শাকিলা শেখের রেট্রোস্পেক্টিভ প্রদর্শনী চলছে সিমা গ্যালারিতে। শাকিলার মা জহরান বিবি ফুটপাতে আনাজপাতি বিক্রি করতেন। পিতৃ-পরিত্যক্ত শাকিলা এবং ওর দুই বোন ফুটপাতেই বেড়ে উঠেছিল। সেখানেই বাজার করতেন বি আর পানেসর। পেশায় সংখ্যাতত্ত্ববিদ হওয়া সত্ত্বেও, মনের খিদে মেটাতে নিভৃতে শিল্পচর্চা করে পানেসর হয়ে উঠেছিলেন সুদক্ষ গ্রাফিক এবং কোলাজ আর্টিস্ট। অবহেলিত মানুষের প্রতি ওঁর অকল্পনীয় দরদ স্থানীয় লোকেরা জানত। শাকিলাকে চোখে পড়ে তাঁর। মাত্র ১২ বছর বয়সে সংসার শুরু করতে বাধ্য হয় শাকিলা, বি আর পানেসরের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও। ১৬ বছরের দরিদ্র স্বামীকে সাহায্য করার জন্য কাগজের ঠোঙা বানাতে শুরু করেন শাকিলা। সেখানেই তাঁর কাগজের সঙ্গে পরিচয়। সেই ঠোঙা বিক্রির বন্দোবস্ত করে দেন পানেসরই।
পানেসর যখন ছবি ও কোলাজের কাজ করতেন, তাঁর সেই সব কাজ দেখার সুযোগ পেয়েছিল শাকিলা এবং ওর দুই বোন। শাকিলার ছোট থেকেই ছিল ক্ষুরধার বুদ্ধি এবং প্রতিভা। একবার পানেসরের জন্মদিন আসন্ন। কী উপহার দেওয়া যায়, ভেবে পায় না শাকিলা। স্বামী আকবরের কাছে আবদার করে কিছু রঙিন কাগজ এবং কার্ডবোর্ড জোগাড় করল সে। কার্ডবোর্ডের উপরে রঙিন কাগজ কেটে সেঁটে ৩-৪টি সবজির ছবির কোলাজ সৃষ্টি করল শাকিলা। এমন উপহার পেয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন পানেসর।
ছবিগুলো নিয়ে পানেসর গেলেন সোসাইটি অব কন্টেম্পোরারি আর্টিস্টসের বিকাশ ভট্টাচার্যের কাছে। পানেসর বুঝতে পেরেছিলেন, শাকিলার অসামান্য শিশু-প্রতিভা। সেখান থেকে চিত্রকূট গ্যালারি হয়ে শেষে শাকিলার ছোট্ট নৌকা এসে ভিড়ল সিমা আর্ট গ্যালারির মজবুত ঘাটে। ওর প্রতিভা দেখে বড় একটা জায়গা করে দিলেন রাখি সরকার। শাকিলার অভিনব শিল্পযাত্রা সেখান থেকেই শুরু।
আসলে সেই গ্রামের মেয়েটির অন্তরে আশপাশের দুনিয়াটা দেখার চোখ তৈরি হয়েছিল খুব ছোট বয়স থেকেই। যার জন্য একদম কম বয়সেই সবজি, ফল, গাছপালা, কাক, পাখি, কুকুর ইত্যাদির ছবি অনায়াসে করে ফেলতে পারত সে, কাগজ ছিঁড়ে ছিঁড়ে। ক্রমশ বয়স যত বেড়েছে, দেখার চোখটা ক্রমশ অন্য রকম হতে শুরু করেছে। অনুভবে আসে গভীরতা, মানসিক গড়ন পরিণতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শাকিলার ছবির চরিত্রও গেল পাল্টে।
ছবি সৌজন্য: সিমা আর্ট গ্যালারি।
এ বারের রেট্রোস্পেক্টিভ শোয়ে শাকিলা বেশ কিছু ক্যানভাসে চমকে দিলেন শিল্পরসিককে। আগে তাঁর ছবি ছিল দ্বিমাত্রিক। কিছু অংশে ফ্ল্যাট। তখনও তাঁর কাজের বিষয়বস্তুর তাৎপর্য বা প্রয়োজনীয়তা এই পর্যায়ে পৌঁছয়নি। এ ছাড়াও মাধ্যমের উপরে এখানে তাঁর যে নিয়ন্ত্রণক্ষমতা দেখলেন দর্শক, সেটা আগে সম্ভবত দেখা যায়নি।
আগেও শাকিলার ছবিতে প্রাকৃতিক উপাদান পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু সেগুলো সবই যেন নিছক মনকাড়া, প্রকৃতির বিচ্ছিন্ন সব ছবি। এ বারের প্রদর্শনীতে যে সব প্রাকৃতিক দৃশ্য শাকিলা কাগজ দিয়ে এঁকেছেন, সেখানে প্রকৃতি যেন মানুষের সঙ্গে কথা বলছে। প্রকৃতির অব্যক্ত বয়ান। অনেক কিছুর সাক্ষী হয়ে আরাধ্য প্রকৃতি আজ সুখস্বর্গ থেকে পরিণত হয়েছে মৃত্যুপুরীতে। এবং তার জন্য শিল্পী দায়ী করেছেন মানুষকেই। এখানে অব্যক্ত এক রাজনৈতিক সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি।
শাকিলার ছবি আশ্চর্য ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ। ধর্ম, শ্রেণি, জাতি এবং বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে শাকিলা ছবি আঁকেন সমস্ত অবহেলিত মানবজাতির জন্য, চিরকালের নিপীড়িত নারীর জন্য। গ্ৰামের শান্ত কিছু ছবিতেও মানুষের কথা, সাধারণ মানুষের কষ্টকর শ্রমযাপনের ছবি রয়েছে। এ ছাড়াও নারী নির্যাতনের কথা সর্বত্র ব্যক্ত। যে সব ছবিতে যৌনতা রয়েছে, সেখানে অদ্ভুত সাহসের পরিচয় দিয়েছেন তো বটেই, পাশাপাশি নারীজাতির প্রতি অত্যাচার আর অবমাননার প্রকৃত কাহিনি অনায়াসে এঁকেছেন। কিছু ছবিতে দেখা যায় গল্পের আভাস। একটি ছবিতে দেখা যায় প্রচুর পুরুষ, অসংগঠিত ভিড় এবং সমস্তটা মিলিয়ে যেন একটা মহাবিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে।
কোথাও শিশুসুলভ সরলতার ছোঁয়া, কোথাও হাস্যরসের আস্বাদ। কিন্তু এই সমস্ত কিছু ছাপিয়ে শাকিলার কাজে ফুটে উঠেছে পুরুষশাসিত সমাজের ছলনা, ভণ্ডামির নীরব প্রতিবাদ। এ প্রতিবাদে হিংস্রতা নেই, আক্রমণ নেই, কিন্তু ভাষা খুব জোরালো। বিশ্বাসের ভিত্তি টলিয়ে দেওয়া যেন এক চাপা রোষ।
শিল্পীর স্বাক্ষরবাহী ছবি তাঁর করা কালী। বেশ কিছু কালীর ছবি তিনি আগেও করেছেন এবং এখানেও তা দেখা গেল। মানুষের প্রতি মানুষের এত হিংসা, অশ্রদ্ধা থেকে পরিত্রাণের পথ কি তবে মা কালীই দেখাবেন বলে ভাবছেন শাকিলা? তিনিই কি নারীজাতির শক্তির প্রতীক?
এই সব ছবি ফিল্মের মোটা রঙিন পোস্টার ছিঁড়ে ছিঁড়ে করা। কোথাও কাঁচির ব্যবহার নেই। কাগজ শুধু আঙুল দিয়ে ছিঁড়ে সরু ও চওড়া ডিজ়াইনে রঙের বৈচিত্র এনেছেন, আঙ্গিকে বেশ কিছুটা বিমূর্ত ভাব, টোন বা বর্ণসমন্বয়ের অভিনবত্বে যে সব কাজ করেছেন শাকিলা, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। সমস্তটাই ফেভিকল দিয়ে ক্যানভাসে সেঁটে দেওয়া। একটু জল দিয়ে ফেভিকল গুলে হাত দিয়ে উপরে মোটা একটা স্তর সৃষ্টি করে গ্লসি ফিনিশ এনেছেন।
এর সঙ্গে কাগজে করা কয়েকটি ইনস্টলেশনও আছে। এই মূর্তিগুলো করার সময়ে কার্ডবোর্ড জলে ভিজিয়ে রেখে তারপর তাকে ময়দা মাখার মতো করে মেখে ফেভিকল দিয়ে গড়েছেন। কী অসাধারণ সৃষ্টি, যেখানে কোনও জলরং, তেলরং, অ্যাক্রিলিক, তুলি, পেন্সিল, ইরেজ়ারের ব্যবহার নেই!
শাকিলা একমাত্র ভিসুয়াল আর্টিস্ট, যিনি প্যারিসের গ্যালারি লাফায়াত-এর উদ্যোগে ইন্ডিয়া আর্ট ফেস্টিভ্যালে যোগ দিতে পেরেছিলেন ১৯৯৫ সালে। জার্মানির হেনওভার ফেয়ার অথোরিটিজ় তাঁকে কমিশন করেছিলেন বিশাল কিছু ইনস্টলেশন করতে, ২০০০ সালে। শাকিলা নিজের কর্মজীবনে বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
শাকিলার ছবি বিদেশের বহু গ্যালারিতে আজ সমাদৃত। শিল্পীর অনবদ্য সৃজনশীলতা কলকাতার শিল্পসমাজকেও সমৃদ্ধ করেছে। সিমা গ্যালারিতে আয়োজিত তাঁর এই প্রদর্শনীটি অত্যন্ত জরুরি সেই কারণেই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)