Advertisement
E-Paper

বারাণসীতে ডুব দিয়ে

খুঁজে পাওয়া গেল সেই প্রাচীন বারাণসীকেই! তার ঘাটে-আঘাটায় ঘুরলেন গৌতম চক্রবর্তী।রাত সাড়ে তিনটেয় কে জানত এত বড় চমকের মুখোমুখি হতে হবে! আবাল্যলালিত সংস্কার এক লহমায় এ ভাবে তাসের প্রাসাদের মতো কখনও ভেঙে পড়েনি। ঘটনাস্থল: কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির। প্রত্যহ ভোর পৌনে তিনটেয় মন্দিরের দরজা খোলে, পাঁচ জন মোহান্ত একসঙ্গে এক ঘণ্টার অভিষেক করে বিশ্বেশ্বরের ঘুম ভাঙান। ভোর চারটে নাগাদ সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য মন্দির উন্মুক্ত হয়। ততক্ষণে গলি বেয়ে লম্বা লাইন।

শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০১৪ ০০:০০

রাত সাড়ে তিনটেয় কে জানত এত বড় চমকের মুখোমুখি হতে হবে! আবাল্যলালিত সংস্কার এক লহমায় এ ভাবে তাসের প্রাসাদের মতো কখনও ভেঙে পড়েনি।

ঘটনাস্থল: কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির। প্রত্যহ ভোর পৌনে তিনটেয় মন্দিরের দরজা খোলে, পাঁচ জন মোহান্ত একসঙ্গে এক ঘণ্টার অভিষেক করে বিশ্বেশ্বরের ঘুম ভাঙান। ভোর চারটে নাগাদ সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য মন্দির উন্মুক্ত হয়। ততক্ষণে গলি বেয়ে লম্বা লাইন।

সেই শেষ রাতে পাঁচ মোহান্তের কেউ বেদগান গাইছেন, কেউ বা ঝুড়িভর্তি ফুল সাজিয়ে রাখছেন। মন্ত্রপাঠের পাশাপাশি স্টিলের ঘড়া থেকে দুধ ঢালা হচ্ছে শিবলিঙ্গে। তখনই কানে বিষম বাজল: ওঁ নমো বিষ্ণু পবিত্র অপবিত্রো বা।

অনুষ্ঠানের শেষে প্রধান মোহান্তকে খটকার কথা জানিয়েছিলাম। তিনি হাসলেন, “ঠিকই শুনেছেন। বিশ্বনাথ, বিষ্ণু সকলেই এক।” এত দিন হিন্দু ধর্ম মানেই শৈব বনাম বৈষ্ণব সম্প্রদায়গত লাঠালাঠি গোছের ভুলভাল জেনে এসেছি।

অনুষ্ঠানের প্রথমে মন্ত্রপাঠ। ভস্মবিভূতি নিয়ে কপালে, বাহুতে তিলক কাটছেন মোহান্তরা। তার পর গঙ্গাজল ঢেলে শিবলিঙ্গের স্নান। এ বার গা মুছিয়ে দুধ, দই, ঘি, মধু ও পঞ্চগব্য দিয়ে স্নান। খুলে দেওয়া হল শিবলিঙ্গের মাথার ওপরে ছোট্ট শাওয়ার। ফের গা মুছিয়ে কখনও দুধ, কখনও গঙ্গাজল। “অভিষেক মানে সিংহাসনে বসা-টসা নয়, স্নান। শিব আসলে অভিষেকপ্রিয়,” বলছিলেন মন্দিরের পণ্ডিত সঞ্জয় শাস্ত্রী। তা হলে রুদ্রাভিষেক? “খুব সহজ। রুদ্রের অভিষেক।”

আপনার-আমার মতো আমজনতাও বিশ্বনাথের রুদ্রাভিষেক করতে পারেন। বাহু সজোরে মুঠো করে উপরে তুলে ধরতে হবে, শিঙা বেয়ে টপটপ করে জল বা দুধ গড়িয়ে পড়বে শিবের মাথায়। পূজারি তখন রুদ্র অষ্টাধ্যায়ী, ঋগ্বেদের পুরুষসুক্ত পাঠ করবেন।

এক ব্রাহ্মণ দিয়ে পুজো করলে রেট ১২৫ টাকা, পাঁচ জন থাকলে ৩৭৫ টাকা। পুজোর উপচার ও দক্ষিণার খরচ আলাদা। ৫ লিটার অবধি দুধ ঢাললে ট্যাক্স নেই। তার বেশি হলে ৬৫ টাকার অতিরিক্ত কর। আর সময়? ১৫ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা...যজমানের যেমন সামর্থ্য! “মনে রাখবেন, রাজাকে লিয়ে দান, গরিবোঁকে লিয়ে স্নান,” বলছিলেন শাস্ত্রীজি। এখানেই কি ভারতীয় গণতন্ত্রের গভীর ব্যঞ্জনা? দেশের নতুন প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বনাথ মন্দিরে এসে অভিষেক করার মানে, তিনি কোনও রাজা-টাজা নন। রুদ্র রূপও ধারণ করছেন না। বরং নিজেকে আর পাঁচ জনের সঙ্গে একাসনে বসিয়ে গেলেন।

এমনিতে বারাণসী আছে বারাণসীতেই। সেই ঘিঞ্জি গলি, এক জনের বেশি দু’জনের হাঁটার জায়গা নেই। পথ আটকে এ দিক-সে দিক চরে বেড়াচ্ছে ধর্মের ষাঁড়। গোধূলিয়া মোড়ে চিরপরিচিত যানজট, দশাশ্বমেধ ঘাটে গেলেই মাঝিদের ডাকাডাকি, “নাও লেগে, বাবু? অসিঘাট, মণিকর্ণিকা সব ঘুমা দেগা।”

বারাণসী দক্ষিণ থেকে বিজেপি-র শ্যামদেব রায়চৌধুরী টানা সাত বার জিতে বিধায়ক পদে। “আমরা অনেক দিন ধরেই চাইছি, এটাকে হেরিটেজ সিটি ঘোষণা করা হোক,” বলছেন তিনি। রামকৃষ্ণ মিশনের আশিস মহারাজ থেকে দশাশ্বমেধ ঘাটের মাঝি সকলে একটা বিষয়ে আশাবাদী, “গঙ্গাদূষণ নিয়ে এ বার অন্তত কিছু কাজ হবে।”

স্বাধীনতার পর এই প্রথম বারাণসীর সাংসদ প্রধানমন্ত্রী পদে, ফলে শহরের আশা-আকাঙ্ক্ষা উত্তেজনা অন্য রকম। দেশের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী বারাণসীর সন্তান ঠিকই, কিন্তু তিনি ইলাহাবাদ থেকে ভোটে জিতেছিলেন।

সোনাপুরা থেকে চক, বেনিয়াবাগ, গোধূলিয়া সব জায়গায় একটাই আশা, “এ বার যানজট কমবে। অনেক দিন ধরেই ফ্লাইওভারের কথা বলা হচ্ছে, মুলায়ম থেকে মায়াবতী কেউ কানে তোলেন না।” হোটেল ব্যবসায়ী থেকে আখড়ার সাধু সকলের কথায় ঘুরেফিরে এল একটাই শব্দ: গুজরাত মডেল।

এই জন-আকাঙ্ক্ষাই কি লিখবে নতুন ইতিহাস?

আকাঙ্ক্ষা টের পাওয়া যাচ্ছিল সোমবার সন্ধ্যায় দশাশ্বমেধ ঘাটে। নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর শপথের পরই আকাশ ভরে গেল আলোময় তুবড়িতে। বাজি ফাটানো হচ্ছে নদীর ওপারের চড়ায়। গোধূলিয়া, চক বাজারের ফুটপাথে ব্যবসায়ীরা লাগিয়ে দিয়েছেন বড় এলসিডি স্ক্রিন। পথচলতি মানুষজন সেখানে দাঁড়িয়ে টিভি দেখলেও হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে ঠান্ডা লস্যি। বিজেপি নেতা ও কর্মীদের উদ্যোগ, অবশ্যই।

কিন্তু ভারত-ইতিহাসের প্রাচীনতম জনপদটিকে এ ভাবে বিজেপি, কংগ্রেস বলে দেগে দেওয়া যায় না। বিশ্বনাথের গলিতে এখনও বাংলা ভাষায় অজস্র সাইনবোর্ড। কোথাও মোহিনীমোহন কাঞ্জিলাল, কোথাও বা কুঞ্জু সাউ, কোথাও আবার নিখিল, দাশগুপ্তের জর্দা।

এখানেই ইতিহাসের ধারাবাহিকতা। বারাণসী মানে শুধু দশাশ্বমেধ ঘাট, বিশ্বনাথ মন্দির, রাবড়ি আর বেনারসি শাড়ির মতো চেনা বাঙালি চিহ্ন নয়। বরং শহরটা ভারত-ইতিহাসের চমত্‌কার এক কন্টিনিউয়িটি।

এই লোকসভা এলাকার মধ্যেই সারনাথ। এখান দিয়ে কখনও হেঁটে গিয়েছেন গৌতম বুদ্ধ, তারও পরে শঙ্করাচার্য, মাধ্ব এবং রামানুজ। উত্তর ভারতের আর কোনও তীর্থস্থানে এত দক্ষিণী মঠ নেই। অন্ধ্র, কেরল, তামিলনাড়ুর ভিড়ও এত প্রবল ভাবে আছড়ে পড়ে না।

সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য অন্যত্র। কেদারেশ্বর থেকে রামেশ্বর, কামেশ্বর, গোপেশ্বর, ওঙ্কারেশ্বর, মদমহেশ্বর...উত্তর থেকে দক্ষিণ ভারতের প্রতিটি বিখ্যাত শিবলিঙ্গই এ শহরে প্রতিষ্ঠিত। তা নিয়ে অজস্র উপকথা।

বাঙালির সাংস্কৃতিক রাজনীতি সে দিনও বারাণসীর এই সর্বভারতীয় চিহ্নগুলি চিনতে চায়নি, আজও! চিনলে বুঝত, এ শহর গঙ্গার স্রোতের মতোই গতিময়।

ফেলুদা, তোপসেরা যে দশাশ্বমেধ লজে উঠেছিল, তার পাশেই এখন নতুন গজিয়ে ওঠা দোতলা বৃহস্পতি মন্দির। শহরশেষের অসিঘাট একদা ছিল অন্ধকারে ঢাকা। মানসমন্দির বা সঙ্কটমোচন মন্দিরের পাশের রাস্তাতেই অবহেলায় পড়ে থাকত সেই ঘাট। এখন সেখানে ঝাঁ চকচকে সব শীতাতপনিয়ন্ত্রিত হোটেল। পিত্‌জা, আইসক্রিম, বইয়ের দোকান। নদীর ধারের বালিয়াড়িতে পার্কিং লট, বিদেশি ট্যুরিস্টের ভিড়ে ভর্তি। বারাণসী মানে আজকের বিশ্বনাথ থেকে বৃহস্পতি মন্দির, ঘাট ধরে পায়ে পায়ে হাঁটা থেকে পিত্‌জা সব।

এই মিনি ভারতে কে নেই? জৈন ধর্মের চার জন তীর্থঙ্করের জন্মই বারাণসীতে। শহরের চক এলাকায় নীচিবাগ গুরুদ্বার, সেখানে সাত মাস কাটিয়েছিলেন গুরু তেগ বাহাদুর। বিশ্বেশ্বরগঞ্জ এলাকার ছানাপট্টিতে আজও রয়েছে শ্রীচৈতন্যের স্মৃতিনিষিক্ত বটগাছ। তুলসীদাস গঙ্গাতীরের অসিঘাটেই শেষ করেছিলেন তাঁর ‘রামচরিতমানস’।

শহরের আর এক সন্তান কবির গঙ্গাস্নান-টান মানতেন না। কিন্তু বারাণসী ভোলেনি তাঁকে। আজও শহরের এক ব্যস্ত রাস্তার নাম কবিরচক।

বারাণসীর ইচ্ছাপত্র

• হেরিটেজ শহরের স্বীকৃতি

• গঙ্গা দূষণ থেকে মুক্তি

• গঙ্গায় স্বচ্ছ জলের পাশাপাশি ৭২টি ঘাটের যথাযথ সংস্কার

• বারাণসী শহর ঘিরে প্রস্তাবিত যে রিং রোড বছরের পর বছর
শুধুই কাগজকলমে রয়ে গিয়েছে, অবিলম্বে তার কাজ শুরু

• গোধূলিয়া মোড়, বেনিয়াবাগ, ক্যান্টনমেন্ট এলাকার
হাঁসফাঁস-করা যানজট থেকে বাঁচতে ফ্লাইওভার

• গঙ্গার ধারে শহর, তবু গলির মধ্যে অনেক জায়গায়
পরিস্রুত পানীয় জল পৌঁছায় না। সেই দুর্বিষহ অবস্থা থেকে মুক্তি

• নিকাশি ব্যবস্থার উন্নতি। বর্ষায় যেন রাস্তার নোংরা জলে হাবুডুবু না খেতে হয়

• বিদ্যুত্‌ পরিস্থিতির উন্নতি। প্রত্যহ গড়পড়তা ঘণ্টা পাঁচেক
লোডশেডিং এ শহরে যে ভাবে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা থেকে রেহাই

রবিশঙ্কর ছেলেবেলায় এই পাড়াতেই থাকতেন। আবার, পঞ্চগঙ্গা ঘাট বেয়ে সোজা উঠে গেলে ত্রৈলঙ্গ স্বামীর সমাধিমন্দির। আজও আছে তাঁর ব্যবহৃত খড়ম ও প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গ। দক্ষিণ দিকে আনন্দময়ী মা ও সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ ঘাট।রামকৃষ্ণ মিশনে প্রতি সন্ধ্যায় গান গেয়ে যে আরতি, তা বারাণসীর বিশ্বনাথ মন্দির থেকে শেখা। মথুরবাবুর সঙ্গে তীর্থ করতে এসে কেদারঘাটে থাকতেন শ্রীরামকৃষ্ণ। আজও সেই ঘাটের গৌরী কেদারেশ্বর মন্দিরে বাংলা ভাষায় অজস্র স্মৃতিফলক। ত্রিলোচন ঘাট বেয়ে ওপরে উঠে গেলে ত্রিলোচন শিবমন্দির। ঠাকুরের দেহত্যাগের পর মা সারদা বারাণসীতে তীর্থ করতে এসে এই মন্দিরে পুজো করেছিলেন। বলেছিলেন, “জাগ্রত, স্বয়ম্ভু লিঙ্গ।”

বাঙালি এই ইতিহাস ভুলে গিয়েছে। তার কাছে বারাণসী মানে হয় চোখের বালি-র বিনোদিনী, কিংবা পথের পাঁচালী, জয় বাবা ফেলুনাথ। দশাশ্বমেধ ঘাট, কেদারনাথ মন্দির আর বাঙালিটোলার ছোট্ট গণ্ডির বাইরে বাঙালি কোনও দিনই বারাণসীর বৃহত্তর জীবনের শরিক হয়নি।

বাঙালিটোলাটিও হাল আমলের ঘটনা। রেললাইন হওয়ার পর ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙালি আইনজীবী, ডাক্তার, শিক্ষকের চাকরি করতে গিয়ে ওই প্রাদেশিক মহল্লাটি গড়ে তুলেছিল।

বিনোদিনীর মতো বিধবা কেন কাশীবাসী হত, ১৮৮৬ সালে প্রকাশিত দুর্গাচরণ রায়ের ‘দেবগণের মর্তে আগমন’ বইয়ে তার বর্ণনা আছে। “বঙ্গে বিধবাবিবাহ প্রচলিত না থাকায় স্বামীসুখবাসে বঞ্চিত ইহারা পরপুরুষ সহবাসে গর্ভবতী হয়। উহাদের মাতাপিতা লোকাপবাদ ভয়ে এবং ভ্রূণহত্যা মহাপাপবোধে এই বারাণসী তীর্থে বনবাস দিয়া গিয়াছেন।”

বাঙালি শুধু জানে, কাশীতে মরলে মোক্ষলাভ। জায়গাটি পৃথিবীর মধ্যে থেকেও বাইরে, শিবের ত্রিশূলের ডগায় অবস্থান করে। কিন্তু এটি অনেক পরে, স্কন্দপুরাণের গল্প। তার আগে মহাভারতের বনপর্বে বলা হচ্ছে, “বারাণসীতে বৃষভবাহন মহাদেবকে অর্চনা করিলে রাজসূয় যজ্ঞের ফললাভ হয়। ব্রহ্মহত্যাজনিত পাপ থেকে বিনির্মুক্ত হয়।” রাজসূয় যজ্ঞ এবং ব্রহ্মহত্যার পাপক্ষালন শেষে তিন নম্বর লিস্টি: তথায় প্রাণ পরিত্যাগ করিলে মোক্ষপ্রাপ্ত হয়।

মহাভারত, জাতক এবং শঙ্করাচার্যের বারাণসী কিন্তু এই রকম ছিল না। জাতকের বিভিন্ন গল্পে বারাণসীর রাজা ব্রহ্মদত্তের সময় কখনও সাধু, কখনও জুয়াড়ি, কখনও বা বণিক হয়ে জন্মেছিলেন বোধিসত্ত্ব। বণিকজন্মে পাঁচশো গরুর গাড়ি ভর্তি পণ্যসামগ্রী নিয়েও যাতায়াত করেছেন। গঙ্গার ধারে জনপদটি যে একদা বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল, সহজেই বোঝা যায়। পুরাণে আছে, কাশীর রাজা দিবোদাস নাস্তিক বৌদ্ধদের ভক্ত হলে শিব বিরক্ত হয়ে এই শহর ছেড়ে কৈলাসে চলে গিয়েছিলেন। দেবতারা কোনও দিনই পরমতসহিষ্ণু নন।

কিন্তু দেবতাদেরও পরিবর্তন হয়। শঙ্করাচার্য কাশীতে গঙ্গাস্নানে যাচ্ছেন। আচমকা তাঁর পিছনে চারটি কুকুর নিয়ে এক চণ্ডাল। শংকর ‘দূর হঠো’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। অস্পৃশ্য চণ্ডাল সামনে এসে বলল, “কোথায় যাব? আপনি কি দেহটাকে সরে যেতে বলছেন? না আত্মাকে? আত্মা তো অদ্বৈত। কোথায় সরে যেতে বলছেন প্রভু? এক অন্নময় দেহ থেকে আর এক অন্নময় দেহে? নাকি এক চৈতন্য থেকে অন্য চৈতন্যে?” শংকর বুঝলেন, ইনিই স্বয়ং শিব। চণ্ডালের বেশে কাশীর গঙ্গাতীরে তাঁকে অদ্বৈততত্ত্ব বোঝাতে এসেছেন। কাশীশ্বরের মতিগতি বোঝা ভার। কখন বৌদ্ধদের প্রতি রেগে যাবেন, আবার কখন নিজেই অস্পৃশ্যবেশে দেখা দেবেন, কেউ জানে না।

আজকের কাশীশ্বর বিশ্বনাথ মন্দিরটি গড়ে দিয়েছিলেন ইনদওরের মহারানি অহল্যাবাই। আজও গঙ্গায় ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়বে অহল্যাঘাট, সিন্ধিয়াঘাট, ভোঁসলেঘাট, মানমন্দিরঘাট। “আজ যে বারাণসী আমরা দেখি, তার অনেকটাই মরাঠাদের তৈরি,” বলছিলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ‘বানারস: সিটি অব লাইটস’ বইয়ের লেখক ডায়ানা এক।

আজ নতুন ভাবে শহরের আশা আকাঙ্ক্ষা সেই পশ্চিম ভারতের মডেল নিয়ে। বাঙালি তার প্রিয় বিশ্বনাথভূমে শহরটার পরিকাঠামোর জন্য কিছু করেনি, তবু বাঙালিটোলা নামটি রয়ে গিয়েছে। বারাণসী কোনও দিন কিছু ফেলে দেয় না, মিথগুলি পরতের পর পরতে চিহ্ন ফেলে যায়। ঘাটে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা যে ছাতা নিয়ে বসেন, তার উল্লেখ পাবেন সারনাথের জাদুঘরে। শিলালিপি জানাচ্ছে, বালা নামে এক জন মা-বাবার স্মৃতিতে ছাতাসহ বুদ্ধমূর্তি গড়ে দিয়েছে। ঘাটে রোদ-ঝড় আটকানোর পাশাপাশি রয়ে গেল বৌদ্ধ সভ্যতার আবছা ছাপ।

সংকটা ঘাট বেয়ে উঠে কোনও শুক্রবার যদি সংকটামন্দিরে যান, দেবীর সামনে প্রশস্ত চাতালে স্থানীয় মহিলাদের ভিড়। সে দিনই তাঁর পুজো ও উপবাস। উত্তর ভারতে জনপ্রিয় সন্তোষী মা-র পুজোয় কোথাও ছাপ ফেলে গেলেন বারাণসীর সংকটা দেবী?

আজও মণিকর্ণিকা বা হরিশ্চন্দ্র ঘাটের শ্মশানে এসে জড়ো হয় কাঠবোঝাই সব নৌকো। মণিকর্ণিকায় নেই বৈদ্যুতিক চুল্লি। হরিশ্চন্দ্র ঘাটে থাকলেও কাঠের শ্মশানই জনতার বেশি পছন্দ। “যাদের কেউ নেই, সেই বেচারারা ইলেকট্রিকে যায়,” হরিশ্চন্দ্র ঘাটের সামনে দিয়ে যেতে যেতে বললেন নৌকা চালক। এত গুজরাত মডেল, ফ্লাইওভারের আশার মধ্যে কেউ এক বারও বলছেন না বৈদ্যুতিক চুল্লির কথা।

এটাই বারাণসী স্পিরিট। সহস্র পরিবর্তনেও রিচ্যুয়াল বয়ে নিয়ে যাওয়া। খোলা আকাশের নীচে মরদেহ ছাই হয়ে যাওয়া, পাশে উত্তরবাহিনি গঙ্গা। মিথ, ঐতিহ্য, আধুনিকতা সব এখানে জড়াজড়ি করে থাকে। কখনও চেনা ঠেকে, কখনও বা অচেনা। শুধু ধৈর্য রেখে চিনে নিতে হবে মাহেন্দ্রক্ষণটি। তখন শিবের অভিষেকেই ভেসে আসবে বিষ্ণুর মন্ত্র।

varanasi ghats goutam chakraborty
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy