Advertisement
০৮ নভেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব ২৭
Bengali Literature

মায়া প্রপঞ্চময়

একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মধ্যে ভালবাসা নীতি-নিয়ম, সমাজ-সংসার, জাত-ধর্ম কিচ্ছু মানে না। একটা মানুষের অভাবে সব কিছু অর্থহীন বলে মনে হয়।

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ

কানাইলাল ঘোষ
শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০২০ ০০:১৪
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: দুয়ারিবাবু, লোহারবাবুদের ষড়যন্ত্রের জাল কেটে কেমন করে সে বার বেঁচে গিয়েছিলেন বোসস্যর, সে কথা একান্তে তাঁর মুখ থেকেই শুনেছিল বেন্দা। সে বুঝতে পারেনি বোসস্যরের মতো মানুষের জীবনে এমন কী দুঃখ থাকতে পারে, যার জন্য তিনি আর বাঁচা-মরার পরোয়া করতেন না! স্মৃতিচারণ শেষে বর্তমানে ফেরে বেন্দা। রেঞ্জ অফিসে বোসস্যরের বান্দোয়ানে আসার সময় জানতে গিয়ে রেঞ্জার সাহেবের মুখে এক মারাত্মক দুঃসংবাদ শোনে সে। বোসস্যরের বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে, তাঁর বাঁচার সম্ভাবনা খুব কম।

অচেনা ছেলেটার মাথায় আদ্যিকালের লম্বা বেতের বাঁটওয়ালা একটা ঢাউস কালো রঙের ছাতা, তাতে আবার একটা তাপ্পি। হাতের সামনে এমন একটা মুরগা! অন্নুর মুখ চুলবুলিয়ে উঠল, বিশেষত সর্দার হিসাবে মেয়েদের মানসিক ভাবে চাঙ্গা করার একটা দায় থেকেই ও বলে উঠল, ‘‘আরে আরে! দেখ তো, ইয়ে নমুনা কৌন আসমান সে গিরা! এক হি ছতরিসে পুরা পটনা ঢাক যায়েগি! ক্যা বলুঁ ইসকো, গিরি গোবর্ধনধারী ইয়া যশুরে কৈ?’’ মা-দিদিমার কাছে সে শুনেছিল, দেহের তুলনায় বড় মাথার জন্য বিদ্যাসাগরকে ছোটবেলায় যশোরের মাথাসর্বস্ব কইমাছের সঙ্গে তুলনা করা হত।

সামান্যই নির্দোষ রসিকতা। ছেলেটা চলে গেলেই পারত, তা না করে ওই অলম্বুষ ছাতা মাথায় নিয়েই বোঁ করে ঘুরে দাঁড়াল। এক ঝলক পরস্পরকে দেখল ওরা, অন্নু দেখতে পেল একটা ঝাঁকড়াচুলো মাথা আর রোদে-পোড়া শ্যামবর্ণ মুখে জ্বলজ্বলে দু’টো চোখ। অতগুলো মেয়ে দেখে ঘাবড়াবে কোথায়, তা নয়, প্রথমে ঠোঁটের কোণে একটু বাঁক ধরল তাচ্ছিল্যের, তার পর শুনতে পাওয়া যাবে এমন নিচু গলায় বলে উঠল, ‘‘হাঁথি চলে বাজার, খোঁকি ভুকে হাজার! ইয়ে মেরা পিতাজি কা প্যার কে নিশানি হ্যায়, কোই অ্যয়রা-গ্যয়রা নাত্থু খ্যৈরা ইস কা মজাক না উড়ায়ে... খবরদার!’’ তার পরই যেন কিছুই হয়নি এমন ভাবে সোজা জ়ুলজি ডিপার্টমেন্টের বারান্দায় গিয়ে উঠল।

কথাগুলো শুনেই অন্নুর ফরসা মুখটা টকটকে লাল হয়ে উঠেছিল, তাতে নুনের ছিটে দিল ঊর্মিমালার ফোড়ন, ‘‘হ্যাঁ রে, কী বলে গেল বেতমিজ ছোকরাটা, ‘খোঁকি’ বলল, না ‘খেঁকি’ বলল? দু’টোই তো সমান অপমানজনক! তার পর যা বলল, তাতে তো আর ছেলেমহলে মুখ দেখানো যাবে না আমাদের! তুই কিছু জবাব দিলি না কেন?’’

জবাব দেবে কী, আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট, পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট করে রিসার্চ শুরু করতে যাচ্ছে, এতগুলো বছরে এই তল্লাটে ওর মুখের উপর কেউ এ ভাবে বলতে পারে, এটাই অন্নুর মাথায় আসেনি কখনও। এখন পিছনে ধাওয়া করে গিয়ে কৈফিয়ত চাওয়ার মানে হয় না, তাই থমথমে মুখে শুধু বলল, ‘‘ঠিক হ্যায় লাল্লু, আমারও দিন আসবে, তখন কড়ায়-গণ্ডায় উশুল করে নেব এই অপমানের বদলা!’’

আধ ঘণ্টার মধ্যে খবর পাওয়া গেল, ছেলেটা এখানকার নয়, পশ্চিমবঙ্গাল থেকে এসেছে। স্পেশ্যাল একটা স্কলারশিপ পেয়েছে ন্যাশনাল লেভেলে, সেই সুবাদেই ন্যায্য ইন্টারভিউ দিয়ে জ়ুলজির একটা ল্যাবে জুনিয়র ফেলো হিসাবে জয়েন করেছে। ওকে ক্রস করার পর ঘাম মুছতে মুছতে এইচওডি নাকি বলেছেন, ‘‘এ কী ছেলে রে বাবা! আমরা কোথায় ওকে প্রশ্ন করব, উল্টে ক্যান্ডিডেটই তো আমাদের ইন্টারভিউ নিল মনে হচ্ছে যেন!’’ বাকি মেম্বাররাও আলোচনা করেছেন যে, বাধ্য হয়ে যোগ্যতার ভিত্তিতে একে নেওয়া হল বটে, কিন্তু সুবোধ স্কলারদের প্রহ্লাদকুলে এই দৈত্য না গাইডকেই মিসগাইড করে অদূর ভবিষ্যতে!

ছেলেটাকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনি অন্নু, ফলে ওর দলের সবাই একটু আশাহত হয়েছিল সাময়িক ভাবে। দু’-চার দিনের মধ্যেই দেখা গেল, ছেলেটা ল্যাব আর মেস, মেস আর লাইব্রেরি— এর বাইরে কিছু করে না। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা, তাদের নিয়ে ঘোরা বা গল্পগুজব করা, নিদেনপক্ষে রাস্তার দাঁড়িয়ে হাঁ করে মেয়ে দেখা— এগুলোর কোনওটাই নয়। দলের মেয়েদের প্রেমিক বা প্রেমপ্রার্থী ছেলে তো বেশ কিছু আছেই, তাদের মারফত জানা গেল যে, অবসর সময়ে হয় চাকরির পরীক্ষার জন্য লেখাপড়া করে, নয়তো গল্পের বই নিয়ে বসে থাকে। দু’-এক জন বাদে ওর বন্ধু বা হিতৈষী কোনও ছেলে নেই বরং একই রকমের কাজ করে ওর স্কলারশিপ বাবদ ছেলেটা অন্যদের তিনগুণ ফেলোশিপ পায়, সেই জন্যে অনেকেরই ওর উপর রাগ আছে। কেবল এক জনই ওর বন্ধু, হাকলা সজ্জনকুমার যাদব। ছেলেটা রাম-তোতলা।

অন্নুর তখন ওই ধরনের একটা ফালতু ছেলেকে নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই মোটেও। ওর মনের আয়নায় তখন প্রীত হি প্রীত। যেমন গ্রিক ভাস্কর্যের মতো গৌরবর্ণ, সুঠাম চেহারা, তেমনই পয়সাওয়ালা ঘরের ছেলে প্রীত। দু’জনের জুড়িও তেমনই রাজযোটক। ফার্স্ট ইয়ার থেকেই আলাপ, কিছু দিনের মধ্যেই প্রেম। পাঁচ ক্যারাটের ওরিজিনাল একটা এমারেল্ড কাট সলিটেয়ার ডায়মন্ড রিং দিয়েই প্রথম প্রোপোজ় করেছিল প্রীত সিং তদানীন্তন অনামিকা ত্রিবেদীকে, প্রথম ‘অন্নু’ বলে ডেকে। প্রীত মাস্টার্স করা পর্যন্ত চার বছর অন্য কোনও দিকে তাকায়নি। তার পর বাড়ির লোক ওদের সম্পর্কে জেনে যাওয়ায়, ওরা দু’জনে ওদের বাবা-মাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করায়। তার পর নিজের ক্ষমতায় পারিবারিক হিরের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হতে প্রীত যখন পটনা ছেড়ে হীরের খনির দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা পাড়ি দিল, তখন অনামিকা এম এসসি ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। বিয়ের আগে সময় কাটানোর সঙ্গে-সঙ্গে একটা ডিগ্রি নেওয়ার জন্যেই ও অ্যানথ্রোপলজির ল্যাবে জয়েন করেছে। ওই যে নতুন ছেলেটা, যার ডাকনাম মানিক আর ভাল নাম অনিকেত, প্রায় একটা চালচুলোহীন কাকতাড়ুয়া বলতে গেলে, তাকে নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কোথায় ওর? ও তো তখন একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নে মশগুল!

দিন সাতেকের মধ্যেই দ্বিতীয় বার ছেলেটার মুখোমুখি হতে হল। এরই মধ্যে মনের ঝাল মেটাতে অন্নু ওর নাম দিয়েছে শুকদেব। দিদিমার কাছে ব্যাসদেবের মানসপুত্র এবং ভাগবত-পুরাণের ব্যাখ্যাকার শুকদেবের জন্মকথা আর কাজকর্মের বিবরণ সে শুনেছে। সে জানে, ব্যাসের সামনে মেয়েরা লজ্জায় শরীর ঢাকা দিলেও তরুণ শুকদেবকে নিয়ে কারও কোনও জড়তা ছিল না, শুকদেব মেয়েদের আলাদা করে গ্রাহ্যই করত না। তো, সেই শুকদেব ওরফে মানিক সে দিন সামনে পড়ে গেল ওর। একটা লজ্‌ঝড়ে ভাঙা সাইকেল কোথা থেকে জোগাড় করেছে এর মধ্যে, তার সামনের রডে সজ্জনকে বসিয়ে নিয়ে কোথায় যেন চলেছে। অন্নুর কিছুটা আগে এক দল মেয়ে কলকল করতে-করতে রাস্তা জুড়ে চলেছে, আর অভ্যেসবশত সজ্জনও হাঁ করে তাদের দেখছে। মেয়েগুলো যখন সামনে ছিল তখন ঠিক ছিল, যখন পাশে এল তখনও সজ্জনের জন্যে মানিকের তেমন অসুবিধে হয়নি, কিন্তু ওরা পাশ কাটিয়ে অনেকটা চলে যাওয়ার পরও সজ্জন একশো আশি ডিগ্রি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখা চালিয়ে যেতেই বিপত্তিটা ঘটল। অন্নুর ঠিক সামনেই টলমল করতে করতে সাইকেল আর সজ্জনকে নিয়ে উল্টে পড়ছিল ও, কোনও মতে লম্বা পা বাড়িয়ে সম্পূর্ণ পতনটা ঠেকাল। তার পরই সজ্জনকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘‘এতই যখন মেয়ে দেখার শখ, তখন একটা চট পেতে রাস্তার ধারে বসে পড়ো আর প্রাণ ভরে সারা দিন ধরে মেয়ে দেখে যাও! আমার সাইকেলে তোমার জায়গা হবে না এখন থেকে। মেয়েরা ঈশ্বরের কী এমন অপূর্ব সৃষ্টি! আদেখলে কোথাকার!’’

ব্যাপারটা অন্নু পার্সোনালি নিল, বিশেষ করে কটু মন্তব্যটা যেন ওকে দেখে ইচ্ছাকৃত ভাবে করা হয়েছে বলে মনে হল ওর। মুখের মতো জবাব দিতে গিয়েও সামলে নিতে হল। এখন ও একা, আর ছেলেটার চালচলন বলে দিচ্ছে যে, সুন্দরী আর ব্যক্তিত্বময়ী হওয়ার যতটা সুযোগ এ যাবৎ অন্যদের কাছ থেকে ও পেয়ে এসেছে, তার এক ভগ্নাংশও এর কাছে আশা করা যাবে না। মনে-মনে আবার শপথ নিল যে, সময় এলে এ-সবের শোধ ও কড়ায়-গণ্ডায় মিটিয়ে শিক্ষা দেবে বেয়াদব ছোকরাটাকে।
সুযোগটা আসতে একটু বেশিই সময় লাগল। ওর স্পষ্ট মনে আছে দিনটার কথা। অগস্টের শেষ দিকে শুক্রবার ছিল রাখিবন্ধনের দিন। সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতে ওই দিন অন্য বছরের মতোই একটা ডিবেটের আয়োজন করা হয়েছিল। বিষয়বস্তুটা ছিল একটু অদ্ভুত, ‘মহব্বত বড়ে কাম কি চিজ় হ্যায়!’ এটার উপর আলোচনা ওর কাছে তখন কোনও ব্যাপারই নয়, কারণ বিগত কয়েকবছর ধরে সত্যিকার ভালবাসাকে ও গুলে খেয়েছে বলে ওর দৃঢ় বিশ্বাস। ফলে পক্ষে নিজের নাম লেখাল, আর স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে দলের নেত্রীও হল।

বিতর্ক শুরু করতে গিয়ে উদ্যোক্তারা একটু সমস্যায় পড়লেন। বিপক্ষে দলই তৈরি করা যাচ্ছে না ঠিক মতো। কারণ যারা নাম দিয়েছিল, তারা এক-এক করে নিজেদের নাম উইথড্র করে নিয়েছে, পক্ষে অনামিকা লিডার আছে দেখে। ওর এবং ওর দলের কাছে বেইজ্জত হতে কারই বা ইচ্ছে করবে? ফলে আনকনটেস্টেড ওয়াকওভার হয়ে যাচ্ছে দেখে সকলে জোড়াতালি দিয়ে চার জনের নামের একটা লিস্ট তৈরি করল, যাতে দু’টো নাম এল অনিকেত ওরফে মানিক আর হাকলা সজ্জনকুমারের। বিপক্ষের নামগুলো দেখেই প্রাজ্ঞজনরা আগেই সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলেন যে, বিপক্ষ দল শুধু যে গো-হারা হারছে তা-ই নয়, অনামিকার দল ওদের চূড়ান্ত অপদস্থ করতে চলেছে।

শুরু থেকেই হাঁকিয়ে খেলতে থাকল পক্ষের দল, প্রেমকে এক স্বর্গীয় পর্যায়ে তুলে নিয়ে গেল সকলে মিলে। দুনিয়ার যত হিট প্রেমকাহিনি একটা একটা করে উদাহরণ দিয়ে প্রায় প্রমাণই করে ফেলা হল যে, মহব্বত বড়ে কাম কি চিজ় হ্যায়। উত্তরে খুব পানসে ধরনের যুক্তি উপস্থাপন করা হল বিপক্ষের তরফ থেকে, যা সঙ্গে-সঙ্গে চিৎকার করে থামিয়ে তার বিরুদ্ধ-যুক্তি খাড়া করা হতে লাগল অনামিকাদের পক্ষ থেকে। সজ্জন তো কথা শুরু করতে না করতেই খেই হারিয়ে ফেলল শুধু কথা আটকে যাওয়ার জন্য। শেষ বক্তা হিসাবে মানিক এল ক্রিকেটের নাইট ওয়াচম্যানের মতো। দায় রক্ষা করতে হয় তাই বলা, অনামিকা-সহ প্রায় সকলেই তত ক্ষণে ধরে নিয়েছে যে দু’-এক মিনিটেই মানিকের দম ফুরিয়ে যাবে।

মানিক শুরু করল এই ভাবে, ‘‘পৃথিবীতে নির্বিকল্প প্রেম বা মহব্বত বলে কিছু হয়ই না, যেটা হয় তা মনের বিকারমাত্র। কোনও এক জন ব্যক্তির নিজের অস্তিত্বের সঙ্গেই জড়িত থাকে তার পারিপার্শ্বিক, তার প্রেম-ভালবাসা। সে নিজে আছে বলেই তার প্রিয়জনদের প্রতি তার আকর্ষণ, প্রেম, প্রীতি। আসলে তাদের ভালবাসার ছলে সে নিজেকেই ভালবাসে। প্রিয় কারও সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটলে বা ঘনিষ্ঠ কেউ মারা গেলে মানুষ কষ্ট পায়, কারণ সেই প্রিয় কেউ বা কিছু তার সঙ্গে আর থাকবে না। ঘরের পোষা পাখি মারা গেলেও এই অনুভূতি থেকেই চোখে জল আসে। এ সবই মায়ার খেলা!’’

অনামিকা তখন প্রবাসী প্রীতের বিরহে কাতর, এই ধরনের যুক্তি শুনে ওর শরীর চিড়বিড়িয়ে উঠল, তাই থাকতে না পেরে বলে উঠল, ‘‘পাগলের কুযুক্তি যত সব, এর জানা নেই প্লেটোনিক লাভ বলে একটা কথা আছে, একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মধ্যে ভালবাসা নীতি-নিয়ম, সমাজ-সংসার, জাত-ধর্ম কিচ্ছু মানে না। একটা মানুষের অভাবে সব কিছু অর্থহীন বলে মনে হয়। সব সময় তার চিন্তাই মাথায় ঘুরতে থাকে, নিজের খিদে-তেষ্টার প্রতি লক্ষ্যই থাকে না। এই সমস্ত লক্ষণগুলো বুঝি কিছু নয়? সবই এই সবজান্তার মায়ার খেলা!’’

বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে মুখে একটা একপেশে হাসি এনে মানিক উত্তর দিল, ‘‘ঠিক কথা, এই লক্ষণগুলো বিরহের উপসর্গ। সেই আদিযুগের ব্যাস-বাল্মীকি থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে কালিদাসের মেঘদূত বা আধুনিক যুগের নেড়ানেড়ির প্রেম— সর্বত্র এই ক্লিশে বর্ণনার ছড়াছড়ি। কিন্তু এ সব উপসর্গ আপেক্ষিক, সব নির্ভর করছে মনের তাৎক্ষণিক অবস্থা আর নিজের অবস্থানের উপর। ধরে নিচ্ছি, কোনও দৃষ্টিহীন পুরুষ এক মহিলার সুরেলা গান শুনে তার প্রেমে পড়লেন, কিন্তু যদি সে চোখে দেখতে পেত যে, তার মনের মানুষটার একটাও দাঁত নেই, উপরন্তু বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো আছে একমুখ দাড়ি, তার পরও কি তার প্রেম থাকত, নাকি ভিরমি খেয়ে বাস্তবের মাটিতে আছড়ে পড়ত? এ ক্ষেত্রে কান তার সঙ্গে প্রতারণা করলেও চোখ কিন্তু তাকে মায়ার ছলনা থেকে গদ্যময় পৃথিবীতে হ্যাঁচকা টানে নামিয়ে আনত। কিংবা, ফোনে আধো-আধো মিষ্টি কথা শুনে এক কিশোর যাকে কিশোরী মনে করে হৃদয় দিয়ে বসেছে, সে যখন তার মানসীর আসল বয়স পঞ্চান্ন বছর বলে জানবে, তখনও কি তার দরদ একই থাকবে? প্লেটোনিক লাভ তখন লোকসানের হিসেব কষবে না তো?’’
মানিকের দেওয়া অদ্ভুত উদাহরণগুলো আর তার উপস্থাপনার ভঙ্গি উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে হাসির আলোড়ন তুললেও অনামিকা জেদ ছাড়ল না, ‘‘বাঃ, বেশ-বেশ, প্রেমিক-প্রেমিকা বাদ দিলাম, বাবা-মা-ভাই-বোনের মধ্যে যে প্যার-মহব্বত... তাকেও কি এ ভাবে লাভ-লোকসানের নিক্তিতে হিসেব করা যায়?’’ অদ্ভুত নিরাসক্ত একটা হাসি হাসল মানিক, ‘‘পুরোটা না হলেও কিছুটা তো বটেই, সে জন্যেই তো দুর্ভিক্ষ বা প্রবল দারিদ্রে বাবা-মা ছেলেমেয়েকে বিক্রি করছে, এমন উদাহরণ অজস্র আছে। আজও কাগজ খুললে দেখা যাবে বৃদ্ধ, অথর্ব বাবা-মাকে তাঁদের সন্তান রাস্তায় বসিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছে। চরম দারিদ্র বা পরম লোভ তখন প্যার-মহব্বতের সংজ্ঞা ঠিক করে দেয়। তাই আমার মতে ‘মহব্বত বেকার বেদাম কি চিজ় হ্যায়, ইয়ে সির্ফ নাম কি চিজ় হ্যায়’... নাথিং মোর অ্যান্ড নাথিং এলস!’’

দর্শকমণ্ডলী এবং আলোচনার পক্ষে আর সবাই মানিকের বক্তব্যের যথার্থতা আর অস্বীকার করতে পারছিল না, যতই শুনতে খারাপ লাগুক না কেন, শুধু অনামিকা ছাড়া। ও কিছুতেই মানতে পারছিল না যে, এক বার ভালবাসা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে মনের আর কোনও পরিবর্তন সম্ভব, ও তো ভাবতেই পারে না যে ও প্রীতকে বা প্রীত ওকে কখনও ভুল বুঝতে পারে, সে যে পরিস্থিতিই হোক না কেন! অথচ এই বদ ছেলে সমানে বিষয়টাকে যেন গুলিয়ে দিচ্ছে। প্রেমে আর যুদ্ধে অন্যায় বলে কিছু নেই, এই নীতি মেনে অনামিকা অনেক রকম ভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেল দীর্ঘ ক্ষণ ধরে, কিন্তু ক্রমশই আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠল মানিক। কখনও শ্রীমৎ শঙ্করাচার্যের মায়াবাদ, কখনও চার্বাকের বস্তুবাদ, কখনও মহাকাব্য-পুরাণ থেকে উদাহরণ টেনে এনে নিজের যুক্তিকে কঠিন ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করে চলল।

বারবার প্রতিহত হয়ে ঘেমে-রেগে অগ্নিশর্মা অনামিকা শেষে বিলো-দ্য-বেল্ট হিট করে বসল, ‘‘আসলে যাদের জীবনে প্রেম-ভালবাসা বলে কিচ্ছু নেই, সেই হতভাগারাই এই বিরুদ্ধাচরণ করার ছেঁদো যুক্তি খাড়া করছে। সত্যিকার স্বর্গীয় ভালবাসা বা ডিভাইন লাভ মানুষকে অন্ধ ভাবে বিশ্বাস করতে শেখায়। যাদের আগে-পিছে কিচ্ছু নেই, তারা আঙুরফলকে তো টক বলবেই, কিন্তু শকুনের অভিশাপে যেমন গরু মরে না, তেমনই এই সব অলক্ষুণে মানুষদের ভুল ভাবনার জন্যে মহব্বত কখনওই বেকার-বেদাম হবে না।’’

মানিক বেশ স্পোর্টিংলি নিল মন্তব্যগুলো, তার পর খুব সংক্ষেপে দু’টো গল্প আর একটা কবিতার কথা বলল— তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অগ্রদানী’ আর ‘তারিণীমাঝি’, রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’। তার পর শোনাল অপত্যস্নেহের সীমা নির্ধারণের এক পরীক্ষার কাহিনি— মানুষ নয়, তবে মানুষের কাছাকাছি প্রজাতির এক মা ও সন্তানের মধ্যে চিরন্তন ভালবাসার মাপকাঠি কী এবং কতটা। এক মা-বানরকে তার সদ্যোজাত সন্তানের সঙ্গে এক গভীর শুষ্ক কূপের মধ্যে রেখে ক্রমাগত জল ঢালা হল। মা সন্তানকে প্রথমে কোলে, তার পর কাঁধে এবং শেষে মাথার উপরে তুলে জল থেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে গেল। কিন্তু যখন আর উপায় নেই, তখন বাচ্চাকে জলে ফেলে সাঁতার কেটে শুধু নিজেকে বাঁচাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আপনি বাঁচলে অন্যের নাম, এই আপ্তবাক্য মানব ও মানবেতর প্রাণীর ক্ষেত্রে কমবেশি একই রকম প্রযোজ্য।

বক্তব্য শেষ করতে গিয়ে মানিক অনামিকার দিকে না তাকিয়েই বলল, ‘‘আমার দুর্ভাগ্য যে, মাঝে-মাঝেই আমার বলা কথা ফলে গিয়ে আমায় বিড়ম্বনায় ফেলে। উপরন্তু, অপ্রিয় সত্যি বলার বদ অভ্যাসও মজ্জাগত, তাই আমার প্রিয়জনরা ব্যাজস্তুতির ছলে আমাকে দুর্বাসা ওরফে দুর্ভাষা বলেও ডাকে৷ আমার প্রাজ্ঞ প্রতিপক্ষ মহব্বত সম্পর্কে যতটা জানেন, জীবনের চরম সত্যি সম্বন্ধে তার ভগ্নাংশও হয়তো জানেন না। ঈশ্বর না করুন, নিষ্ঠুর জীবন যদি কখনও তাঁকে এমন এক মোড়ে এসে দাঁড় করিয়ে দেয়, যেখানে পেয়ার-মহব্বত বনাম প্রাত্যহিক দেনা-পাওনার বাস্তবের দ্বন্দ্ব লাগে এবং দু’টোর মধ্যে কোনও একটাকে বেছে নিতে হয়, সে দিন সত্যিই অগ্নিপরীক্ষা হবে, আর আমার বিশ্বাস সে দিনও বাস্তববোধ জয়ী হবে মানসিক দুর্বলতাকে দশ গোলে হারিয়ে। কেন যেন মনে হচ্ছে, হয়তো আমিও তার প্রত্যক্ষদর্শী থাকব। আজকে এখানেই আমার বক্তব্য শেষ করে জনগণের রায়ের প্রতীক্ষায় রইলাম।’’

(ক্রমশ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Literature Seral Novel Kanailal Ghosh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE