চলে যাওয়ার এক বছর আগে
আউটডোর। লঞ্চের মধ্যে শ্যুট।
আমাকে অনেক সকালে বাড়ি থেকে নিতে গাড়ি এল। গাড়িতে কেয়াও ছিল। বসন্তদাকে (চৌধুরী) বোধ হয় পরে তোলা হয়েছিল।
কেয়ার সঙ্গে তার দিন কয়েক আগেই আমার আলাপ। হাবেভাবে এত মিশুকে ছিল, ওই ক’দিনেই আমায় খুব আপনার করে নিয়েছিল।
যেতে যেতে বলল, ‘‘পাহাড়ী আপনার কাছে গিয়েছিল, যাত্রার অফার নিয়ে। করছেন তো?’’
পাহাড়ী, পাহাড়ী ভট্টাচার্য আমার পরিচিত। নান্দীকার-এ ছিল (পরে অবশ্য আমাদের বিয়ে হয়)। আমি বললাম, ‘‘এখনও কিছু ঠিক করিনি। দেখি।’’ ও বলল, ‘‘করুন, করুন। হ্যামলেট করবে। আপনাকে খুব মানাবে। আর ও তো আপনার খুব অ্যাডমায়ারার। টল, হ্যান্ডসাম, ডার্ক, এমন একজন আপনার জীবনে যদি আসে...,’’ বলে এক গাল হাসল।
ভারী মিষ্টি লেগেছিল ওকে। গালে একটা তিল। মাজা গায়ের রং। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। দেখলেই মনে হয় আর পাঁচ জনের থেকে আলাদা।
ও তখন ‘ভালোমানুষ’ নাটকটা করছে। যেতে যেতে বলল, ‘‘আমি একটু ডায়লগ মুখস্থ করতে করতে যাব, আপনার অসুবিধে নেই তো?’’ আমার আর অসুবিধে কী! ও কত রকম গলা করে সংলাপ বলতে বলতে চলল। মজা লাগছিল।
ঘাটে পৌঁছলাম। লঞ্চে উঠলাম। ডেক-এ বসে আড্ডা হল। ও একটা অন্ধ মেয়ের পার্ট করছিল। যার ছেলে ডেক থেকে পড়ে যাবে গঙ্গায়। তাকে বাঁচাতে মা ঝাঁপ দেবে জলে।
কেয়া বলল, ‘‘আমার শটটা খুব ভাল হবে। আমায় ঝাঁপ দিতে হবে জলে। আমার গঙ্গাস্নান হয়ে যাবে।’’ শুনে হা হা করে আঁতকে উঠলাম আমি, ‘‘মানে? তুমি ঝাঁপ দেবে কেন? তার জন্য তো অন্য লোক আছে।’’ কিছু বলল না। হাসল।
এর মধ্যে কয়েকটা শট। কেয়ার একারও একটা হল। ও ওপরের ডেক থেকে নীচের ডেকে ঝাঁপালো। ক্যামরা ধরল। পরদায় দেখলে যেটা মনে হবে জলে ঝাঁপ দিল।
আমাদের খাওয়ার ডাক পড়ল। কেবিনে। মাঝে কেয়াকে তলব। শটে যাওয়ার। ও যে শাড়িটা পরেছিল, সেটা এখনও আমার মনে আছে। সিল্কের। চকরাবকরা। রংটা যদ্দুর মনে পড়ে অফ হোয়াইট। খেতে খেতে বসন্তদা বলল, ‘‘চলো শটটা দেখে আসি।’’
কেবিন থেকে বেরিয়ে বারান্দায় সবে দাঁড়িয়েছি, হঠাৎ দেখি, কেয়ার শাড়ির প্রান্তটা হুশ করে জলে চলে গেল... এ কী এ কী... কী হল কী হল? বলতে বলতেই শোনা গেল কেয়া তলিয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে ডাইভার চলে এল। তারা তন্ন তন্ন করে খুঁজল। কোত্থাও নেই। আমরা কেমন হতভম্বর মতো হয়ে গেছি। বসন্তদা বলল, ‘‘চলো কেবিনে চলো।’’ তারপর তো পুলিশ, লোকজন। আমাদের সবাইকে আটকে দিল।
এর আগে মনে আছে, টেকনিশিয়ানদের কয়েকটা ছেলে এসে বলছিল, ‘‘আমাদের বাঁচান। শট চালু ছিল, বললে আমরা মারা পড়ব।’’
ওদের কিছু বলার মতো অবস্থাতেই ছিলাম না। তবে এটাও ঠিক, শট নেওয়া হচ্ছে, এমন ব্যাপারটাও আমি দেখিনি। বাকি সময়টা উদ্ভ্রান্তের মতো কাটল। ছাড়া পেলাম রাত দশটায়। বাড়ি ফিরতে অনেক রাত। তখনও ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে শুকিয়ে এতটকু হয়েছিলাম।
বোধ হয় পরদিনই কেয়ার মায়ের কাছে গিয়েছিলাম। হয় ওঁরা ডেকে পাঠিয়েছিলেন, নয় আমরাই গিয়েছিলাম নিজে থেকে। গোটা এলাকায় প্রচণ্ড টেনশন। অনেকেই জানতেন আমরা আসছি।
সে দিনে কেয়ার মায়ের বিধ্বস্ত চেহারা, তাঁর হাহাকার আজও চোখে ভাসে। খোকনদাও (রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত) ছিলেন। উনি একটা কাগজে ছবি এঁকে পুরো ঘটনাটা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন আমাদের কাছে। আমরা বলছিলাম। যতটা যা পারা যায়। কিন্তু কেবলই মনে হচ্ছিল, কেউই যেন আমাদের কোনও কথা বিশ্বাস করতে পারছেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy