এখানে ইন্দ্রজিৎ সর্দার, সুকুমার মুখোপাধ্যায়, সলিল পাঁজা প্রমুখের মতো বিশিষ্ট ডাক্তার আছেন। সরকারি হাসপাতালের অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তাররা এখানে কাজ করেন। তাঁরা প্রায়শই নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কেস নিয়ে আলোচনা করেন। অকারণে ওষুধ বা পরীক্ষা করতে দেন না। আমাদের হোর্ডিংজোড়া বিজ্ঞাপনের দরকার পড়ে না। লোকমুখেই প্রচার হয়ে যায়। বিল তৈরির ক্ষেত্রে আমরা ভীষণ সচেতন। ভুল যাতে না থাকে তার জন্য বারবার খুঁটিেয় দেখা হয়। বলতে পারেন, আমরা নিঃশব্দে কাজ করে যাই। বাঙালি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা গর্বিত,’’ কণ্ঠে আত্মপ্রত্যয় সোনালির। নাইটিঙ্গল কর্তৃপক্ষ জানালেন, ‘‘এখানে ব্রেনের সিটি স্ক্যান হয় ১৮০০ টাকায় এবং এমআরআই-এর খরচ ৬০০০ টাকা। কিন্তু সরকারি হাসপাতালের রোগীদের জন্য সিটি স্ক্যান ৮০০ টাকা, এমআরআই ৩৪০০ টাকায় দেওয়া হয়।’’ শ্রীমতী ঘোষাল দুঃখ করে বললেন, ‘‘মানুষের মধ্যে সচেতনতার বেশ অভাব। অনেকেই চিকিৎসার ফলোআপ করেন না। কেউ কেউ ওষুধও ঠিক মতো খান না। ফলে রোগ আরও জটিল হয়। বারবার অসুস্থ হয়ে পড়েন।’’ চিকিৎসা সম্পূর্ণ না করার সমস্যা যে প্রকট, তা স্বীকার করলেন উডল্যান্ডস এবং কোয়াড্রা কর্তৃপক্ষও।
তাই আর দেরি না করে বছরে এক বার হেল্থ চেকআপ করান। জেনে নিন, আপনার মধ্যে কোনও সমস্যা আছে কি না। প্রথম পর্যায়ে ধরা পড়লে তা নির্মূল করে ফেলা যায় চিকিৎসার মাধ্যমে।
মডেল: মোনালিসা, তৃণা
ছবি: দেবর্ষি সরকার
মেকআপ: মৈনাক
লোকেশন: ভর্দে ভিস্তা ক্লাব, উপহার বিল্ডিং, চকগড়িয়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy