Advertisement
E-Paper

গ্র্যান্ড হোটেল, নিজাম প্যালেস ওঁদেরই তৈরি

ওঁরা আর্মেনিয়ান। এক সময় হাজার হাজার আর্মেনিয়ান বাস করতেন কলকাতায়। এখন সংখ্যাটা মেরেকেটে শ’খানেক। গত কাল ছিল ওঁদের বড়দিন।ওঁরা আর্মেনিয়ান। এক সময় হাজার হাজার আর্মেনিয়ান বাস করতেন কলকাতায়। এখন সংখ্যাটা মেরেকেটে শ’খানেক। গত কাল ছিল ওঁদের বড়দিন।

সায়ন্তনী সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
প্রার্থনা: কলকাতার আর্মেনিয়ান চার্চের অন্দরে

প্রার্থনা: কলকাতার আর্মেনিয়ান চার্চের অন্দরে

ব্যস্ত রাস্তার কোণে একটা গির্জা। বিষণ্ণ কবরের সারি। কলকাতার প্রাচীনতম খ্রিস্টান সমাধি। ছিমছাম কলেজ। আর এই সব কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কিছু মানুষ, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ দেশে আসারও অনেক আগে যাঁরা ভারতে এসেছিলেন সুদূর আর্মেনিয়া থেকে। আত্মীয়হীন, স্বদেশের সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত মানুষগুলোর গায়ে লেগে আছে পুরনো কলকাতার গন্ধ। ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে যাওয়ার সময় কলকাতায় প্রায় ৩০ হাজার আর্মেনিয়ান ছিলেন। এখন সংখ্যাটা মেরেকেটে একশো।

ভাস্কো দা গামা ভারতে আসার অনেক আগে, ৭২০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ টমাস কানা নামের এক আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ী ভারতের মালাবার উপকূলে এসে পৌঁছন। কিন্তু ষোড়শ শতকের আগে এখানে আর্মেনিয়ানদের পাকাপাকি বসবাসের কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। দামি পাথর আর সূক্ষ্ম বস্ত্রের কারবারি আর্মেনিয়ানদের ব্যবসার জন্য ভারতে আমন্ত্রণ জানান সম্রাট আকবর। কোনও কোনও ইতিহাসবিদের মতে, মারিয়ম জামানি বেগম নামে আকবরের এক আর্মেনিয়ান স্ত্রীও ছিলেন। আকবরের প্রধান বিচারপতি আবদুল হাই ছিলেন আর্মেনিয়ান। এমনকী তুখড় রাঁধুনি এক আর্মেনিয়ান দখলে নিয়েছিলেন মুঘল রসুইখানার প্রধান পাচকের পদও। ভারতের প্রথম আর্মেনিয়ান চার্চটিও আকবরের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হয় আগরায়।

কলকাতাও এই আর্মেনিয়ানদের আশ্রয় দিয়েছিল। শহরের ইতিহাসে এঁদের অবদান কম নয়। অথচ ট্রাম-রাস্তা, বিরিয়ানির দোকানের পাশ কাটিয়ে মির্জা গালিব স্ট্রিটে ঢুকে আর্মেনিয়ান কলেজটা কোথায় জানতে চাইলে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন পথচারী, দোকানদাররাও।

প্রাচীন: আর্মেনিয়ান চার্চের সদর প্রাঙ্গণ।

কলকাতার মধ্যে এক টুকরো নরম আর্মেনিয়া। প্রশস্ত সবুজ মাঠ। এক ঝাঁক হাসিমুখ। আঠারো শতকের শেষ দিকে একটা স্কুল গড়ে ওঠে, কিছু বছর পর আর একটি। ১৮২১ সালে আর্মেনিয়া ফিলানথ্রপিক অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠার সময় দু’টি স্কুল মিলেমিশে যায়। মাঝে চার বছর ছিল কলেজও, এখন প্রতিষ্ঠানের নামে কলেজ শব্দটা রয়ে গেলেও পড়ানো হয় কেবল দশম শ্রেণি পর্যন্ত। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মাত্র ৭৪ জন আর্মেনিয়ান। আবাসিক স্কুলটাই এদের বাড়ি। কলেজের কো-অর্ডিনেটর আরমেন মাকারিয়ান বললেন, পড়া শেষে অস্ট্রেলিয়া বা আমেরিকায় চলে যায় সবাই। কেউ কেউ পরিবারের কাছে আর্মেনিয়াতেও ফিরে যায়। এ দেশে থাকে না কেউই। কথা হল স্টিফেন সারকিস এর সঙ্গে। বোন মেরিকে নিয়ে থাকেন চৌরঙ্গি লেনের এক বহুতলে। বাবা এসেছিলেন আর্মেনিয়া থেকে, আর ফেরেননি। জানালেন, আর্মেনিয়ানরা বিয়ে-থার ব্যাপারে এখনও রক্ষণশীল। তবে এখন অনেকেই গুজরাটি, সিন্ধি বা অন্যান্যদের বিয়ে করছেন।

আর্মেনিয়ানরা পয়সাওয়ালা ছিলেন। নীল চাষ, দামি পাথরের অলংকার, জাহাজ, বস্ত্র— অগুনতি ব্যবসা ছিল ওঁদের। ষোড়শ শতকে ওঁদের ব্যবসাপত্তরের কেন্দ্র ছিল চুঁচুড়া। পরে কলকাতাই হয়ে ওঠে ওঁদের বসবাসের শহর। ১৭৩৪ সালে মানভেল হাজার মালিয়ান বা হুজুরিমাল হাওড়ার কাছে তৈরি করেন আর্মেনিয়ান ঘাট। জলপথে আর্মেনিয়ানদের ব্যবসার প্রয়োজনেই এই ঘাটটি তৈরি করা হয়। আরাথুন স্টিফেন নামে এক আর্মেনীয় গ্র্যান্ড হোটেল তৈরি করেন। স্টিফেন কোর্ট, হোটেল কেনিলওয়ার্থ, কুইন্স ম্যানসন সহ আরও বহু বাড়ি তৈরি করেছিলেন আর্মেনিয়ানরা। পার্ক ম্যানসন-এর নির্মাতা থাডেয়াস নামে এক আর্মেনীয়ের নাকি রোলস রয়েস ছিল। রেস কোর্সের রাজা জোহানস গলস্তাউন কলকাতায় প্রায় ৩৫০টি অট্টালিকা বানান। রেসকোর্স দাপিয়ে বেড়াত তাঁর দেড়শো ঘোড়া। নিজে থাকার জন্য তৈরি করেন নিজাম প্যালেস। সেই সময় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল-এর জন্য দান করেছিলেন ২৫ হাজার টাকা। ধনী আর্মেনিয়ানদের উৎসব আর পার্টিও হত সেই মাপের। প্রতি রাতে কলকাতার বড় হোটেল আর বারগুলি মাতিয়ে রাখতেন আর্মেনিয়ান যুবারা। খোলামকুচির মত টাকা উড়ত। চতুর্দিক শ্যাম্পেনে ভিজিয়ে ঢলে পড়ত রঙিন রাত। রাতের সেরা সুন্দরীকে ঘিরে থাকত রূপমুগ্ধ প্রণয়ীর দল। বহুমূল্য গাড়ি থেকে চোখ-ধাধাঁনো হিরে উজাড় করে দিতেন প্রেমপ্রার্থীরা।

সেই সব দিন এখন স্বপ্নের মতো মনে হয়। সে দিনের সুন্দরীরা কবেই এ দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন। যাঁরা রয়ে গিয়েছেন, তাঁদের ঠাঁই এখন পার্ক সার্কাসের ‘স্যর ক্যাথিক পল চ্যাটার হোম ফর দ্য এল্ডারলি’ নামে এক বৃদ্ধাশ্রমে। অধিকাংশ ঘরই তালাবন্ধ। বৃদ্ধাশ্রম চত্বরেই বহু সমাধি। পুরনো দিনের কথা বলতে গিয়ে চোখের কোণ চিকচিক করে উঠল একাশি বছরের বেটি অ্যাডামস-এর। নিজে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, বিয়ে করেছিলেন আর্মেনিয়ান যুবক ম্যাক অ্যাডামসকে। দু’জনের পরিচয় হয়েছিল বাস্কেটবল কোর্টে। মহা সমারোহে হয়েছিল বিয়ে। আর্মেনিয়ান পরিবারের রান্নাবান্না, কায়দাকানুন কিছুই জানতেন না বেটি। যত্ন করে সব শিখিয়েছিলেন তাঁর শাশুড়ি। আর্মেনিয়ানদের প্রিয় খাবার দোলমা। আঙুরপাতায় জড়িয়ে ভাত আর মাংসের কিমা দিয়ে তৈরি ভারী সুস্বাদু পদ। পালংশাক কিমা আর গ্রেটেড চিজ, ক্যাপসিকাম, কিসমিস দিয়ে ওমলেট প্রাতরাশে বাঁধা ছিল। বৃদ্ধাশ্রমে এসে যত্ন করে আঙুরগাছ লাগিয়েছিলেন বেটি। এক আর্মেনিয়ান মালি দেখভাল করত তার। সে মারা যাওয়ার পর বাঙালি মালি আর আঙুরগাছের মর্ম বোঝেনি। বেটি অ্যাডামসের পাশের ঘরেই থাকেন মার্চেন রোসিয়ান। যৌবনে বড় সুন্দরী ছিলেন। প্রেমে পড়েছিলেন এক ব্রিটিশ পাইলটের। বাড়ির আপত্তি অগ্রাহ্য করেই হয়েছিল বাগদান। কিন্তু পর দিনই এক প্লেন অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান জর্জ। আর বিয়েই করেননি রোসিয়ান। বিছানা থেকে উঠতে কষ্ট হয় আজকাল। তৃষিতের মতো অপেক্ষা করেন বুধবারের। এই দিনে বৃদ্ধাশ্রম সংলগ্ন সেন্ট গ্রেগরি চ্যাপেলে আর্মেনিয়ান কলেজের ছাত্রছাত্রীরা রেভারেন্ড ফাদার আর্টসার্ন-এর সঙ্গে আসেন। চার্চের কাজে ফাদার মাত্র দেড় বছর আগে এসেছেন আর্মেনিয়া থেকে। বেটি, রোসিয়ানদের আশীর্বাদ করেন ফাদার। আর বাচ্চাদের কাছ থেকেই আবাসিকরা জানতে পারেন, কেমন আছে তাঁদের পূর্বপুরুষদের ফেলে আসা দেশ।

রেজাবিবে সুকিয়া-র এই সমাধিই কলকাতার প্রাচীনতম খ্রিস্টান সমাধি

২৫ ডিসেম্বর ক্রিসমাস পালন করেন না আর্মেনিয়ানরা। ফাদার আর্ডসার্ন বললেন, বাইবেলে জিশুর জন্মদিনের কোনও স্পষ্ট উল্লেখ না থাকায়, একেবারে প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী ৬ জানুয়ারি জিশুর জন্মদিন ও ব্যাপটিজম-এর দিন একই সঙ্গে পালন করে আর্মেনিয়ান অর্থোডক্স চার্চ। বস্তুত চতুর্থ শতকের আগে পর্যন্ত খ্রিস্টানরা এই সময়েই বড়দিন পালন করত। পরে ক্রিসমাসের দিন পালটালেও আর্মেনিয়ানরা নিজেদের ঐতিহ্য থেকে সরে আসেননি। নিয়মমত ওঁরা ক্রিসমাসের বেশ কিছু দিন আগে থেকে নিরামিষ খান। ক্রিসমাস ইভে খাওয়া হয় অ্যাপ্রিকট আর গম দিয়ে তৈরি বিশেষ পুডিং। আগে ট্রাডিশনাল খাবার হিসাবে অর্ডারি ট্রাউট আনিয়ে তা দিয়ে তৈরি করা হত ‘প্রিন্সলি ট্রাউট’। এখন যে কোনও মাছ দিয়েই তৈরি করা হয় পদটি। বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দারা অশক্ত শরীরেও আসেন আর্মেনিয়ান হোলি চার্চ অব নাজারেথ-এ। সহজ পাঠে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘আর্মানি গির্জের কাছে আপিস’-এর কথা। এই গির্জাটি আর্মেনিয়ান স্ট্রিট-এ, ছোট্ট যে রাস্তা আমাদের চোখে পড়ে না, অথচ চিনি তারই গা-ঘেঁষা ব্রেবোর্ন রোডকে। ১৬৮৮ সালে তৈরি এই চার্চ কলকাতার প্রাচীনতম চার্চ। ১৭০৭ সালে ভয়ংকর এক আগুনে পুড়ে গিয়েছিল, পরে ১৭২৪ সালে আবার গড়ে তোলা হয়। লেভন গেভনড নামের এক আর্মেনিয়ান ছিলেন এই গির্জার স্থপতি। এখন দোকানপাটের ভিড় গিলে নিয়েছে মূল ফটকটাই। অথচ কয়েক লক্ষ কোটি টাকার মালিক কলকাতার এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সম্পত্তি নির্ধারণের প্যানেল তৈরির দিন রীতিমত পুলিশ মোতায়েন করতে হয়েছিল এই চার্চে।

আগে ক্রিসমাসের সময় দামি গাড়ির ভিড়ে সরগরম হত আর্মেনিয়ান স্ট্রিট। সামনের বিরাট বটগাছের ছায়ায় আড্ডা জমত চালক আর কোচোয়ানদের। গির্জার চত্বরের মধ্যেই শ্বেতপাথরের কারুকার্য করা প্রিয়জনের সমাধিতে ফুল দিয়ে বাড়ি ফিরতেন সবাই। কলকাতার সব থেকে পুরনো খ্রিস্টান সমাধিও আছে এখানেই। ১৬৩০ সালের ২১ জুলাই সমাধিস্থ করা হয় রেজাবিবে সুকিয়া নামে এক আর্মেনিয়ান মহিলাকে। তবে শেষ কবে এই চার্চে কাউকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল, মনে করতে পারেন না কেউ। যে ক’জন বেঁচে আছেন, মৃত্যুর পর তাঁদের হয়তো ঠাঁই হবে পার্ক সার্কাস বা ট্যাংরার চার্চে, বিষণ্ণ হাসেন চার্চের গেটকিপার।

স্মৃতির উষ্ণতা শক্ত মুঠির মধ্যে ধরে বেঁচে আছেন কলকাতার আর্মেনিয়ানরা। আর্মেনিয়া এঁদের কাছে ছেলেবেলায় মা-বাবার কাছে শোনা রূপকথার দেশ। এই দেশ, এই শহরই ওঁদের অস্তিত্ব, ভালবাসা। বাংলা সাহিত্যেও উজ্জ্বল হয়ে আছে আর্মেনিয়া, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘শ্যাম সাহেব’-এ মুখ্য চরিত্র স্যামুয়েল অ্যারাটুনও ছিলেন আর্মেনিয়ান। বাস্তবের কলকাতার আর্মেনিয়ানরা শেষ দিন পর্যন্ত থেকে যেতে চান এই শহরেই।

Armenians Nizam Palace Grand Hotel আর্মেনিয়ান চার্চ Armenian Church গ্র্যান্ড হোটেল নিজাম প্যালেস
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy