Advertisement
E-Paper

কেশদামে ডানা মেলে কল্পনার পাখা

আত্মমর্যাদার ধ্রুপদী প্রয়োগের অন্যতম প্রকাশ হল স্থৈর্য। তারই প্রতিবেদনে নারীশক্তির এক একটি রূপ ফুটে উঠেছে, যার মূল ভিত নারীর কোমল আঙিনা।

পিয়ালী গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০২৫ ১০:১১

দক্ষিণ কলকাতার আর্ট হাইভ গ্যালারিতে তিন দিনের প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল সম্প্রতি, শিল্পী নাতাশা দত্ত রায়ের কাজ নিয়ে। তিনটি সিরিজ় মিলিয়ে কাজের সংখ্যা ছিল মোট ২৬টি। সব সময়ে চিৎকার করে নয়, বরং শান্ত ভাবেও যে তীব্র প্রতিবাদ করা যায় কোনও অন্যায়ের, শিল্পীর সেই বিশ্বাস থেকে জন্ম নিয়েছে তাঁর ‘ইকোস অব এসেন্স’। নারীবন্দনার মাধ্যমে ধ্বনিত হয়েছে নারীর মধুর অভিব্যক্তির জয়গান। ব্যতিক্রম শুধু একটি মাত্র ছবি, ‘সন্ধিকাল’, যেখানে মায়ের রুদ্রমূর্তি ধরা পড়েছে, যা সচরাচর আমরা দেখে থাকি।

আত্মমর্যাদার ধ্রুপদী প্রয়োগের অন্যতম প্রকাশ হল স্থৈর্য। তারই প্রতিবেদনে নারীশক্তির এক একটি রূপ ফুটে উঠেছে, যার মূল ভিত নারীর কোমল আঙিনা। গভীর, অগভীর বর্ণে (অ্যাক্রিলিক) আলোছায়া এসেছে শিল্পীর কাজে। আপাতদৃষ্টিতে প্রকৃতির ট্যাপেস্ট্রিকে চুলের বুননে মার্জ করার চেষ্টা করেছেন নাতাশা। বিষয়ের তাৎপর্য নিয়ে নারীর কেশগুচ্ছ সম্পর্কে শিল্পীর ভাবনা বেশ স্পষ্ট। তাঁর বক্তব্য হল, মেয়েদের চুল নিয়ে নানা সমস্যা, মতামতের সম্মুখীন হতে হয় নিয়ত। খুব লম্বা চুল হলে বলা হয় এলোকেশী। রাত্রিবেলা বেরোলে চুল বেঁধে রাখতে বলা হয়, নয়তো ‘উড়নচণ্ডী’ আখ্যা পেতে হয় নারীকে। আবার চুল ছোট করে কাটলেও হাজার কথা। এই সব সংস্কারজনিত কটূক্তির শিকার কমবেশি অনেকেই। যে জায়গায় নিষেধের এত বেড়াজাল, সেটিকে পেরিয়ে গিয়েই শিল্পীর এই আত্মদর্শনের প্রকাশ। নারীর অদম্য চেতনার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।

তিনটি স্বতন্ত্র বিভাগে নির্ধারিত ‘মনপাখি’, ‘নিত্যশক্তি’ ও ‘ট্যাপেস্ট্রি অব লাইফ অ্যান্ড নেচার’। ‘মনপাখি’ সিরিজ়ে প্রতীকী পথে প্রেমের যাত্রা। ‘নিত্যশক্তি’ আবার উদ্‌যাপন করে নারীশক্তির মৌলিক দিক। শেষের সিরিজ়টিতে প্রকৃতি ও নারীর মধ্যে গভীর সংযোগ তৈরি করা হয়েছে।

শিল্পী নাতাশা দত্ত রায়ের জন্ম অসমের সবুজ চা বাগানে। শান্ত, মনোরম পরিবেশে বেড়ে ওঠা। সেখানেই তাঁর শিল্পশিক্ষা শুরু। গুরু শ্যামল সেনের কাছে টানা সাত বছর শিল্পের পাঠ নেওয়া। এর পরে দর্শন নিয়ে পড়তে আসেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্যাম্পাসেই পেয়ে যান পেন্টিং ক্লাব। সোশ্যাল ওয়ার্কে মাস্টার্স করে, কাজের সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয় তাঁকে। তবে কোভিডে সেই দৌড়নো যায় থেমে। ধীরে ধীরে আবার ছবির জগতে ফেরা। এ ভাবেই তৈরি হতে থাকে তাঁর নারীকেন্দ্রিক বিভিন্ন চিন্তার চিত্রপট।

আত্মার স্বাধীনতাকে প্রতিনিধিত্ব করে ‘মনপাখি’ ছবির দল। পাখির গুরুত্ব এসেছে এখানে নারীর আবেগের রূপক হিসেবে। ‘আলাপন’ (২৪”/২৬”) ছবিটিকে একটি অন্য স্বাদের উপহার বলা যেতে পারে। নারীর কপাল ও পাখির নীলাভ রং বিশেষ ব্যঞ্জনায় মুগ্ধতা আনে। পটভূমিতে জ্বলজ্বল করছে মৃদু হলুদের উষ্ণতা। দু’জনের ভঙ্গিতে প্রকাশ পায় প্রতিশ্রুতির বন্ধন। ‘অভীপ্সা’ ছবির বর্গাকৃতি সাপোর্ট, লাল-নীল রঙের বিনিময়ে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। অন্যান্য রং পরিবেশিত হলেও এই দু’টি রঙের ব্যবহার, ন্যূনতম হলেও দামি হয়ে ওঠে। নারী ও পাখির নীরব সংলাপ উদ্বেগের মধ্যেও ভঙ্গুর এক ভারসাম্যকে ধারণ করে। নীল-ধূসর ও বাদামি টোনে প্রেমের আশঙ্কা মিশে যায় ‘অভিশঙ্কা’র প্রেক্ষিতে।

জীবন ও প্রকৃতির ট্যাপেস্ট্রি নিয়ে পুনর্নবীকরণের প্রত্যাশায় গড়ে ওঠে বোঝাপড়ার এক কাঠামো। ‘দি ইটারনাল ফ্লো’ রচিত হয় প্রকৃতি ও নারীর সংযোগ নিয়ে। জলপ্রপাতের মতো কেশবিন্যাস, নারীর স্বাধীন সত্তা ও কালজয়ী প্রাণশক্তির কথা ঘোষণা করে। পাশাপাশি ছবির নীল-সবুজ ও হলুদের মিশেল, চিরন্তন বনানীর রূপকথা হয়ে ওঠে। ‘হারমনি অব এলিমেন্টস’ প্রকৃতির সুরেলা সারাংশ নিয়ে চিত্রিত। আকাশে হলুদ প্রতিমার মুখ। মেঘসদৃশ চুলের স্পর্ধায় উড়ে যাওয়ার ক্ষমতার স্বপ্ন দেখেন নারী। আবার ভাসমান হয়ে নিরীক্ষণও করেন। তখন তিনি একজন জননী। সন্তানসহ শিকড়ের চালিকাশক্তি। আর একটি চিত্রকর্মে (‘রিদম অব লাইফ’) ময়ূরপঙ্ক্ষী রঙের আকাশ। তার নীচে গভীর দিগন্তরেখা। ছবির একেবারে সম্মুখে হলুদরঙা জীবন। ডান দিক ঘেঁষে রয়েছে এক পার্শ্ববর্তিনী, যার উড়ন্ত জটিল বেণিতে যেন অভিজ্ঞতাগুলি লেপ্টে থাকে, একে অপরের সঙ্গী হয়ে। ফ্যান্টাসি প্রায় সব ছবিতেই ছড়িয়ে আছে। প্রতিটি কাজেই শিল্পীর সৎ প্রচেষ্টা স্পষ্ট, যা বাস্তবিকই আশাপ্রদ।

শেষ সিরিজ় ‘নিত্যশক্তি’। আদিশক্তি দেবীরূপ প্রকাশ পেয়েছে গোলাকার ক্যানভাসে। একে একে দৃশ্যায়িত হয়েছে হংসেশ্বরী, উমা, অন্নদা, তারা মায়ের মহিমায়। আগের কাজগুলিতে বিষয়ের মহিমা থাকলেও রঙের কৌশল ও ড্রয়িংয়ে সামান্য দুর্বলতা চোখে পড়ে। সেই তুলনায় এই শক্তি-সিরিজ়ে শিল্পী নাতাশার পারদর্শিতা এবং প্রজ্ঞা প্রকাশ পায়। অষ্টমী এবং নবমীর মধ্যবর্তী সন্ধিক্ষণ তুলে ধরা হয়েছে। কমলা, হলুদ ও বাদামির প্রেক্ষাপটে শ্বেতশুভ্র দুর্গার আগমনের এক আলোকিত মুহূর্তকেও ধরা হয়েছে। সুন্দর ছন্দ ও রঙের প্রয়োগের নমুনা শিল্পীর উপরে ভরসা তৈরি করে।

পেশাদারি প্রতিশ্রুতির দায়িত্বে দীর্ঘ দিন শিল্পকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন নাতাশা। তবে অতিমারি তাঁকে সুযোগ করে দেয় আবার নিজের পছন্দের কাজে ফেরার। সেই চ্যালেঞ্জিং সময়ে শিল্পীর জীবনরেখা হয়ে ওঠে তাঁর চিত্রকল্প-নির্মাণ। নাতাশা দত্ত রায়ের এই প্রদর্শনী বুঝিয়ে দেয়, শিল্পের ক্ষুধা একজন শিল্পীকে ঠিক পথে চালিত করবেই।

Art
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy