ভোজ্য তেল উৎপাদনকারী পামগাছের চাষ উত্তরোত্তর বাড়ছে কংগ্রেস শাসিত দক্ষিণী রাজ্য তেলঙ্গানায়। এতে রয়েছে কী কী চ্যালেঞ্জ? পামচাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় কতটা ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের? আর কী ভাবেই বা এতে ফুলেফেঁপে উঠছে সেখানকার কৃষক সমাজ?
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০২৫ ১৭:৩০
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৯
আর প্রথাগত ধান, সব্জি বা ফুলের চাষ নয়। পামগাছে মন মজেছে তেলঙ্গানার কৃষকদের। দক্ষিণী রাজ্যটির চাষিদের দাবি, এতে বেশি লাভের মুখ দেখছেন তাঁরা। গত কয়েক বছর ধরে অবশ্য উত্তর-পূর্ব ভারতকে পাম চাষের হাব হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। সেখানে ‘ফিনিক্সের মতো’ তেলঙ্গানার কৃষক এবং সরকারের এ ব্যাপারে আলাদা করে উদ্যোগী হওয়াকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন কৃষি বিশেষজ্ঞ থেকে আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
০২১৯
রাজ্য সরকারের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে দক্ষিণী রাজ্যটির ২.৪৫ লক্ষ একর জমিতে হয় পামচাষ। এই পরিমাণ ২০ লক্ষ একরে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তেলঙ্গানা কৃষি দফতরের। সেই লক্ষ্যে বর্তমানের কংগ্রেস সরকার সফল হলে উত্তর-পূর্ব ভারত নয়, পামচাষের হাব হিসাবে গড়ে উঠতে পারে এই দক্ষিণী রাজ্য। তবে লক্ষ্যপূরণের পথে রয়েছে একাধিক চ্যালেঞ্জ, যেগুলি একেবারেই সহজ নয়।
০৩১৯
তেলঙ্গানার পামচাষের ইতিহাস কিন্তু নতুন নয়। ১৯৮৬ সালে ভোজ্য তেল উৎপাদনকারী এই গাছটির বপন শুরু হয় ওই দক্ষিণী রাজ্যে। সে সময়ে তেলঙ্গানা অবশ্য ছিল অন্ধ্রপ্রদেশের অন্তর্গত। কিংবদন্তি তেলুগু অভিনেতা তথা তেলুগু দেশম পার্টির (টিডিপি) প্রতিষ্ঠাতা নন্দমুরি তারক রামা রাও (পড়ুন এনটিআর) ছিলেন সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী। পামচাষিদের সুবিধার্থে বিধানসভায় বিশেষ একটি বিল পাশ করিয়েছিলেন তিনি। সেটি পরে আইনে রূপান্তরিত হয়েছিল।
০৪১৯
এনটিআরের ওই প্রচেষ্টা জলে যায়নি। পরবর্তী দশকগুলিতে তেলঙ্গানা এবং অন্ধ্রপ্রদেশে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে পামের ফলন। সরকারি তথ্য বলছে, বর্তমানে ঘরের মাটিতে উৎপাদিত পাম তেলের ৯৮ শতাংশ আসে দক্ষিণের তিনটি রাজ্য থেকে। সেগুলি হল তেলঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং কেরল। পাম তেল উৎপাদনে বাকি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির অবদান মাত্র দু’শতাংশ।
০৫১৯
সমীক্ষকদের দাবি, ২০২২ সাল থেকে তেলঙ্গানায় পামচাষের পরিমাণ রকেট গতিতে বৃদ্ধি পায়। শুধু তা-ই নয়, রাজ্যের ২৫টি জেলার কৃষকদের মধ্যে প্রথাগত চাষ ছেড়ে দিয়ে তেল উৎপাদনকারী গাছটির বপনে বেশি উৎসাহ লক্ষ্য করে সেখানকার কৃষি দফতর। আর তাই চলতি বছরের শেষে রাজ্যের মোট পাঁচ লক্ষ একর জমিতে পামচাষ ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে কংগ্রেস শাসিত রেভন্ত রেড্ডি সরকার।
০৬১৯
তেলঙ্গানা সরকারের দাবি, ২০১৪ সালে পামচাষের উপযুক্ত হিসাবে মাত্র ৪৫ হাজার একর জমিকে চিহ্নিত করা গিয়েছিল। কিন্তু এতে কৃষকদের উৎসাহ বাড়তে থাকায় বর্তমানে সেই অঙ্ক বেড়ে ২০ লক্ষ একরে পৌঁছে গিয়েছে। অন্য দিকে ২০২১ সালে পামচাষকে উৎসাহ দিতে ‘জাতীয় ভোজ্য তেল মিশন— তেল পাম’ বা এনএমইও-ওপি (ন্যাশনাল মিশন অন এডিবেল অয়েল্স— অয়েল পাম) শুরু করে কেন্দ্র। এতে আর্থিক দিক থেকে সুখের মুখ দেখেছেন দক্ষিণী রাজ্যটির চাষিরা।
০৭১৯
এনএমইও-ওপির নিয়ম অনুযায়ী পামচাষের খরচে ৬০ শতাংশ ভর্তুকি দেয় কেন্দ্র। বাকি ৪০ শতাংশ আসে রাজ্য সরকারের থেকে। এই আর্থিক সুবিধা থাকার কারণেই ভোজ্য তেল উৎপাদনকারী গাছটির বপন তেলঙ্গানায় দিন দিন বাড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে। বর্তমানে সেখানকার ২৪৬টি জেলা এবং ৫৬৬টি পঞ্চায়েতে বসবাসকারী কৃষকেরা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের এই যৌথ ভর্তুকির সুবিধা পাচ্ছেন।
০৮১৯
তেলঙ্গানায় নতুন করে পামচাষ শুরু হওয়া জেলাগুলির মধ্যে নালগোদা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৬-’১৭ আর্থিক বছরে সরকারি উদ্যোগে সেখানকার বিস্তীর্ণ এলাকায় ভোজ্য তেল উৎপাদনকারী গাছটির বপন শুরু করেন বেশ কয়েক জন চাষি। ২০২৪-’২৫ আর্থিক বছরে পৌঁছে দেখা যায় ওই জেলার মোট ১০ হাজার ৮০০ একর জমিতে ছড়িয়েছে এই চাষ। আর বিপুল এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আছেন প্রায় ২,৫০০ জন কৃষক।
০৯১৯
বর্তমানে তেলঙ্গানার যে ২.৪৫ লক্ষ একর জমিতে পামচাষ হচ্ছে, তার মধ্যে ১.৯৭ লক্ষ একর রয়েছে ‘জাতীয় ভোজ্য তেল মিশন— তেল পাম’-এর আওতায়। সেই কারণে ২০২৫-’২৬ অর্থবর্ষে নালগোদা জেলার ক্ষেত্রে এই চাষ আট থেকে সাড়ে ১২ হাজার একর জমিতে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে রেড্ডি সরকার। পামচাষে একরপিছু গড়ে লাখ টাকা আয় করে থাকেন সেখানকার কৃষকেরা।
১০১৯
কিন্তু, ভোজ্য তেল উৎপাদনকারী এই চাষে একটি সমস্যা রয়েছে। সেটা হল, প্রথম চার থেকে পাঁচ বছর একটি টাকাও ঘরে তুলতে পারবেন না চাষি। কারণ, এর আগে সাধারণত ফল ধরে না পামগাছে। কিন্তু, এ ক্ষেত্রেও ভর্তুকির সুযোগ রয়েছে কৃষকদের। প্রথম পাঁচ বছরে একরপিছু ২১ হাজার টাকা করে সরকারি কোষাগার থেকে পেতে থাকেন তাঁরা। বিশ্লেষকদের দাবি, এই সুবিধাও দাক্ষিণী রাজ্যটিতে পামচাষের আকর্ষণ বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে।
১১১৯
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ভোজ্য তেল উৎপাদনকারী পামগাছ কিন্তু মোটেই খাঁটি ভারতীয় নয়। এর আদি বাড়ি পশ্চিম আফ্রিকায়। একটা সময়ে এটিকে এ দেশে নিয়ে আসেন বিদেশিরা। বিষুবরেখার ১০ ডিগ্রি উত্তর বা দক্ষিণে পামগাছের ফলন সবচেয়ে ভাল হয়ে থাকে। উদ্ভিদটির বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা বেশি থাকা অত্যন্ত জরুরি।
১২১৯
কৃষি বিশেষজ্ঞদের দাবি, মৌসুমি বৃষ্টিপাত প্রবণ এলাকায় পামগাছের ভাল ফলন হওয়া কঠিন। এই গাছের বেড়ে ওঠার জন্য মাসে ১৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতই যথেষ্ট। তবে বছরে বর্ষণ ২৫০০ থেকে ৪০০০ মিলিমিটারের বেশি হলে এই চাষে ক্ষতি হওয়ার থাকবে আশঙ্কা। অন্য দিকে, বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা হতে হবে ৮০ শতাংশ। এক কথায় প্যাচপেচে গরম এবং অস্বস্তিকর আবহাওয়া পামগাছের বেড়ে ওঠার জন্য আদর্শ।
১৩১৯
সমুদ্র তীরবর্তী নোনা মাটিতে পামগাছ বেড়ে উঠতে পারে না। এর চাষের জমিতে প্রচুর পরিমাণে জৈবিক উপাদান থাকা ভাল। পামগাছের গোড়ার মাটি হতে হবে আর্দ্র। তবে সেখানে জল জমে গেলে চলবে না। সেই কারণে চাষের জমির নিকাশি ব্যবস্থা খুব ভাল হওয়া প্রয়োজন। সেই কারণে পরিবেশগত দিক থেকে পামচাষে তেলঙ্গানার কৃষকদের সামনে রয়েছে একগুচ্ছ চ্যালেঞ্জ।
১৪১৯
অন্ধ্রপ্রদেশ ভেঙে তৈরি হওয়া দক্ষিণী রাজ্যটি অতিরিক্ত শুষ্ক হওয়ায় অনেক সময়েই পামচাষিরা প্রয়োজনীয় জল পান না। তেলঙ্গানায় মূলত দু’ধরনের মাটিতে পামগাছ বপন করেন সেখানকার কৃষকেরা। লাল মাটিতে চাষের ক্ষেত্রে দিনে একরপ্রতি ২৫০ লিটার করে জল কিনতে হয় তাঁদের। আর কালো মাটি হলে জল কেনার পরিমাণ দাঁড়াবে দিনে ১৫০ লিটার। উপরন্তু, এই চাষের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ না থাকায় সমস্যার মুখে পড়ছেন তেলঙ্গানার কৃষকেরা।
১৫১৯
কৃষি বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, দক্ষিণী রাজ্যটির সেচব্যবস্থা মোটেই তেমন ভাল নয়। এই অবস্থায় অতিরিক্ত লাভের আশায় যে ভাবে চাষিরা পামচাষ করছেন, তাতে ভবিষ্যতে ভয়ঙ্কর আকার নিতে পারে জলসঙ্কট। এর পরিবেশগত প্রভাবও হবে সুদূরপ্রসারী। আর তাই এখন থেকে বিকল্প কোনও রাস্তা খুঁজে বার করার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
১৬১৯
পামচাষে জলের সমস্যা মেটাতে তেলঙ্গানার কৃষকেরা দু’টি পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন। প্রথমত, গাছগুলিকে প্রয়োজনমতো ভিজিয়ে দিতে স্প্রে জাতীয় যন্ত্র ব্যবহার করা উচিত তাঁদের। এতে জল খরচ কিছুটা কমবে। পাশাপাশি, সেখানকার কংগ্রেস সরকারকে উন্নত সেচ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য যথেষ্ট উদ্যোগী হতে হবে। কিছু কিছু কৃষক আবার পামচাষে প্রশিক্ষিত ভাগচাষিদের ব্যবহার করে থাকেন। এর জন্য তাঁদের খরচ দুই থেকে তিন হাজার টাকা বেড়েছে বলে জানা গিয়েছে।
১৭১৯
পরিবেশগত এই চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও পিছিয়ে আসতে রাজি নয় তেলঙ্গানা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাজ্যে ভোজ্য তেল উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তুলতে বহুজাতিক সংস্থা হিন্দুস্তান ইউনিলিভারের সঙ্গে একটি স্মারক সমঝোতা বা মউ (মেমরেন্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং) চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সেখানকার রেড্ডি সরকার। আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে ওই কারখানা পুরোপুরি তৈরি হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
১৮১৯
পামচাষকে লাভজনক করে তুলতে তেলঙ্গানার অধিকাংশ কৃষকের রয়েছে ভোজ্য তেল উৎপাদনকারী গাছটির বাগান। সেখানে দিনে আট থেকে ১০ ঘণ্টা কাজ করতে হয় তাঁদের। রাজ্য সরকারের কৃষি দফতরের এক পদস্থ আধিকারিক জানিয়েছেন, এই চাষে বেশি কৃষিকর্মীর প্রয়োজন হয় না। ধান, গম ও তুলোর চাষে রোগ, পোকামাকড় এবং আগাছার দিকে নজর রাখা প্রয়োজন। সেখানে এই চাষে ১৫ দিন অন্তর অন্তর বাগানের মাটিতে সার বা গাছের গোড়ায় পুষ্টি যোগ করলেই চলবে।
১৯১৯
বিশেষজ্ঞদের অনুমান, কম পরিশ্রমে বেশি আয়ের সুযোগ থাকার কারণেই তেলঙ্গানার কৃষক সমাজ পামচাষের দিকে মাত্রাতিরিক্ত ভাবে ঝুঁকে পড়েছে। ফলে সেখানে সমৃদ্ধ কৃষিক্ষেত্র গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। জলসঙ্কট এবং অন্যান্য পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলিকে কাটিয়ে দক্ষিণী রাজ্যটির পাম ‘টাকার গাছ’ হয়ে ওঠে কি না, সেটাই এখন দেখার।