Advertisement
E-Paper

নদীর প্রহরা ওঁদেরই হাতে

গঙ্গায় মালবাহী নৌকার ভিড় সামলাতে আর ডাকাতি রুখতে তৈরি হয়েছিল রিভার ট্র্যাফিক পুলিশ। লোকমুখে তাঁরাই জলপুলিশ। বালি থেকে বজবজ, রক্ষা করেন নদীকে। গঙ্গায় মালবাহী নৌকার ভিড় সামলাতে আর ডাকাতি রুখতে তৈরি হয়েছিল রিভার ট্র্যাফিক পুলিশ। লোকমুখে তাঁরাই জলপুলিশ। বালি থেকে বজবজ, রক্ষা করেন নদীকে।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
রক্ষী: কলকাতা বন্দরে। ১৯৭৮ সালের ছবি

রক্ষী: কলকাতা বন্দরে। ১৯৭৮ সালের ছবি

আশিতে আসিও না’ সিনেমায় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত সংলাপ ছিল, ‘‘আমি এখন জলপুলিশের আন্ডারে।’’ কলকাতা, গঙ্গা আর নদীপথে সুদীর্ঘ বাণিজ্যের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে রয়েছে এই জলপুলিশ। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, জোব চার্নক কলকাতায় ঘাঁটি গাড়বার পর থেকেই নদীপথে বাণিজ্যের ঢল নামে। এই নদীকে ঘিরেই জমে উঠেছিল ব্রিটিশ ভারতের প্রথম রাজধানীর কাজ-কারবার।

এখন যেখানে বাবুঘাট, মিলেনিয়াম পার্ক, সেই পুরো জায়গাটা জুড়েই এক সময় ছিল কলকাতা বন্দর! আস্তে আস্তে গড়ে ওঠা জনপদের তখন লোকমুখে চালু নাম ‘ডিহি কলিকাতা’ আর ‘বাজার কলিকাতা’। জনশ্রুতি অনুযায়ী জোব চার্নক অবশ্য নেমেছিলেন আরও উত্তরে, সুতানুটিতে। এখনকার হাটখোলার কাছে। তবে বন্দর তৈরির জন্য সুতানুটি নয়, ডিহি কলকাতাকেই বেছে নিয়েছিলেন সাহেবরা। তখনকার ভৌগোলিক ছবিটাও ছিল অনেক আলাদা।

কলকাতার ইতিহাস-লেখক পি থঙ্কপ্পন নায়ার একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, পুরনো ফোর্ট উইলিয়াম যেখানে ছিল, এখনকার জিপিও-র কাছেই একটি সরু খাল বয়ে যেত। সেখানেই আঠেরো শতকে একটি ‘ড্রাই ডক’ তৈরি করা হয়, বণিকের বজরা, জাহাজ তৈরির জন্য। কিন্তু সে সব তৈরি করলেই তো হবে না, জলেও তো ভাসাতে হবে! একটি দিঘিকে নাকি ‘ওয়েট ডক’ হিসেবে কাজে লাগানো হয়েছিল।

কিন্তু এখন তো সে সবের লেশমাত্রও চোখে পড়ে না! বিভিন্ন ইতিহাসবিদের লেখা থেকেই জানা যায়, পলাশির যুদ্ধ জেতার পরে কর্নেল রবার্ট ক্লাইভের পরামর্শেই সে সব বদলে ফেলা হয়। সেই জায়গায় গড়ে ওঠে ব্যাঙ্কশাল স্ট্রিট, ব্যাঙ্কশাল কোর্ট। এখনকার ইডেন উদ্যানের উত্তর দিক থেকে চৌরঙ্গি হয়ে এন্টালি অবধি বয়ে যাওয়া খাঁড়ি বা ক্রিক ছিল সে কালের কলকাতার দক্ষিণ সীমা। এখন ওয়েলিংটন থেকে এন্টালির দিকে যে সরু রাস্তাটা চলে গিয়েছে, সেই ক্রিক রো-ই বুকে নিয়ে চলেছে হারিয়ে যাওয়া খাঁড়ির স্মৃতি।

ডক সরে গেলেও ‘ডিহি কলিকাতা’ জুড়ে তখনও নৌকা, জাহাজের কারবারিদের ভিড়। কিন্তু বাদ সাধল ব্রিটিশ সরকারের নয়া পরিকল্পনা। লটারি কমিটির টাকায় শুরু হল গঙ্গার পাড় ঘেঁষে রাস্তা তৈরির কাজ। ১৮২০ সালে স্ট্র্যান্ড রোড তৈরি হল। এ দিকে আবার হুগলি নদীর কলকাতার দিকে বিস্তৃত চড়া পড়তে শুরু করায় জাহাজের কারখানা পাততা়ড়ি গুটিয়ে চলে গেল হাওড়ায়। এই কলকাতার ডক তৈরির কাজেই জড়িয়ে রয়েছে এক সাহেব সেনা অফিসারের নামও, মেজর টলি। তাঁর উদ্যোগেই ডক তৈরির কাজ শুরু। গঙ্গার পাড় ধরে ব্যবসার কথা মাথায় রেখে আঠেরো শতকেই তিনি আদি গঙ্গা সংস্কারের কাজও করিয়েছেন। তৈরি হয়েছে ‘টলি নালা’। লোকমুখে সেটাই আজ টালি নালা। ‘টালিগঞ্জ’ নামটাও সেই থেকেই।

টলি-তেই থেমে থাকেনি সাহেবদের উদ্যম। আর এক সেনা অফিসার কর্নেল ওয়াটসন ডিহি কলকাতার দক্ষিণে শুরু করেছিলেন মেরিন ডক তৈরির কাজ। অবসরের আগে সেই কাজ পুরোপুরি শেষ করতে পারেননি সাহেব। তবে তাঁর প্রতিপত্তি এলাকায় ছড়িয়েছিল। ওই এলাকার নামও হয়ে গেল তাঁর নামেই, ওয়াটগঞ্জ। ওয়াটসন তো চলে গেলেন, কিন্তু কোম্পানির সাধের মেরিন ডক কি তৈরি হবে না? এগিয়ে এলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তৎকালীন চিফ ইঞ্জিনিয়ার কর্নেল কিড ও তাঁর লোকেরা। গড়ে উঠল ক্যালকাটা ডক। সেই কিড সাহেবের নামেই পরিচিত হল বন্দর এলাকা। স্থানীয় বাসিন্দারা বলতেন, ‘কিডেরপুর’। সেই নামই লোকমুখে বদলাতে বদলাতে হয়েছে আজকের খিদিরপুর।

তবে ‘কিডেরপুর’ তৈরির আগেও গঙ্গার গা ঘেঁষে সাহেব তৈরি করে ফেলেছিলেন এক বিরাট বাগান। নানা মূল্যবান গাছ এবং মশলার চাষ হত সেখানে। কালে কালে শিবপুরের সেই বাগানই হয়ে ওঠে এশিয়ার বৃহত্তম বটানিক্যাল গার্ডেন। এখন ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর সুড়ঙ্গ নিয়ে এত শোরগোল। অথচ বটানিক্যাল গার্ডেনের ভিতর দিয়ে গঙ্গার তলা দিয়ে বিদ্যুতের কেব্‌ল নিয়ে যাওয়ার সুড়ঙ্গ তৈরি হয়েছিল ব্রিটিশ আমলেই। আজও নাকি আছে সেই সুড়ঙ্গ!

শিবপুর বাগানের উল্টো দিকেই কলকাতার দক্ষিণে গঙ্গা লাগোয়া এলাকা মেটিয়াবুরুজ। সেখান থেকে ফেরি পার হলেই গার্ডেন। এই পার হওয়ার সূত্রেই জায়গার নাম হয়ে গেল গার্ডেনরিচ। এই এলাকায় পরে নির্বাসনে জীবন কাটাবেন অযোধ্যার নবাব ওয়াজ়িদ আলি শাহ।

শিবপুর থেকে উত্তরে তৈরি হয়েছে হাও়ড়া স্টেশন। রেলপথে জু়ড়েছে বাংলা, দেশের নানা প্রান্ত। আরও কিছুটা উত্তরে হেঁটে গেলেই দেখা মিলত বিরাট বিরাট গুদামের। কোনওটিতে নুন থাকত, কোনওটিতে পাট। জাহাজ, নৌকার ভি়ড় লেগেই থাকত। গুদাম বা গোলা থেকেই জায়গার নাম হয়ে গেল গোলাবাড়ি। সেই গুদামের সারি স্বাধীনতার পরেও ছিল। এখন কমে গেলেও উধাও হয়নি।

কলকাতার দিকে গঙ্গার ঘাটে রয়ে গিয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় নাবিকদের যোগদানের স্মৃতিও। ওই নাবিকদের কথা মনে রেখেই তৈরি হয়েছে লস্কর মেমোরিয়াল। ভারতীয় বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নাবিকদের ‘লস্কর’ বলা হত। কিংবা সুরিনামে পাড়ি দেওয়া শ্রমিকদের কথা মাথায় রেখেই ঘাটের নাম হয়েছে সুরিনাম ঘাট। এই নদীপথ বেয়েই এক সময় ‘কাজে’ বেরোত কুখ্যাত সব ডাকাত। গঙ্গার পাড় ঘেঁষেই ছিল তাদের আরাধ্যা দেবীমন্দির।

ব্যবসা বা়ড়তে থাকায় জলপথে নৌকার ভিড় সামলাতে, আপদ-বিপদ ঠেকাতে তৈরি হল রিভার ট্র্যাফিক পুলিশ। বাঙালির মুখে সেটাই হয়ে ওঠে জলপুলিশ! মালবাহী নৌকোয় ডাকাতি রুখতে এই পুলিশই ছিল ভরসা। এখনও গঙ্গায় রয়ে গিয়েছে জলপুলিশ। এই বাহিনী প্রথমে ছিল বন্দরের অধীনে। পরে তা জু়ড়ে যায় কলকাতা পুলিশের সঙ্গে।

বর্তমানে জলপুলিশে কাজ করা এক অফিসারই বলছিলেন, রাস্তায় যেমন ট্র্যাফিক পুলিশের ইশারা মেনে গা়ড়ি চলে, তেমনই গঙ্গায় জলপুলিশের ইশারা মেনে নৌকা চলত। কার তরী কখন পাড়ে ভিড়বে, কে তীর ছে়ড়ে পাড়ি দেবে উজানে সে সবই ঠিক করত জলপুলিশ! অতীতের তথ্য অনুযায়ী, সে সময় ৯ জন অফিসার, ১৮ জন পিওন এবং ৯২ জন মাঝি ছিল জলপুলিশের। সাহেব ম্যাজিস্ট্রেটদের জন্য থাকত ছাউনি দেওয়া ব়ড় নৌকা। টহলদারির জন্য ছিল ৯টি নৌকা।

গঙ্গার পাড় ঘেঁষেই কাশীপুরে ১৮০২ সালে গজিয়ে উঠল প্রথম অস্ত্র কারখানা, ‘গান ক্যারেজ এজেন্সি’। ধাপে ধাপে সেই কারখানাই হয়ে উঠল ‘গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্টরি’। নানা ঘাত-প্রতিঘাতে দু’শতক পার করে এখনও রয়েছে সেই অস্ত্র কারখানা। তার দেওয়ালে, উঠোনে জেগে রয়েছে ইতিহাস। উনিশ শতকের গো়ড়া থেকেই কাশীপুর থেকে ফোর্ট উইলিয়ামে অস্ত্র আসত নদীপথে। কখনও আবার এই নদী বেয়েই ফোর্ট উইলিয়াম থেকে সরঞ্জাম যেত কারখানায়। গঙ্গার দু’পাড়ে তৈরি হওয়া চটকল, তা ঘিরেও তো কত বসতি, কত ঘটনা!

কিন্তু সেই গঙ্গা আর নেই। ‘ডিহি কলিকাতা’ তো দূরের কথা, মজে যাওয়া নদীতে খিদিরপুরেই আর বড় জাহাজ ভেড়ে না। চটকলগুলোও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যে ক’টা টিকে আছে, ধুঁকছে তারাও। জলপুলিশের কাজও কমে গিয়েছে। তবে তাঁরা নদীতে এখনও পাহারা দেন, ডুবে যাওয়া মানুষকে বাঁচান। এই তো কিছু দিন আগেই কোলের সন্তানকে নিয়ে হাওড়া স্টেশনের কাছে গঙ্গায় ঝাঁপ দেন এক মহিলা। কাছেই থাকা একটি টহলদারি নৌকা তাঁদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। মা বাঁচলেও সন্তান বাঁচেনি।

আফসোস করছিলেন এক অফিসার। বলছিলেন, প্রায় রোজই কোনও না কোনও দেহ ভেসে আসে। কারও পরিচয় মেলে, কারও মেলে না। ‘‘শুনেছি, সৎকার করা নাকি পুণ্যের কাজ। জলপুলিশের ডিউটি করে কিছু পুণ্যি তো অর্জন করছি।’’ এখন অবশ্য সেই দাঁড়-টানা নৌকা নেই। মোটরচালিত লঞ্চ, জেট স্কি এসেছে। লালবাজারের এক কর্তা বলছিলেন, গোটা কলকাতার স্বাস্থ্যরক্ষাও কিন্তু করছে এই জলপুলিশই। কারণ, গঙ্গা তীরবর্তী যে সব জলশোধন কেন্দ্র রয়েছে তাদের পাহারাদার এঁরাই। গঙ্গায় কারা মাছ ধরতে আসছে-যাচ্ছে, তারও নজরদারি করেন এই উর্দিধারীরা। বজবজ থেকে বালি, গঙ্গার পাহারাদার এঁরাই।

মাছে-ভাতে বাঙালি। আর গঙ্গা মানেই মাছের স্বর্গরাজ্য। এই মাছ ধরা নিয়ে রানি রাসমণির সঙ্গে ব্রিটিশদের গোলমালের ঘটনায় ইতিহাস আর মিথ মিলেমিশে একাকার। জেলেদের মাছ ধরতে দেবে না, শুনে রানি হুকুম দিলেন, নিজের এলাকা তিনি শেকল দিয়ে ঘিরে দেবেন। ব্যস, সাহেবদের ব্যবসার তরী তো ভিড়তেই পারবে না বন্দরে। শেষমেশ রফা হল দু’পক্ষের।

কয়েক দশক আগেও গঙ্গার মাছের স্বাদই ছিল আলাদা। বর্ষীয়ান সমুদ্রবিজ্ঞানী অমলেশ চৌধুরী এক দিন আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘‘গঙ্গা থেকে কত মাছ যে হারিয়ে গেল!’’ এক দিকে দূষণ, অন্য দিকে নির্বিচারে মাছ চাষ তার কারণ। গঙ্গার ‘শাহজাদা’, ‘নবাবজাদা’ ইলিশরাও উধাও। গত বছরই যেমন জলপুলিশের এক অফিসার গঙ্গায় নৌকো থেকে কেজি দেড়েকের একটা ইলিশ কিনেছিলেন। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘মাছের সেই স্বাদই আর নেই!’’

কালের নিয়মে হারিয়ে গিয়েছে অনেক কিছু, নতুন অনেক কিছুও গজিয়ে উঠেছে। শুধু কলকাতার ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও বয়ে চলেছে গঙ্গা!

Kolkata Calcutta History River Traffic Police Water police
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy