Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
শনিবারের নিবন্ধ ৩...

সুবোধ বড় সুবোধ কবি

তাই কি? তিনি আদৃত। আবার যে নিন্দিতও! সদ্য সাহিত্য অকাডেমি প্রাপ্ত সুবোধ সরকার। লিখছেন হর্ষ দত্ত।যত দিন ধরে এই কবিকে দেখছি, কখনও মনে হয়নি সুখী বেড়ালটি হয়ে নিশ্চিন্তে কবিজীবন কাটিয়ে দেওয়ার জন্য সুবোধ কলম ধরেছেন।

শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৪ ০০:৩০
Share: Save:

এই সামান্য লেখাটির এমন শিরোনামে হয়তো মজা আছে, তবে নিজেই কবুল করছি, এতে সত্য নেই। কেননা যত দিন ধরে এই কবিকে দেখছি, কখনও মনে হয়নি সুখী বেড়ালটি হয়ে নিশ্চিন্তে কবিজীবন কাটিয়ে দেওয়ার জন্য সুবোধ কলম ধরেছেন। কৃষ্ণনগর নামক একটি জেলা সদরে বড় হওয়া একটি ছেলে ইচ্ছে করলেই নিজের আর্তিময়, দুঃখময়, ভিক্ষাবৃত্তির কাছাকাছি চলে যাওয়া জীবনের গল্প চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিয়ে, সহানুভূতির ভিজে ফুল কোঁচড় ভরে কুড়িয়ে নিতে পারত। ছেলেটি সে পথে হাঁটেনি। বলা ভাল, হাঁটতে ঘৃণা বোধ করেছে। বরং বেঁচে থাকার জন্যে, কবিতার প্রতিটি পঙ্ক্তিতে সসম্মান আত্মপ্রকাশের জন্যে একটা অনন্য জেদ সেদিন নিজের ভেতর গড়ে তুলেছিলেন আমাদের সমকালীন এই কবি। তার পর সেই জেদের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন তাঁর রাগ ও রাগী ইমেজ। ফলে, বেচারি কবিতাও ওঁর হাত থেকে রেহাই পায়নি। নিজের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বইয়ের ভূমিকায় সুবোধ লিখেছেন, “...আমি একটা জেদ নিয়ে বেঁচে আছি যে কবিতার শরীর থেকে সব গয়নাগাটি খুলে ফেলব। তাতে যদি কবিতা মার খায় খাক। এ কাজ আমার আগে অনেকে করে গেছেন। আমি আর একবার করব। কবিদের জন্যেও একটা ‘লক্ষ্মণরেখা’ আছে। সেটা মেনে চলতে হয়। কিন্তু কেন মেনে নেব? কেন আমি অন্যের জামা পরব? কেন আমি অন্যের থালায় খাব? ভিখিরিরও একটা নিজস্ব থালা থাকে।”

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

সুখের বিষয়, সুবোধ ওঁর সেই থালাটাকে একনাগাড়ে বাজিয়ে নিজের চারপাশে অর্থী-প্রার্থী-তাঁবেদার-মোসাহেবদের জড়ো করেননি। ছাপাখানার ভূতের মতো ব্যর্থ অনুজ কবিদের ঘাড়ে চেপে বসেননি। কবিযশঃপ্রার্থীদের ‘কবি করে দেব’ বলে মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছেন বলেও শুনিনি। বরং ‘প্রতিটি লোকের মধ্যে একটা হারামি আছে’ এই স্বীকারোক্তির ভেতরে কবি নিজেকেও ঢুকিয়ে নিয়েছেন, সতীলক্ষ্মীপনার ঘোমটা টেনে সুবোধ সরে থাকেননি। এই সাহসী আত্ম-উন্মোচন সুবোধকে মানুষ হিসেবে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে। কবি হিসেবে একটা নিজস্ব ঘরানা গড়ে তুলেছেন তিনি। ওঁর সমসাময়িক অনেকের চেয়ে নিজেকে এগিয়ে রেখেছেন।

এই স্বতন্ত্রতার জন্যেই আবার ওঁর চারপাশে নিন্দুক আর ঈর্ষাপরায়ণদের ফিসফাস, কু-ইঙ্গিত, উপেক্ষার ব্যর্থ উল্লাস। সুবোধের খ্যাতির আগুন যত লেলিহান হয়ে উঠেছে, ততই ওরা সক্রিয় হয়েছে ওঁর খ্যাতির ওপরে জল ঢেলে দেওয়ার জন্য। কিংবা নিদেন পক্ষে এক ছিরিক পেচ্ছাব! সুবোধ অবশ্য নিজেকে কবি নয়, অনায়াসেই বলতে পেরেছেন ‘আমি আরশোলা’। খ্যাতিমান হওয়ার শুরুর দিনগুলোতেই তিনি জানিয়ে রেখেছিলেন:

‘‘এ সব চিন্তা আগে করতাম, আর করি না
ছোট মুখে একটা বড় কথা বলি:
কবিতাকে শেষ অব্দি কবিতাই হতে হবে
তা সে বেশ্যার দেয়ালে ছাপা হোক
অথবা পুরোহিতের উঠোনে।
আপনি রবীন্দ্রসদনে দাঁড়িয়ে কবিতা পড়বেন
না জাহান্নমে
সেটা আপনি ঠিক করুন,
আমি বুঝে গেছি আমি কবি নই
আমি আরশোলা।’’

অতএব খ্যাতির দেওয়ালে নিজের পিঠ ঠেকে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সুবোধ সচেতন, আরশোলার মতো সচেতন। তবে এমন দুরন্ত আত্মঘোষণা সত্ত্বেও বাংলা কবিতার মিনাবাজারে একটা কথা চালু আছে বাপু, সুবিধাবাদ বস্তুটি কী যদি বুঝতে চাও তো সুবোধবাদটিকে বুঝে নাও। এই ব্যঙ্গোক্তির আবার হরেক ব্যাখ্যাও চালু আছে। যেমন: এক, সুবোধ খ্যাতির কাঙাল। খ্যাতিলাভের জন্যে মিত্রকে শত্রু ও শত্রুকে মিত্র করতে সদাপ্রস্তুত। দুই, ধান্দা চরিতার্থের জন্য কারও গাড়ির দরজা খুলে দিতেও সুবোধ পিছপা নন। তিন, যে সব কবি জেরুজালেমে পথ হারিয়েছে, সুবোধ তাঁদের অবলীলায় মেদিনীপুরের পথ দেখিয়ে দিতে পারেন। চার, বহু বিষয়ে ‘ছিঃ’ বললেও, রংবদল করার ব্যাপারে সুবোধ কিন্তু ছুৎমার্গী নন। পাঁচ, যদি বাজার মাত করতে চান, তবে সুবোধের মতো কবিতায় খিস্তিভাষার অকপট প্রয়োগে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠুন। ছয়, বাংলা কবিতার জয়যাত্রায় পা মেলাতে মেলাতে আপনি কি ক্লান্ত, প্রতারিত, বঞ্চিত, হতাশ! তবে আসুন, এ বার সুবোধের হাত ধরুন। এই কবি আপনাকে নিমেষে বুঝিয়ে দেবেন ‘যা উপনিষদ, তাই কোরান’।

এ সব নিন্দে-মন্দ, কুৎসিত আক্রমণ নিয়ে সুবোধ যে একেবারেই মাথা ঘামান না, নির্বিকল্প মহাযোগীর মতো সব উপেক্ষা করতে পারেন, এমন বললে বাড়িয়ে বলা হবে। আঘাত কি অভিঘাত ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া খুব সোজা কথা নয়। কেই বা পারেন? সুবোধও পারেন না, পারেননি। ভীষণ রি-অ্যাক্ট করেন। কবিতার পঙ্ক্তিতে ওঁর ক্ষোভ, ওঁর বজ্রনির্ঘোষ, ওঁর অস্থিরতা, প্রতিবাদ অন্তত সে কথাই বলে। তবে ওঁর হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসাই বুঝিয়ে দেয় সুবোধ আদতে কবি। ক্রমশবিলীন হয়ে আসা সেই সচেতন কবি, যিনি তাঁর দেশ, দেশের মানুষ, চারপাশের ক্ষুধার্ত-অপদার্থ পৃথিবী, পাপ-পুণ্য-ধর্ষণ-মিথ্যাচরণ-অপমান-দ্বিচারিতা সব কিছু তাঁর কবিতার বিষয় করে তুলতে পারেন অনায়াসে, ভালবেসে। তিনি বিশ্বাস করেন, যে-কোনও ভাষায় কবিতা গড়ে তোলা যায়। বাঁশ-দড়ি-খড়-মাটি-চুনকামে যদি সরস্বতীর নির্মাণ সম্পন্ন হতে পারে, তাহলে ‘শুয়োরের বাচ্চা’ আর ‘আগুনের পাখি’ শব্দগুলো পঙ্ক্তিবদ্ধ করলে কবিতা নির্মিত হবে না কেন? কেন কবিতার বিষয় হয়ে উঠবে না ‘লিঙ্গ মনোলগ (ভ্যাজাইনা মনোলগের উত্তরে)’? এই তর্ক তিনি অনায়াসে তুলতে পারেন।

দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছরের কাব্যচর্চার স্বীকৃতি স্বরূপ সুবোধ একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন। সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারটি হয়তো সেগুলোকে আপাতত ছাপিয়ে গেল। পুরস্কার পাওয়ার প্রতিযোগিতায় তিনি নিজেকে আলাদা প্রমাণ করতে পেরেছেন একই সঙ্গে কবিতার সৃষ্টিতে ও জনপ্রিয়তায়। স্রোতের বাইরে নিজেকে সুবোধ যে ভাবে বের করে আনতে পেরেছেন, তাকে সম্মান না জানালে অন্যায় হত। বাংলা কবিতায় ওঁর অবদান কত দূর, তা নিয়ে কথা বলার সময় এখনও আসেনি। শুধু এটুকু বলা যায়, স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত এক কবিকে সাহিত্য অকাদেমি সম্মান জানাল।

যে-বিষয়টি দিয়ে শুরু করেছিলাম, অর্থাৎ সুবোধের অবিমিশ্র ও অনমনীয় জেদ, সাহস, জিগীষা ইত্যাদি পুরস্কৃত ‘দ্বৈপায়ন হ্রদের ধারে’ কাব্যগ্রন্থের অভ্যন্তরেও রংহীন জলের মতো, হাওয়ার মতো, সুগন্ধের মতো মিশে আছে। উনিশশো আটাত্তর-ঊনআশি থেকে শুরু করে এই দু’হাজার তেরো পর্যন্ত, এক দীর্ঘ যাত্রাপথের পাশে পাশে পথজ ফুলের মতো, কাঁটার মতো, রঙিন ঝলকের মতো প্রতিমুহূর্তে সুবোধ সরকার রেখে যাচ্ছেন তাঁর সবচেয়ে দামি আত্মসম্পদ জেদ। ‘দ্বৈপায়ন হ্রদের ধারে’ শীর্ষক গ্রন্থনামের কবিতাটিতে সুবোধ কী অবলীলায় বলেছেন: ‘‘গ্রামে এখনও সময় করে সুবোধের এই আন্তরিক আমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারিনি। নিমন্ত্রণ তাই আজও থেকে গেছে অলিখিত অক্ষরে। তবে একদিন নিশ্চয়ই মুখোমুখি বসব। সেদিন সুবোধকে ওঁরই কবিতার ভাষায় বলব: আপনি সঠিক বলেছেন ‘এখনো জীবন মানে হিরের পাতাল’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE