কে বা কারা তাকে শেষ বার দেখেছিল? পরনে কী ছিল তার? বাঁ গালে কাটা দাগ ছিল কি? বা অন্য কোনও বিশেষ চিহ্ন?
মাঝরাতের শ্মশান থেকে, বিকেলের পাড়ার রক থেকে, সন্ধেবেলার ক্লাবঘর থেকে, ছুটির সকালের সব্জি বাজার থেকে সে হঠাৎ কোথায় চলে গেল?
নাকি হঠাৎ নয়... আমাদেরই চোখের সামনে থেকে একটু একটু করে মুছে গিয়েছে সে, উড়ে গিয়েছে যুগের হাওয়ার তোড়ে... পথহারানো সেই পথিক? যার নাম নবকুমার?
হ্যাঁ, বঙ্কিমের সেই চিরকালীন চরিত্র। নবকুমার। উদাসীন এক প্রেমিকের পাশাপাশি যার পরোপকারিতার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গি আমরা মনে রেখেছি আজও।
যেমন মনে রেখেছি কপালকুণ্ডলার সঙ্গে তার আশ্চর্য প্রেম, তেমনই মনে রেখেছি অন্যের প্রয়োজনে এতটুকু দ্বিধা না করে এগিয়ে যাওয়ার সাহস বা ইচ্ছেকেও।
কথায় বলে, উপন্যাসের চরিত্র কখনও বাস্তবে আসে না। হয়তো আসে না। কিন্তু বাস্তবের চরিত্রেরা তো উপন্যাসে ঠাঁই পায়।
আমাদের চারপাশের চেনা অচেনা মুখের আদল তো ফুটে ওঠে আমাদের লেখায়। যেমন বঙ্কিমের নিপুণ কলমে ফুটে উঠেছিল নবকুমার। সে কি তবে আজ বড় বেশি অবাস্তব? নইলে চারপাশ হাতড়েও খুঁজে পেতে এত অসুবিধে হচ্ছে কেন?
অসুবিধে হল না ৮২ বছরের তরতাজা স্মৃতিসম্পন্ন সুনীতাদেবীর। কলকাতার শহরতলিতে শ্বশুরবাড়ির বাস হয়ে গেল ছয় দশকেরও উপরে, তার আগে ওপার বাংলার ভিটে।
তিনি কিন্তু সেই সব নবকুমারদের আজও মনে করতে পারেন। “আমাগো পল্টু ছিল এক্কেরে নবকুমার। যেমন দ্যাখতে, তেমন মনডা’... খাস বাঙাল উচ্চারণে কৈশোরের বন্ধু পল্টুর কথায় চোখ চিকচিক করে উঠল তাঁর।
“আমাগো খড়ের চালায় একবার আগুন লাগছিল। সেই রাতে পল্টু না থাকলে আমরা বাঁচতামই না’... হঠাৎ লাগা আগুনের হলকায় সবাই যখন দিশেহারা, পাশের বাড়ির পল্টু কিন্তু আগুনের তোয়াক্কা না করেই বার করে এনেছিল বাড়ির তিনজনকে। এ তো কেবল একখানা ঘটনা”, বলেছিলেন সুনীতাদেবী, গ্রামের সক্কলে জানত, যে কোনও দরকারে পল্টুকে পাওয়া যাবেই। ডাকার আগেই।
তেমন কাউকে কি আজ নিজের পাড়ায় দেখতে পান অশীতিপর মানুষটি?
আক্ষেপের সঙ্গে নেতিবাচক মাথা নাড়লেন আর অসামান্য একটি জবাবে চুপ করিয়ে দিলেন এই অধম প্রশ্নকর্তাকে। মুচকি হেসে পাল্টা জিজ্ঞেস করে বসলেন, “বঙ্কিমও কি আর লেখেন?”
নাহ্, বঙ্কিম আর লেখেন না। কিন্তু বঙ্কিমের কলম নেই বলে কি নবকুমারেরাও হারিয়ে যাচ্ছে? এমনকী সাহিত্য থেকেও? আজ যাঁরা বাংলা গদ্যের বারান্দায় পায়চারি করছেন, তাঁরা কি ফিরিয়ে আনতে পারবেন আরেকজন নবকুমারকে? বা, চাইবেন কি ফিরিয়ে আনতে?
“শুধু পরোপকার নয়, সামাজিক কর্তব্যবোধও নবকুমারের মধ্যে প্রবলভাবে ছিল। অন্তত গোড়ার দিকের নবকুমার তো বটেই”, বললেন এ সময়ের অন্যতম কথাকার বাণী বসু।
তাঁর উপন্যাসেও তো বারবার মানবচরিত্রের নানা জরিপ উঠে এসেছে। কিন্তু নবকুমার কি আর সৃষ্টি হতে পারে? “পারেই তো”, সাফ জবাব বাণীদির। “এই যে শান্তি নোবেল পেলেন কৈলাস সত্যার্থী, তার জীবনটাই একবার ভাবো না! চাকরিবাকরি ছেড়ে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে এত দিনের লড়াই। উনি তো নয় এত বড় স্বীকৃতি পেলেন। আমি তো এমন অনেকের খবর পড়ি, যাঁরা কত প্রতিকূলতার মধ্যে দাঁড়িয়ে আর পাঁচ জনের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন, নিঃস্বার্থে। তারা কি নবকুমার নয়? আসলে কী জানো, আমরাই ট্র্যাজেডিকে জিতিয়ে দিই বারবার। তাই গদ্য সাহিত্যে সফল আনন্দের আখ্যান আজও লেখা হল না।”
বাণীদি অবিশ্যি কথার শুরুতে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “কোন নবকুমার?”
ঠিকই। কপালকুণ্ডলা উপন্যাসে নবকুমারের চরিত্র তো একরঙা নয় কখনওই। জীবনের কোনও চরিত্রই কি একরঙা? আমরা কেবল নবকুমারের বেপরোয়া ঝাঁপিয়ে পড়বার স্বভাবটুকু বেছে নিয়েছি আজ। তাই এই লেখাতে নবকুমার কোনও চরিত্র নয়। একটা প্রতীক কেবল। অন্যের কারণে নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে যাবার প্রতীক।
ধরা যাক বঙ্কিমের লেখার সেই অংশটুকুই, যেখানে দুটো সংলাপের আদান-প্রদানে এক লহমায় নবকুমারের চরিত্রের এই দিকটি ফুটে উঠেছে স্পষ্ট।
“স্নানাদির পর পাকের উদ্যোগে আর এক নূতন বিপত্তি উপস্থিত হইল। নৌকায় পাকের কাষ্ঠ নাই। ব্যাঘ্রভয়ে উপর হইতে কাষ্ঠ সংগ্রহ করিয়া আনিতে কেহই স্বীকৃত হইল না। পরিশেষে সকলের উপবাসের উপক্রম দেখিয়া প্রাচীন, প্রাগুক্ত যুবাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘বাপু নবকুমার! তুমি ইহার উপায় না করিলে আমরা এতগুলি লোক মারা যাই।’
নবকুমার কিঞ্চিৎ কাল চিন্তা করিয়া কহিলেন, ‘আচ্ছা যাইব, কুড়ালি দাও, আর দা লইয়া একজন আমার সঙ্গে আইস।’
কেহই নবকুমারের সহিত যাইতে চাহিল না।
‘খাবার সময় বুঝা যাবে’ এই বলিয়া নবকুমার কোমর বাঁধিয়া একাকী কুঠার হস্তে কাষ্ঠাহরণে চলিলেন।’
এই নবকুমারকেই তো আমরা খুঁজছি এই লেখায়। নিশ্চয়ই বহু মানুষ নিজের গণ্ডির বাইরে আরও অসংখ্য মানুষের জন্য কোনও না কোনও ভাবে লড়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। সে লড়াইয়ের কোনও তুলনা হয় না। কিন্তু শ্যাওলাজমা পাঁচিলঘেরা সরু গলিগুলোয়, বাল্ব জ্বলা ক্যারামের সোচ্চার আড্ডায়, ভিজে কাপড় ঝুলতে থাকা মেসের ঘরে বা ফিরতিপথের ট্রামে ঠিক পাশের সিটটায় যে সব নবকুমারদের দেখা পাওয়া যেত আকছার, তারা গেল কোথায়?
খুব বেশি পিছোতে হবে না। পঞ্চাশ, ষাট, সত্তরের দশকেও বাঁকে বাঁকে, মোড়ে মোড়ে, দরজায় দরজায় নবকুমারদের মুখ দেখা যেত।
তারা কেউ আলাদা ভাবে চিহ্নিতও হত না, কারণ তাদের সেই ঝাঁপিয়ে পড়া স্বভাব ছিল নেহাতই স্বাভাবিক। আমরা জানতাম, বিপদে একটা খোকনদা বা লিটন আছে, লড়ে যাবে।
জানতাম, রাত তিনটেতেও এক ডাকে বাবলু আর অশোকেরা আছে, হসপিটাল কুছ পরোয়া নেহি। জানতাম, একগাল হাসি নিয়ে সমু, বিলু, আশিসরা সর্বদা রেডি, ঝিমলির বিয়েতে পরিবেশনটা উতরে যাবে ঠিক।
আমরা মানে আজ যারা চল্লিশের চৌকাঠে পা ঘষছি। কিন্তু যারা সবে কুড়ি পেরোলো? সেই সব তরতাজা ছেলেমেয়েরা কি নিজেদের মধ্যে খুঁজে পেয়েছে কোনও নবকুমারকে?
“আমি কপালকুণ্ডলা পড়েছি, কিন্তু ফ্র্যাংকলি স্পিকিং, আমার নবকুমারের চরিত্রটা খুব অ্যাবসার্ড লাগে। ইন ফ্যাক্ট, অ্যাবসার্ড হয়তো নয়, ইউটোপিয়ান।” স্পষ্ট বলল ফার্স্ট ইয়ার ইংরেজি অনার্সের তৃষা।
তার কথায়, “আমরা তখনই কোনও ক্যারেক্টারের সঙ্গে রিলেট করতে পারি, যখন তাকে আমাদের চারপাশে দেখি। যদি না হ্যারি পটারের মতো কোনও আলাদা জগতের চরিত্র হয়। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে, আজকের সময়ে অন্তত নবকুমারের মতো কাউকে তো আমি দেখিনি। পড়তে ভালো লাগে, কিন্তু বাস্তবে পাওয়া মুশকিল।”
উত্তর কলকাতা। বনেদিয়ানা আর মাখোমাখো বন্ধুত্বের জন্য বিখ্যাত। দক্ষিণ যদি বা কিছুটা স্বার্থপর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে, কলকাতার হৃদয় উত্তরেই বলে দাবি অনেকের। কিন্তু সেখানেও হদিস মিলল না নবকুমারের।
“আমাদের বহু পুরোনো বাড়ি, পাড়ায় বন্ধুবান্ধব আছে, আড্ডা, খেলাধুলোও হয়। বিপদে ডাকলে কাউকে পাব না, তাও হয়তো নয়। কিন্তু নবকুমারদের দিন আর নেই,” স্পষ্ট বক্তব্য থার্ড ইয়ার বাংলা অনার্সের ছাত্র তন্নিষ্ঠর। “খুব খারাপ লাগবে শুনতে, কিন্তু আজকের দিনে ওই রকম একটা চরিত্র বাস্তবে থাকলে লোকজন তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে, পাশাপাশি তার পরোপকারী স্বভাবের পুরো ফায়দাটাও নেয়। বাবাদের সময়ে দু একজন ছিলেন, তাঁদের ডাকতে হত না। যে কারও যে কোনও দরকারে সবার আগে এসে হাজির হতেন। কার কখন কী দরকার জেনে বলার আগেই কাজটা করে দিতেন। সে সব দিন আর নেই।” বেশ দুঃখের সঙ্গেই স্বীকার করে নিল তন্নিষ্ঠ।
হ্যাঁ, ছোট ছোট ব্যাপার থেকে প্রাণসংশয়, খুচরো দরকার থেকে মাথা নামিয়ে ভেঙে পড়া, আমরা জানতাম, কাঁধে এসে পড়বেই কয়েকটা হাত।
আমাদের বিপদ মানে তাদেরও বিপদ। আমাদের দরকারটা তাদেরও। তারাই তো জীবনের ছোট বড় উপন্যাসের আসল নবকুমার। গল্পের নায়ক। কিন্তু নায়কই যদি হবে, তাহলে পটভূমি ছেড়ে তারা গেল কোথায়?
“আমরা ইদানীং খুব স্বার্থপর আর আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছি, তাই কখনও কোনও নবকুমারের দেখা পেলে চমকে উঠি। কিন্তু সে রকম মানুষ একেবারেই নেই, তা আমি মানি না।” ফোনের ওপার থেকে গম্ভীর গলায় বললেন ‘কালবেলা’-র লেখক সমরেশ মজুমদার। কিন্তু সাহিত্যে তেমন চরিত্র ইদানীং চোখে পড়েছে কি? উত্তরে তিনি বললেন, “সে যুগে ইন্দ্রনাথ, এ কালে নীললোহিতের মধ্যেই তো নবকুমারের অনেক গুণ দেখতে পাওয়া যায়।”
আর জীবনে?
আশা ছাড়তে নারাজ সমরেশদার জবাব, “জীবনেও আছে বইকী। ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো মানুষ এখনও আছে। যদি জিজ্ঞেস করো, কেন করছ? লাভ কী? জবাবে রবীন্দ্রনাথের গানের মতোই বলবে, আমার এই কাজ করাতেই আনন্দ। হ্যাঁ, আগের মতো অত জনকে হয়তো পাওয়া যাবে না, কিন্তু খুঁজলে মিলবে। এই তো কমল (কমল চক্রবর্তী) যে সব ছেড়েছুড়ে ভালোপাহাড়ের মতো একটা ব্যাপার করেছে, ওর কিন্তু কোনও লাভ নেই তাতে। বরং বছর বছর ঋণের বোঝা বাড়ছে। কিন্তু গত দশ বছরে ও অনেক আদিবাসী বাচ্চাদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছে। শুধু ভালোলাগার খাতিরেই। আছে, এরা এখনও আছে।”
সমরেশদার আস্থাভরা কণ্ঠস্বরে যেন ফুটে উঠল বঙ্কিমের সেই অমোঘ কয়েক খানা লাইন।
“বিশেষ নাবিকেরা প্রতিগমন করিতে অসম্মত, তাহারা কথার বাধ্য নহে। তাহারা বলিতেছে যে, নবকুমারকে ব্যাঘ্রে হত্যা করিয়াছে। তাহাই সম্ভব। তবে এত ক্লেশ-স্বীকার কি জন্য?
এরূপ বিবেচনা করিয়া যাত্রীরা নবকুমার ব্যতীত স্বদেশে গমনই উচিত বিবেচনা করিলেন। নবকুমার সেই ভীষণ সমুদ্রতীরে বনবাসে বিসর্জিত হইলেন।
ইহা শুনিয়া কেউ যদি প্রতিজ্ঞা করেন, কখনও পরের উপবাস নিবারণার্থ কাষ্ঠাহরণে যাইবেন না, তবে তিনি উপহাসাস্পদ। আত্মোপকারীকে বনবাসে বিসর্জন করা যাহাদের প্রকৃতি, তাহার চিরকাল আত্মোপকারীকে বনবাস দিবে। কিন্তু যত বার বনবাসিত করুক না কেন, পরের কাষ্ঠাহরণ করা যাহার স্বভাব, সে পুনর্ব্বার পরের কাষ্ঠাহরণে যাইবে। তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?”
এই একখানা মোক্ষম প্রশ্ন ঠিকই, কিন্তু আজ ক’জনের মনে এই রকম প্রশ্ন জাগে, সেও আরেক মোক্ষম প্রশ্নই বটে।
বরং আরেকটি প্রশ্ন অনেক বেশি জরুরি আজকের দিনে, “উত্তম হইয়া আমি পাইবটা কী?”
এর উত্তর যে পায় সে পায়, যে পায় না সে কোনও দিনই পায় না। আর সত্যি বলতে কী কালে কালে উত্তমের সংজ্ঞাও তো পাল্টেছে, তাই নয় কি?
শহর না হয় বরাবর আত্মকেন্দ্রিক। কিন্তু আত্মীয়তার চাদরে ঘিরে রাখা বাংলার মফস্সল? নবকুমারের ঠিকানা কি এখন সেইখানেই?
খুঁজতে বেরিয়ে নিরাশ হতে হল। বাঁশবেড়িয়ার সোমেন, বনগাঁর ঈশানী, চন্দননগরের সাহানা বা বহরমপুরের তওফিক— কেউই বলতে পারল না।
এরা সকলেই কুড়ির এদিক ওদিক, বাবা-জ্যাঠাদের মুখে শুনেছে এমন মানুষ ডাইনে বাঁয়ে ছিল এককালে, কিন্তু নিজেদের আমলে তাদের দেখা মেলেনি আর।
হয়তো সবাই স্বার্থপর হয়ে গিয়েছে, এমনটাও নয়। কিন্তু হ্যাঁ, সময় তো কমে এসেছে অনেক। পৃথিবীটা বড্ড তাড়াতাড়ি ঘুরছে ইদানীং।
পাশের মানুষটার দিকে তাকাতে গেলে পায়ের নীচের মাটি ফসকে যায় যদি? এই ভয় মগজে নিয়ে ঘড়ির কাঁটার পথ ধরে ছুটে বেড়াচ্ছি আমরা সক্কলে। পাশে গিয়ে দাঁড়াবার, বিপদে হাত বাড়াবার ইচ্ছে যদি বা থাকে, উপায় কই?
তর্কের খাতিরে বলা চলে, ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। কিন্তু সময়ের জাঁতাকলে ইচ্ছের সেই জোর গুঁড়িয়ে মিহি হয়ে যেতে কত ক্ষণ? প্রশ্ন আরেকখানাও আছে।
অকুতোভয় ঝাঁপিয়ে পড়ার, আগুপিছু না ভেবেই এগিয়ে আসায়, পরোপকারের আগুনে হাত সেঁকে নেওয়ায় যে তৃপ্তি, তা একান্তই নিজের। এ কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু আশপাশের পাঁচ-দশ জন মানুষের চোখেও সেই আগুনের একটু প্রতিফলন দেখতে ইচ্ছে করে যদি, তার উপায় কই?
বঙ্কিম এখানেও উপস্থিত। কিন্তু লেখক হিসেবে নয়, মানুষজনের চাহনির প্রকৃতি হিসেবে। এমন মানুষকে ‘খোরাক’ বা ‘মুরগি’ করবার লোকের তো অভাব নেই আজ। সামনে পিঠ চাপড়ে পিছনে হেসে খুন হওয়াই তো সাধারণ রেওয়াজ। তাই মনে মনে নবকুমার হওয়ার ইচ্ছে থাকলেও, শেষমেশ এগিয়ে আসা হয় না হয়তো। বা দু’চারবার ঝাঁপিয়ে পড়বার পর মনে হয়, কেন করছি এ সব? কী লাভ?
তবে হ্যাঁ, আশা একটাই, নবকুমার এক রোগের নামও বটে। ঝাঁপিয়ে পড়ার এই রোগ সত্যি সত্যি যার আছে, তাকে কোনও টিটকিরি, অসহযোগিতা বা বাঁকা চাউনি নিরস্ত করতে পারবে না। সে ঠিক কুড়ুল কাঁধে চাপিয়ে উঠে যাবে কাঠ কেটে আনতে। কিন্তু ঘুরেফিরে সেই গোড়ার প্রশ্নেই এসে দাঁড়াচ্ছে এই লেখা। নবকুমার তাহলে গেল কোথায়?
‘মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও/ এসে দাঁড়াও, ভেসে দাঁড়াও, এবং ভালবেসে দাঁড়াও’... লিখেছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়।
লাইনদুটোর প্রয়োজনীয়তা, প্রাসঙ্গিকতা আজও ফুরিয়ে যায়নি। কোনও দিন ফুরোবে কি আদৌ?
সেই ভাবে ভেবে দেখতে গেলে, নবকুমারেরা কিন্তু চিরকালই সংখ্যালঘু। বঙ্কিমের সৃষ্টিতেও অতজনের মধ্যে সে একাই গিয়েছিল কাষ্ঠাহরণে। আরেকজন নবকুমারকে পাশে পায়নি। পেলে কি তার নায়কোচিত উত্থান খর্ব হত? হয়তো না। হয়তো আরেকজনকে পাওয়াটা উপন্যাসের পক্ষেও বড় বেশি কল্পনাপ্রবণ হয়ে পড়ত।
সে সেদিনও একা ছিল, আজও একা। সময়ের জঙ্গলে পথ হারিয়ে পেরিয়ে চলেছে এক শেষ না হওয়া রাত। তাকে কেউ খুঁজলেও, সেই ডাক পৌঁছচ্ছে না অত দূরে। সে কেবল শুনতে পাচ্ছে দূরাগত লোকালয়ের আবছা কোলাহল আর দেখতে পাচ্ছে টিমটিমে বাতির ঝাঁক।
অনেকে উপোসে থাকে যদি? তাই সে কাটতে গিয়েছিল কাঠ। ফিরতে বড্ড দেরি হয়ে গেল।
এখন এই ছুটন্ত সময়ের কাঁটায় হাত পা ছড়ে অন্ধের মতো এগিয়ে চলা ছাড়া তার উপায়ও নেই। সে নবকুমার। নিরুদ্দেশ। তত দিনই নিরুদ্দেশ থাকবে, যত দিন না এই অন্ধকার জঙ্গলে হঠাৎ কেউ তাকে থামিয়ে জানতে চাইবে, ‘পথিক, তুমি কি পথ হারাইয়াছ?’