হেমন্তের এক বিকেল। প্যারিসের এক পাড়ায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চমক, সামনেই এক ছোট্ট
খাবারের দোকানের সামনে বড় বড় করে লেখা ছবি-সহ খাবারের নাম দেখে। ছবির খাবারটিতে সেই আজন্ম পরিচিত প্যাঁচ! নামেও পড়শিপনার স্পষ্ট ইঙ্গিত। অথচ দোকানটি টিউনিসীয় খাবারের!
আমরা যারা আশির দশকে ইস্কুল থেকে কলেজগামী, তাদের কাছে ওটমিল, দুধে ফেলা কর্নফ্লেক্স বা টেট্রাপ্যাকের ফলের রস প্রভৃতি বিদেশি খাদ্য ছিল অজানা। উৎকৃষ্ট প্রাতরাশে আমাদের পাত জুড়ে থাকত লুচি-আলুর দম, সুজির হালুয়া, শিঙাড়া, জিলিপি ইত্যাদি। এই সব খাবারকে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের মতো নিতান্তই বাঙালির একান্ত বলে ভাবতে শেখা তখনই। কিন্তু টিউনিসীয় দোকানে খাবারের ছবিটি আমাদের আজন্ম পরিচিত জিলিপির, তলাতেও লেখা ‘জালাবিয়া’!
এ তো পাশ্চাত্য সভ্যতার পীঠস্থান প্যারিসে বাঙালির পরমপ্রিয় জিলিপির নিজস্ব অহংয়ে ভাগ বসানোর চেষ্টা! জিলিপির অননুকরণীয় প্যাঁচ ও মিষ্টত্ব দেখে ও চেখে বড় হওয়া চোখ প্রতিবাদ জানাতে চাইলেও, গল্প জুড়লাম দোকানের মালিক ইয়াসিনের সঙ্গে। সঙ্গী সেই জালাবিয়া আর টিউনিসীয় চা। চায়ের আড্ডায় ইয়াসিন যা জানালেন, তা চমকে যাওয়ার মতো। শুধু টিউনিসিয়া নয়, পুরো মাঘরিব অঞ্চলে (মরক্কো, আলজিরিয়া, টিউনিসিয়া ও লিবিয়া এই ক’টি আরব মুলুকে) জালাবিয়া প্রায় জাতীয় মিঠাই বলে গণ্য হয়!
জিলিপি-জালাবিয়ার আত্মীয়ই বলা যায় ইরানের মিঠাই ‘জোলবিয়া’কেও। যদিও তাতে আমাদের কলকাতার জিলিপির মতো রসের আধিক্য নেই বললেই চলে। তৈরির প্রণালীতেও ফারাক আছে। মধু আর মিহি চিনি দিয়ে মিষ্টত্ব তৈরি, আমাদের মতো রসের কড়াইয়ে ডুবসাঁতার সেখানে নেই। ‘জোলবিয়া’য় মিষ্টত্ব তৈরির পরে ছিটিয়ে দেওয়া হয় গোলাপজল আর জাফরান।
দশম শতকের আরবি লেখক আবু মহম্মদ অল বারাকের বই ‘কিতাব-অল-তাবিখ’-এ আছে জালাবিয়া তৈরির নিখুঁত প্রণালী। এ-ও বলা আছে যে, জালাবিয়া ছিল আব্বাসিদ খলিফাদের (অষ্টম-নবম শতক) সময়কার বাগদাদের জনপ্রিয় মিঠাই। ভারতবর্ষে এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় এক জৈন গ্রন্থে, পঞ্চদশ শতকে।
জিলিপির উৎস খুব সম্ভবত পশ্চিম এশিয়া বা উত্তর আফ্রিকাতেই। এই কৃতিত্বের আসল হকদার খলিফা হারুন অল রশিদের ক্ষমতাকেন্দ্র ইরাক-সিরিয়া, না তাঁর সাম্রাজ্যের প্রান্তীয় প্রদেশ টিউনিসিয়া-মরক্কো, তা নিয়ে মতবিরোধ আছে। অনেকটা রসগোল্লা নিয়ে বাংলা আর ওড়িশার মধ্যে যেমন বিবাদ, তেমনই আর কী। বোধহয় মরক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবন বতুতার সঙ্গে জিলিপির ভারতে আগমন, মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালে।
শুধু কী জিলিপি, উত্তর ভারতের এক মিষ্টি নিয়েও এমন বিভ্রাট বাধল। বসফোরাস প্রণালী পার হলেই ইস্তানবুলের ইউরোপীয় প্রান্ত থেকে তুরস্কের এশীয় অংশের শুরু। সেখানে কাদিকয় বাজারে রকমারি খাবারের বিরাট সমারোহ। এক রেস্তরাঁয় ঢুকেছি দুপুরের খাবার খেতে। বুফের মিষ্টির জায়গায় দেখি থরে থরে সাজানো এক পরিচিত মিষ্টি। উত্তর ভারতে এর নাম ‘শকরপার’। ময়দা, ঘি, বাদাম আর চিনির মিশ্রণ দিয়ে তৈরি এই বস্তুটি ক্যালরিতে ঠাসা। তাই ভারতীয় সেনাবাহিনীতে শুকনো রেশন হিসেবে দেওয়া হয়। শকরপারেরও নানা প্রকার চেখে দেখেছি— তুর্কি ‘শকরপারা’টি একটু চিনির রসে ডুবিয়ে আনলেই অনেকটা আমাদের বাঙালি গজার মতো। ইরানি শকরপারা অনেকটা উত্তর ভারতে হোলির সময় যে গুজিয়া খায়, তার অনুরূপ। তবে তুরস্ক থেকে ভারতবর্ষ অবধি, শকরপারা বলতে এই ধরনের মিষ্টিই বোঝায়। তুর্কি ভাষায় ‘শকর’ মানে চিনি, ফারসিতেও তা-ই, যাকে সংস্কৃতে ‘শর্করা’ বলে। গ্রিসে এই মিঠাইয়ের আবার নাম ‘শকরপারেস’। কিন্তু গ্রিক ভাষাতেও ‘শকর’ মানে চিনি, যা থেকে ইংরেজি ভাষা পেয়েছে ‘শুগার’।
টিউনিসিয়া, তুরস্ক পেরিয়ে এ বার আসি ঘরের কাছে, জহিরউদ্দিন মহম্মদ বাবরের জন্মস্থান উজবেকিস্তানে। তাশখন্দে ফিরোজা রঙের গম্বুজওয়ালা মিনর মসজিদের কাছে রাস্তার ধারের এক দোকান। সেখানে ত্রিকোণাকৃতি এক উজ়বেক খাদ্যবস্তু। এটির আকারও পরিচিত, উত্তর ভারতে যা ‘সামোসা’, আর আমাদের বাংলায় শিঙাড়া নামে খ্যাত। কিন্তু উজ়বেক ‘সমসা’ ভাজা নয়, তন্দুরে সেঁকা। পুরটি কী, সেই প্রসঙ্গ উঠতেই দোকানের মালিক রুস্তম বেগ জানালেন, ‘গোস্তি ওয়া পিঁয়োজ’। অর্থাৎ, মাংস আর পেঁয়াজ।

মুখরোচক: আরব মুলুকের শিঙাড়া ‘সম্বুসাক’ তৈরি হয় বেক করে বা সেঁকে।
শিঙাড়া বা সামোসা কিন্তু তুরস্ক থেকে বাংলাদেশ অবধি সর্বত্রই বহাল তবিয়তে বিরাজমান। প্রত্যেক দেশে এর স্বাদে বা প্রস্তুতপ্রণালীতে কিছু নিজস্বতা বর্তমান। আরব মুলুকে সামোসার নাম ‘সম্বুসাক’। পুর হিসেবে সেখানে থাকে কিমা, শাক বা চিজ়। সম্বুসাকের প্রথম উল্লেখ ফারসিতে লেখা ‘তারিখ-এ-বেহাকি’ বইতে, যা একাদশ শতকে ইরানে লেখা হয় সমসাময়িক গজনির সুলতান মামুদ ও তাঁর বংশের ইতিহাস তুলে ধরতে। সম্ভবত সেই সময়েই সুলতান মামুদের সেনাবাহিনীর সঙ্গে তিনকোনা এই বস্তুটির আমদানি আমাদের হিন্দুস্তানে। সম্বুসাক ভারত ও মধ্য এশিয়া অর্থাৎ কাজ়াখস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও উজ়বেকিস্তানে সামোসা নামেই পরিচিত। কিন্তু ভারতের বাইরে সম্বুসাক বা সামোসা বেকড বা সেঁকা, কখনওই ভাজা নয়।
ইবন বতুতা চতুর্দশ শতকে মহম্মদ বিন তুঘলকের ভোজসভায় এই সামোসা খাওয়ার কথা লিখে গিয়েছেন। তবে পুর হিসেবে ছিল কিমা, বাদাম, আখরোট, পেস্তা। ‘আইন-ই-আকবরি’তে আবুল ফজল বলেছেন, সামোসা হচ্ছে আদতে ইরানি ‘কুতুব’। কারণ কুতুবও ত্রিকোণাকৃতি শিঙাড়া-সদৃশ। কিন্তু সেঁকা নয়, ভাজা। আজকের ইরানে কেরমানশাহ প্রদেশের ‘কুতুব’ অতি উপাদেয় বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু সেখানে বর্তমানে বাদাম, কিশমিশ, পেস্তার পুর দেওয়া আর উপরে মিহি চিনি ছড়ানোর মিষ্টি কুতুবই খালি পাওয়া যায়। এই পুরের রকমফের দেখেছি পৃথিবীর নানা প্রান্তে। যেমন, ইজ়রায়েলের হাইফায় মিজরাহি বা বাগদাদি ইহুদি পরিবারে সম্বুসাক খেয়েছি বুট-ছোলার পুর দেওয়া। সেফার্দি বা স্পেনদেশীয় ইহুদিরা আবার সম্বুসাকে পুর হিসেবে কটেজ চিজ় দেন। তবে পশ্চিমবঙ্গে শীতকালের আলু-ফুলকপির শিঙাড়ার জিভে জল আনা যা স্বাদ, তা কি আর কোথাও মেলে!
বিশ্ব-আঙিনায় পুরের রকমফেরে যদি শিঙাড়ার গোত্রান্তর ঘটে, তবে উত্তর ভারতের গাজরের হালুয়া দেশে-দেশে বদলে যায় রংবাহারে! এ ক্ষেত্রেও প্রথম আসে তুরস্কের নাম। সেখানকার বাজারে হরেক রকম হালুয়ার রমরমা— তিলের, গমের, সুজির, আখরোট বাদাম প্রভৃতির। কিন্তু তুরস্ক নয়, বরং হালুয়ার উপরে তাঁদের দাবি নিয়ে খুবই সংবেদনশীল ইরানের লোকজন। সেখানকার হালুয়ার জাঁকজমকে সঙ্গত দেয় আটা আর তিল। সব ইরানি মিষ্টান্নে যেমন পেস্তাবাদাম, গোলাপজল আর জাফরান দেওয়া প্রায় বাধ্যতামূলক, হালুয়াতেও তার ব্যতিক্রম নেই। ইরানিদের মতে, একাদশ শতকে তুর্কিরা ইরান আক্রমণ করে এবং দুই সভ্যতার মেলবন্ধনের এক নিদর্শন হল তুরস্কে হালুয়া জনপ্রিয় হয়ে ওঠা। তিলের হালুয়া অবশ্য জনপ্রিয় দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের বলকান এলাকাতেও (সার্বিয়া, বসনিয়া)। তবে কূটনৈতিক মিষ্টত্বের এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হয়েছিল দিল্লিতে রোমানিয়ার রাষ্ট্রদূতের বাড়িতে, সেখানে খেয়েছিলাম সূর্যমুখী ফুলের বীজ দিয়ে তৈরি হালুয়া! এই দেশগুলি আসলে মধ্যযুগে অটোমান তুর্কি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাই হালুয়া খুব সম্ভবত এখানকার ইউরোপীয় রসনায় তুর্কি প্রভাবের নিদর্শন।
আসলে ‘হালুয়া’ কথাটা আরবি। এর অর্থ মিষ্টি। সপ্তম শতকে ইরানে খেজুর আর দুধ দিয়ে তৈরি এক ধরনের মিষ্টান্নকে হালুয়া বলা হত। দশম শতকে লেখা ‘কিতাব অল তাবিখ’-এর কথা আগেই বলা হয়েছে জিলিপির প্রসঙ্গে। আরও একটা ‘কিতাব অল তাবিখ’ (তাবিখ মানে রান্না আর কিতাব হচ্ছে বই। অর্থাৎ, সোজা কথায় রান্নার বই) লেখেন মহম্মদ বিন হাসান অল বাগদাদি, সেটা ত্রয়োদশ শতকে। সেখানেও হরেক রকম হালুয়ার উল্লেখ আছে। আরবি ও ইরানি বণিকরাই সম্ভবত হালুয়া নিয়ে আসেন ভারতের বন্দর শহরগুলিতে। তাই কেরলের কোঝিকোড় ও সিন্ধুপ্রদেশের করাচি বন্দরনগরী হালুয়ার জন্য প্রসিদ্ধ।
সুলতানি আমলে হালুয়া ভারতের অন্য প্রান্তেও ছড়িয়ে পড়ে। ষোড়শ শতকে আইন-ই-আকবরি থেকে জানা যায় যে, বাদশাহ আকবর তাঁর জীবনের শেষ পঁচিশ বছর মাংস পরিহার করে নিরামিষাশী হয়ে যান। সেই সময় তাঁর খাদ্যতালিকায় বিবিধ প্রকার হালুয়া অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জাহাঙ্গিরের রাজত্বকালে এসেছিলেন ব্রিটিশ দূত টমাস রো। তাঁর সঙ্গেই এসেছিলেন যাজক, এডওয়ার্ড টেরি। তাঁর লেখা সাক্ষ্য দেয়, হালুয়া আর রুটি হিন্দুস্তানের সাধারণ মানুষের জনপ্রিয় প্রাতরাশ।
হালুয়ার সঙ্গে ধর্মের যোগাযোগও বহু দিনের। ইদের সময় নানা মিঠাই আরব দেশে রাস্তায় রাস্তায় বিক্রি হয়। হালুয়াও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু জন্ম, বিবাহ, অন্ত্যেষ্টি প্রভৃতির সময় নিমন্ত্রিতদের হালুয়া দিয়ে আপ্যায়ন করাই তুরস্কে রীতি। নওরোজ বা প্রাক্-ইসলামি ইরানের নববর্ষ এখনও পশ্চিম এশিয়ার নানা স্থানে পালন করা হয়। ইরান, তুরস্ক ও আজারবাইজানে হালুয়া নওরোজ়ের অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ। এমনকি গ্রিসে অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্মে লেন্ট ও অন্য উপবাসের দিনে যখন আমিষ পরিহার করার নিয়ম রয়েছে, ঘরে ঘরে সুজির হালুয়া রান্না হয় সে দিন।
পারস্য ও আরবদেশ থেকে আসা হালুয়া কবে ভারতবর্ষের মন্দিরে মন্দিরে প্রসাদ হিসেবে চালু হয়, তা ঠিক জানা যায় না। শিখেদের গুরুদ্বারে আটার হালুয়া ‘কাড়া প্রসাদ’ হিসাবে দেওয়া হয়। মাদুরাইতে মীনাক্ষী মন্দিরে পাওয়া যায় কাজুবাদামের হালুয়া। গুজরাতে কৃষ্ণমন্দিরে সুজির হালুয়া প্রসাদ পরিচিত ‘মোহনলাল’ নামে। বঙ্গদেশে সুজির হালুয়া যখন জন্মাষ্টমীর প্রসাদ হিসেবে দেওয়া হয়, তখন তার নাম ‘মোহনভোগ’।
এ বার আসি লুচি আর সুজির হালুয়ার যুগলবন্দির কথায়। জম্মুর কাছে বৈষ্ণোদেবীর মন্দিরে আটার পুরি আর হালুয়া প্রসাদ হিসেবে দেওয়ার চল আছে। তবে ময়দার লুচি আর হালুয়া প্রসাদ হিসেবে বাংলার বাইরে একটি জায়গাতেই পাওয়া যায়। তা হল কাশ্মীরের ক্ষীরভবানী মন্দিরে। সেখানেও একে লুচিই বলে। লুচি বাংলা ও কাশ্মীর দুই প্রদেশেই লুচি নামেই পরিচিত এবং এই দুই রাজ্য ছাড়া অন্য কোথাও লুচির প্রচলন স্থানীয় দৈনন্দিন খাদ্য হিসেবে অন্তত দেখা যায় না। গৌড়বঙ্গ ও কাশ্মীরের মধ্যে এই রন্ধন সংক্রান্ত যোগসূত্র কবে কী ভাবে স্থাপিত হল, তা জানা নেই বটে, কিন্তু আমাদের রসনা যে কত দেশ, জনপদ ও সাম্রাজ্যের মহামিলনের মহাতীর্থ, তা সম্পর্কে একটা ধারণা তো পাওয়া যায় অবশ্যই।
শেষে পান্তুয়া দিয়ে মধুরেণ সমাপয়েৎ করা যাক। একেই যে উত্তর ভারতে ‘গোলাপজামুন’ বলে সে তো অনেকেরই জানা। কিন্তু দুবাই বা দোহায় রমজানের সময় ‘লুকমা’ বা ‘লুকমাৎ’ বলে যে মিঠাইটি বিক্রি হয়, সেটি পান্তুয়ারই আরবি সংস্করণ। শুধু আকারটি একটু ছোট, আর সম্পূর্ণ গোলাকৃতি না হয়ে বর্তুলাকার, উপবৃত্তাকার বা গোদা বাংলায় ধ্যাবড়ানো চেহারাও ধারণ করে! বিদ্বজ্জনেরা বলেন যে, ত্রয়োদশ শতকে বাগদাদে এই মিঠাই ‘লুকমা-অল-কাজি’ বা কাজি সাহেবের মিঠাই বলে বিক্রি হত। মোগল আমলে পারস্য থেকে সম্ভবত এটি হিন্দুস্তানে আসে। হুমায়ুন, শের শাহ সুরির কাছে পরাজয়ের পর পারস্যের সম্রাট শাহ তহমাস্পের রাজসভায় আশ্রয় নেন। পনেরো বছর পরে তিনি যখন সিংহাসন পুনর্দখলের জন্য ফিরে আসেন, তাঁর ফৌজের সিংহভাগ ছিল ইরানি, এবং তাদের সঙ্গেই গোলাপজামুনের ভারতে আগমন। ইরানে চিনির রস ও গোলাপজলের সংমিশ্রণ এই ডিম্বাকার মিঠাইয়ে মাখানো থাকত বলেই বোধহয় এর নাম গোলাপজামুন। প্রসঙ্গত, গ্রিসে এই একই বস্তু ‘লুকমাডেস’ নামে পাওয়া যায়।
দ্বাদশ শতকে কর্নাটকে চালুক্যরাজ সোমবর্ষের রাজত্বকালে রচিত ‘মানসউল্লাস’ গ্রন্থে পান্তুয়া বা গোলাপজামের অনুরূপ এক মিঠাইয়ের প্রস্তুতপ্রণালী পাওয়া যায়। তবে তাতে গোলাপজলের উল্লেখ নেই। তাই এটাও হতে পারে যে, আরবি লুকমাৎ আর ভারতীয় পান্তুয়ার উৎপত্তি আলাদা। ইরানি প্রভাবে পরবর্তী কালে গোলাপজল ব্যবহার শুরু হয় ও সেখান থেকে গোলাপজামুন নামটি আসে। আবার এ-ও হতে পারে যে, ভারতেই পান্তুয়ার উৎপত্তি ও এখান থেকেই তা পশ্চিম এশিয়ায় গিয়েছিল। ইরানে তাতে গোলাপজলের সুবাস যোগ করা হয় শুধু। তার পরে তা ইরান ঘুরে গোলাপজলসমৃদ্ধ হয়ে জম্বুদ্বীপে ফেরত আসে মোগলদের হাত ধরে।
অর্থাৎ, একটা কথা বলাই যায় যে, গ্রিস, আরব দেশ বা ইউরোপ থেকে ভারতবর্ষ, সামাজিক জীবনে যে সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা নিত্য বহমান, তারই বিশেষ রূপ লগ্ন হয়ে আছে খাদ্যবস্তুতেও!
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)