Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

মানুষটাই শুধু নেই

বাকি সব আছে। এসএমএস, ফেসবুক, ফোন নম্বর...। লিখছেন তাপস সিংহমাথার কাছে রাখা ফোনটা বাজত সাধারণত রাত একটা-দেড়টা নাগাদ। কোনও কোনও দিন ‘বহু আগে’, সাড়ে ১২টা। পেশাগত কারণে নিশাচর বলেই খুব অসুবিধে হত না। ফোন তুলে মাঝে মাঝে বলতাম, ‘না, ঘুমোইনি, বাড়ির ছাদে বাঁধাকপির চাষ করেছি, জল দিয়ে এলাম।’

শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৬ ০০:০৫
Share: Save:

কী নামে ডাকতিস আমাকে, মনে আছে তোর? বলতিস, ‘কী রে...ঘুমোলি?’

মাথার কাছে রাখা ফোনটা বাজত সাধারণত রাত একটা-দেড়টা নাগাদ। কোনও কোনও দিন ‘বহু আগে’, সাড়ে ১২টা। পেশাগত কারণে নিশাচর বলেই খুব অসুবিধে হত না। ফোন তুলে মাঝে মাঝে বলতাম, ‘না, ঘুমোইনি, বাড়ির ছাদে বাঁধাকপির চাষ করেছি, জল দিয়ে এলাম।’

অট্টহাসিটা এখনও কানে বাজে তোর...ব্যারিটোন ভয়েসে বলতিস, ‘...পাল্টালি না হতভাগা!’ জানতে চাইতাম, ‘খেয়েছিস ঠিকমতো? কাল ‘কল টাইম’ কখন?’ সকাল ৮টা! রাত ২টোয় অন্তত ঘুমোতে যা। ভোরে উঠবি কী করে?’ অভিনয়টা করতিস বড় ভাল। মঞ্চে যখন দেখতাম তখন একরকম। পরে বড় পর্দা আর ছোট বাক্সে যখন নিয়মিত অভিনয় করতিস, ইতিউতি দেখতাম। দীর্ঘ কথোপকথনে কত রক্তই যে ঝরত তোর, সঙ্গোপনে, কে জানে...বলতিস, সবার মধ্যে একা থাকাটা বড় কষ্টের, না রে?’

তারও অনেক অনেক পরে, অনেক মেঘলা দুপুর...নাগরিক বিষণ্ণতা...মন খারাপের শহরটায় একা হতে হতে...

একদিন কী হল জানিস, তোকে দু’টো ‘নন ভেজ’ জোক পাঠিয়ে বেশ কিছুক্ষণের মধ্যেও তোর সুভাষিত উত্তর এল না! বুঝলাম, তুই শ্যুটিংয়ে আছিস, পরে ঠিক উত্তর দিবি! ভুলেও গেছি ব্যাপারটা। অনেক রাতে মনে হল, তোকে ফোন করে গালি দিয়ে বলি, কী রে, শ্যুটিং শেষ হয়নি? তোকে যে নামে ইন্ডাস্ট্রির বা বাইরের লোকেরা ডাকত, আমার মোবাইলে সেই নামটা নেই তো! তুই সেখানে ‘সেভড’ হয়ে আছিস অন্য নামে। ফোনটা নিয়ে ডায়াল করলাম...সুইচড অফ...আবার...সুইচড অফ...আবার...আচমকাই গভীর নিস্তব্ধ একাকী রাত আমার কাঁধ ঝাঁকিয়ে পড়ে শোনালো অন্য এক চিত্রনাট্য...তুই যা কোনও দিনও শুনিসনি...

যে দিন বলেছিলি, ‘সবার মধ্যে একা থাকাটা বড় কষ্টের, না রে?’ তখন কী বুঝেছিলাম, কে জানে। কিন্তু, যে দিন কেওড়াতলা শ্মশানে মিডিয়া-জনতা-সহশিল্পী-ভিআইপি-র ছড়াছড়ির মধ্যে তুই ‘ভিআইপি চুল্লি’তে ঢুকে পড়লি, সে দিন বুঝেছিলাম, সবার মধ্যেই একা হয়ে যাওয়াটা আসলে কী...

মোবাইলে তুই থেকে গেলি কেন? কেন তোর নামটা এত বছরেও ‘ডিলিট’ করা হল না! আরও যে কত বার সে দিনের মতো মধুর ভুল হয়েছে, জানিস!

সাদা-কালো সম্পর্ক

লোকটা বাঁচতে চেয়েছিল খুব! কবি ছিল লোকটা...এই সে দিনও তার কবিতার এক বোকা পাঠক ফোন করে ফেলল কবিকে...ফাল্গুনের এক মেঘাচ্ছন্ন দুপুরে...এ কালের এক তরুণ কবির ফেসবুকে পোস্ট করা এক কবিতা ভারী পছন্দ হয়েছিল তার...সেটা জানাতে চেয়ে...কিন্তু, ও পারের মুঠিফোন যেন বোবা... সেই ভুল! কত গভীর নিবিড় রাতে, পেশাদারি দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি লোকটা শোনাতো ভাড়াবাড়ির দিনযাপনের কথা। সিঁড়ির নীচে একটা ঘেরাটোপই তাদের ঘর...তার আর তার মায়ের। সেখানেই উবু হয়ে বসে তার লেখালেখির চর্চা...তার রাতচরা যাপন...আরও আরও কথকতা...

বড় ধীর লয়ে নরম করে কথা বলত সেই লোকটা। হাসত, লিখত, আবৃত্তি করত কখন অন্য মনে! লোকটা লিখেছিল,

‘আজ আবিরে গাও গান, আজ শিমুলে ফোটে ফুল,/আজ হাওয়ায় ওড়ে প্রাণ, আজ সমস্ত নির্ভুল...’

সব কিছুই কি নির্ভুল ছিল? কে জানে? মাঝে মাঝে মোবাইলে ‘কনট্যাক্টস’ দেখলে মনে হয়, কেন এই ভুলটাকেও সযতনে লালন করার মতো ভুল করে যায় মানুষ এত দিন ধরে?

রাত ১১টার পরে আর এক বাড়িওয়ালা লাইট জ্বালাতে দিত না। সারা দিনের খাটুনির পরে সে তাই জ্বালাত হ্যারিকেন...হ্যারিকেনের মৃদুমন্দ আলোই কি তার রূপান্তর ঘটিয়ে মৃদুভাষী করে তুলেছিল তাকে? গভীর রাত পর্যন্ত লেখালেখির পরে তার চোখ দু’টো লাল টকটক করত পর দিন। এক বিষণ্ণ রাতে কবি লোকটা লিখেছিল,

‘আর কত কাল ঘোর দুঃখের রাত্রিগুলি/নিষ্ঠুর শাসন করে ফিরিয়ে দেবে/আলো-ঝলমল সকাল?/আর কত বার লিখতে হবে—/ভালবাসা ফুরিয়ে গেলে কেঁদে কেঁদে মরে যায়/মানুষের অনেকখানি মানুষ?’

সেই বিষণ্ণ দুপুরে মোবাইলের স্ক্রিনে কবির নাম ফুটে উঠল...এ বারে আর তত প্রতীক্ষা নয়...বিদ্যুৎ চমকিয়া যায়...

মনে পড়ে যায়, পরের দিনের সংবাদপত্রের ভিতরের পাতায় প্রকাশিত এক সংবাদের হেডিং, ‘প্রৌঢ়ের অপমৃত্যু’!

তার আগের দিন ঘরের সিলিং থেকে নামানো হয়েছিল সেই প্রৌঢ়ের ঝুলন্ত দেহ...! প্রৌঢ়ের মৃত্যু হল বটে, কিন্তু বেঁচে গেল কবি!

সে কবি লিখেছিল, ‘বাঁচতে চেয়েছিলাম বড় বেশি, কিন্তু আমায় কিছুতেই/বাঁচতে দিল না/ঘুটঘুটে এক অন্ধকার।/আমি তার কালো পায়ের নীচে/মাথা নিচু করতে পারিনি বলে/সে আমায় পৌঁছতে দিল না কক্ষনও/আজ এই সকাল পর্যন্ত।’

বহুদিন বেদনায় বহুদিন অন্ধকারে

পরীক্ষার হল থেকে বেরোনোর মুখে তার মা প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়েছিল, কী রে, কেমন হল? সব লিখেছিস তো? সে মেয়ে কাচুমাচু মুখে শুধু বলতে পারল, ‘হ্যাঁ, মানে না...।’ জীবনের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা দিয়ে সে মেয়ে বেরিয়ে আসছে হল থেকে। বাইরে বাবা-মায়েদের ঝাঁক। মেয়েদের উদ্দেশে উড়ে আসছে ঝাঁক ঝাঁক প্রশ্ন। কেমন হল?...কমন পড়ল?...যা সাজেশন দিয়েছিল, মিলেছে?...পারিসনি! সে কী রে!!...তখনই জানতাম, পণ্ডশ্রম হচ্ছে আমাদের...

যেন দুনিয়ার সমস্ত প্রশ্ন সেই মুহূর্তেই করে ফেলতে হবে! সে মেয়েও তখন মুক্তি চায়। তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করি, ‘বলে দে, কয়েক দিন অপেক্ষা কর। রেজাল্ট বেরোক, সব জানতে পারবে। এখন যদি বলি, সব ভুল লিখেছি, তা হলে কি আবার গিয়ে ঠিক করতে পারবে?’ একগাল হেসে সে মেয়ে বলে, ‘তুমি যে কী ভাল!’

আর তুই? তুই মোটেও ভাল নোস মেয়ে! সেই হেসে চলে যাওয়ার পরে...

তোর ফেসবুক পেজে ছবি দেখে দেখে কত কী যে মনে পড়ে! ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠলি তোরা...বালিকা থেকে কিশোরী...কত সুখ-দুঃখের কাল পেরিয়ে পেরিয়ে বড় হতে লাগলি মেয়ে, কত স্মৃতি অবিরাম সাঁতরে বেড়ায় জীবনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত...সিনেমায় যেমন হয়, মেয়েটা হাঁটতে থাকে, দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তার ফ্রক পরা বালিকা পা-কিশোরী পা-শাড়ি পরা তরুণীর পা হয়ে যায়...

স্কুলের ক্লাসঘরে বন্ধুদের সঙ্গে হাসিতে গড়িয়ে পড়ছিস তুই...জন্মদিনে নতুন হয়ে উঠছিস...কত শুভেচ্ছা...ইস্কুলের মাঠে স্লিপে চড়া-দোলনা-গেটের ঠিক বাইরে গাছতলার ধার ঘেঁষে আইসক্রিমের গাড়ি-ফুচকার নিষিদ্ধ হাতছানি তোকে...তোদের কী রকম ডাকত, মেয়ে, মনে পড়ে? কত জলছবি রামধনু হয়ে ছড়িয়ে পড়ল ভেজা দুপুরে...

তুইও তো শেষ করে দিলি নিজেকে...কী বুঝতিস ওইটুকু বয়সে?

মানুষ কী ভাবে যায়?

তারও পরে কত দিন, ফেসবুকের দেওয়ালে দেওয়ালে ছবি এঁকে গিয়েছিস জীবনের...তোর কত ছবি দেখে, ইভেন্ট দেখে ‘লাইক’ দিয়েছে বন্ধুরা, শেয়ার করেছে ফ্রিজ শট হয়ে যাওয়া মুহূর্ত...যাওয়ার পরেও কত দিন তুই আসলে যাসনি...বন্ধুরাই তো তোকে যেতে দেয়নি! কত বড় হয়ে গেছে ওরা,

বাইরে থেকে কিছু বুঝতেই পারিনি রে, অহর্নিশ নাগরিক ব্যস্ততার মধ্যে তোকে দেখে...তোদের দেখে...

ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড কি সব সত্যি বলে?

সব কিছু বোঝা যায় সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলে?

কেন তবে ওই ফেসবুকেরই দেওয়ালে তোকে খুঁজে খুজে ফেরা? অনন্ত পরিক্রমায় বেরনো?

এ আমার, এ আমারই পাপ...

এপিটাফ এপিটাফ এপিটাফে ভরে গিয়েছি আমি

দ্যাখো কবিবর, তোমার কথা মনে পড়তেই আর এক কবির ‘পদ্য’র লাইন মনে আসে! বেঁচে থাকলে শক্তি চট্টোপাধ্যায় নির্ঘাত বলতেন, ‘কে হে তুই ছোকরা? খণ্ড ত কোথাকার!’ এ ভাবেই তো বলতেন তিনি। কিন্তু তুমি, কবি-সুরকার-গীতিকার— তুমি কে হে ছোকরা, ফেসবুকের দেওয়ালে লেখো, সহসা শুনি রাতের কড়া নাড়া...আর তার উত্তরে এক জন মন্তব্য করেন, পরানমুখ সবুজ নলিঘাস...

তুমি লিখেছিলে, ‘আমার কলকাতার মন ভাল নেই।/বৃষ্টির স্পন্দন উধাও কবেই।/আমার শহরটার বড্ড অসুখ।/তেষ্টায় তেষ্টায় শ্রাবণ উন্মুখ।’

ফেসবুকে যখন তোমার ছবি দেখি, মনে হয়, তোমার অসুখটাকে কি সত্যিই বড্ড অসুখ বলে মনে করতে তুমি? কে জানে। এক আড্ডার মাঝেই তুমি শুয়ে রইলে কিছু ক্ষণ। বললে, আজকাল একটু ক্লান্ত লাগে...তার পরেই সেই চেনা হাসি, ও কিছু নয়, তোমরা চালাও, একটু পরেই জয়েন করছি।

কেন যে তোমাকে মুঠিতে ধরার নম্বর এখনও তাড়া করে মাঝে মাঝে, জানি না...জানি না বন্ধু, ময়দানের সেই ধুলোমাখা বইমেলায় তুলকালাম আড্ডার কথাই বা কেন মনে পড়ে!

তুমি যে লিখেছিলে, ‘অমলতাসের মনখারাপ/সময় কেন ধূসর ছবি আঁকো/গাছের চোখে জলের ছাপ/ফাগুন না হয় দু’একটা দিন থাকো।/...কখন যেন শব্দ চুপ/কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে পাখি,/ঘড়ির কাঁটায় অন্ধকূপ/ডুবব জেনেও দু’চোখ জাগিয়ে রাখি।’

জেগে আছো তুমি? এই গভীর গোপন নিঃসঙ্গ রাত্রে আজও অমলতাসের মনখারাপ হয়...এই ফাগুনে হয়তো আরও একটু বেশি হয়। সুরে আছ তো বন্ধু? জীবনের রিংটোন বদলে ফেলোনি তো?

জ্বলুক সহস্র চিতা এ পাড়ায় ও পাড়ায়

অত থমথমে গলার ফোন একবারই পেয়েছিলাম। এক উত্তর সম্পাদকীয় নিবন্ধে মাওবাদীদের নির্বিচার হিংসার তীব্র সমালোচনার পরে সেই ফোনটা এসেছিল। চেনা উচ্চারণে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি কি আদাজল খেয়ে আমাদের পিছনে পড়েছেন?’ আরও অনেক কথা। কথোপকথন শেষ হয়েছিল ও-প্রান্তের আরও থমথমে স্বরে: ‘জন্গণ্ আপনাদের ক্ষমা করবে না।’ পেশাদার সাংবাদিকের কি বাড়তি আবেগ রাখা উচিত? বিতর্ক চলুক। তবু, এ কথা স্বীকার না করেও তো উপায় নেই যে, অন্তরালে থাকা অতি-বাম একটি রাজনৈতিক দলের আত্মগোপনকারী এক শীর্ষনেতা সাংবাদিকদের ‘কোট’ দিচ্ছেন, টেলিভিশন চ্যানেলে টেলিফোনে প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন, তাঁর অননুকরণীয় উচ্চারণে ‘জন্গণ্’ শুনলেই টিভির সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে জনতা— এমনটা এর আগে কখনও দেখা যায়নি!

অদম্য সাহস, নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা, রাইফেলের দুর্দান্ত নিশানা, রসবোধ, প্রায় অশরীরীর মতো মুহুর্মুহু এলাকা পাল্টে পাল্টে চলা, এক একটি এলাকায় এক রাতের বেশি না থাকা— এমনতর নানা কাহিনি যাঁর সম্পর্কে ঘোরাফেরা করে, তাঁর সম্পর্কে আদ্যন্ত পেশাদারেরও হয়তো বাড়তি কৌতূহল ও আবেগ থাকে। আর সাহস?

এ কাহিনি শোনা এক জনের মুখে। এক সকালে হাওড়া স্টেশনের নিউ কমপ্লেক্সের একটি প্ল্যাটফর্ম ধরে হাঁটতে হাঁটতে আচমকাই পরিচিত সেই মানুষের চোখ চলে যায় প্ল্যাটফর্মেরই চা-কফির স্টলে। মাথা আর গা মোড়া গরম চাদরে, গলায় মাফলার, পায়ে স্নিকার— কফির কাপে নিশ্চিন্তে চুমুক দিচ্ছেন যিনি, সেই মুহূর্তে তাঁর সন্ধানে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা হন্যে হয়ে চষে বেড়াচ্ছেন সম্ভাব্য ডেরা ও জঙ্গল। সেই তিনি ওই পরিচিতকে দেখে সহাস্যে ডাকছেন, কফি খান। সেই পরিচিতের তখনও বিস্ময় আর আতঙ্কের ঘোর কাটেনি। ব্যাপারস্যাপার দেখে তাঁর চুল খাড়া হওয়ার জোগাড়! আপনি এখানে! উত্তর মেলে: লোকাল ট্রেন ধরে খড়্গপুর যাব। ওখান থেকে অন্য জায়গায়। তাঁর নিরাপত্তা বলতে কিচ্ছু নেই, অন্তত সামনাসামনি নয়! তিনি কিন্তু অকুতোভয়!

২০১১-র ২৪ নভেম্বর বুড়িশোলের জঙ্গলে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে তাঁর মৃত্যুর খবর আসার পরে, জঙ্গলে পাশে একে-৪৭ নিয়ে ঘাড় গুঁজে তাঁর পড়ে থাকার ছবি দেখে শুধু মনে হয়েছিল, রাজনৈতিক লাইন নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক, যত সমালোচনাই করি, এ রকম বর্ণময় চরিত্র বড় একটা আসে না। জীবনের চিত্রনাট্য কখন যে হার মানিয়ে দেয় সিনেমার চিত্রনাট্যকেও! মোবাইলে তার পর থেকে যত বার ওই নামের উপরে চোখ গেছে, তত বারই মনে হয়েছে, এখন তো আর ওই চরিত্রের সঙ্গে পেশাদারি প্রয়োজন নেই, তা হলে নম্বরটা ‘ডিলিট’ করে দিলেই তো হয়।

কিন্তু সব কিছুই কি এ ভাবে ‘ডিলিট’ করা যায়! প্রয়োজন-অপ্রয়োজন ছাপিয়ে আবেগ-সম্পর্ক-রোম্যান্টিসিজম কখন যে ডানা মেলে নিজস্ব আকাশে, কে জানে...

আমি ছিঁড়ে ফেলি ছন্দ, তন্তুজাল

চেন্নাইয়ে থাকা দাদাকে ফেসবুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায় যে তরুণী, দাদার দেওয়া শাড়ি পরে দাদার ফেসবুক পেজে ছবি লাগায় যে তরুণী, সে জানে, নয়নসমুখে না থাকলেও দাদা আছে নয়নের মাঝখানে...

তবু, সেই মানুষটার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট সচল থাকে, জীবনের ঘড়ি সেখানে টিক্ টিক্ করে চলতে থাকে...চলবেও...বন্ধুরা কত কিছু শেয়ার করে, ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ সেখানে শেয়ার করেন সেই মানুষটি! আর সেই তরুণী জানে, ফেসবুকে দাদার প্রোফাইল ছবিটা তার বুকে কত বড় ‘ফেস’ হয়ে থেকে গিয়েছে, থেকে গিয়েছে তার মোবাইলে রাখা নম্বরটাও...‘ভুল’ করে সেখান থেকে দাদার কাছে মেসেজ যায়, দাদা, তোমার দেওয়া শাড়িটা পরে ফেসবুকে ছবি পোস্ট করেছি, দেখো কিন্তু...

আবার এপিটাফ

যে প্রৌঢ় লোকটা কবি ছিল, সেই লোকটা তার ‘এপিটাফ’ নামের কবিতায় লিখেছিল,

‘হিমঘরের অজস্র ঠাণ্ডায়/সাদা বরফের বিছানায় এই যে ফ্যাকাসে শরীর আমার,/হে শবব্যবচ্ছেদের বন্ধু,/টুকরো টুকরো করার আগে তুমি অন্তত/জেনে নাও আজ—/চলে যাবার আগে আমিও প্রাণপণ/ চেয়েছিলাম/আজ এই সকালবেলার আলোয় পৌঁছতে।/কিন্তু, এভাবে নয়, এভাবে নয়।’

থাক না কিছু শব্দ দেরাজের কোনায়, যে ভাবে হলদেটে হয়ে যাওয়া তুলোট কাগজও থাকে...থাক না আপাত-প্রয়োজনহীন কিছু নম্বর মোবাইলের কন্দরে...ভেসে বেড়াক না কিছু পাতা কিছু ‘ফেস’ নিয়ে...আজকাল তো অনেক কিছুই রাখা যায় ‘ক্লাউড’-এ!

মেঘে মেঘে-কালো মেঘে মেঘে তারা বুঝি ঘুরে বেড়ায় এ আকাশ-সে আকাশ?

দূরে-বহু দূরে অনন্ত পরিক্রমায় যাওয়া বন্ধুরা-স্বজনেরা-অপাংক্তেয় মানুষেরা অপেক্ষায় থাকুক আরও কিছু কাল...

এপিটাফ লেখা হবে আমারও...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

SMS Facebook Mobile epitaph
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE