Advertisement
০৭ মে ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ২৩
Bengali Story

দৈবাদিষ্ট

জরাসন্ধ আত্মবিস্মৃতের মতো শিরসঞ্চালন করেছিলেন। তার পরেই অশীতিপর বৃদ্ধ নিষাদ অনোমদর্শীর কম্পিত, স্খলিত কণ্ঠস্বরে তাঁর সংবিৎ ফিরেছিল আবার।

ছবি: রৌদ্র মিত্র।

ছবি: রৌদ্র মিত্র।

সৌরভ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০২২ ০৯:৩৯
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: একলব্য নিরুদ্দেশের পর, নিষাদরাজ হিরণ্যধনু এবং তাঁর পত্নী বিশাখার কাছে এসেছিলেন মগধরাজ জরাসন্ধ। নীরবে শুনেছিলেন তাঁদের বিলাপ, অভিযোগ। অপরাধবোধ গ্রাস করেছিল তাঁকে। অন্য দিকে, দ্রোণের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল দ্রুপদ এসে উপস্থিত হয়েছেন যমুনার তীরে, ব্রহ্মর্ষি উপযাজের আশ্রমে। তাঁর প্রার্থনা, উপযাজ তাঁর জন্য পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করুন, যা থেকে তিনি একটি পুত্রলাভ করবেন, দৈবাদেশে যেন সেই পুত্রই হয় দ্রোণের হত্যাকারী।

নিজ অন্তরের বিচারালয়েই দণ্ডিত হচ্ছিলেন জরাসন্ধ, ব্যথাতুর পিতামাতার সম্মুখে দাঁড়িয়ে। তিনি নিজেও পিতা। নিজ পুত্রের তরুণ মুখচ্ছবি ভাসিত হচ্ছিল মনশ্চক্ষে। আজ যদি একলব্যের পরিবর্তে সহদেব...

জরাসন্ধ আত্মবিস্মৃতের মতো শিরসঞ্চালন করেছিলেন। তার পরেই অশীতিপর বৃদ্ধ নিষাদ অনোমদর্শীর কম্পিত, স্খলিত কণ্ঠস্বরে তাঁর সংবিৎ ফিরেছিল আবার।

“মহারাজ! যদি অন্তত প্রাণটি যাওয়ার আগে নিজের প্রতিশোধটি নিয়ে যাওয়ার সুযোগটুকু পেত এক বার সে ছেলে...! যে লোক তার জীবনটা নষ্ট করল, তার উপর শোধ নেবে, এই তো ছিল তার বাঁচার লক্ষ্য। বলেছিল, দ্রোণের কাটা মাথাটি হাতে নেওয়ার আগে সে মরবে না!... আপনি তাকে দ্রোণের বিরুদ্ধে খড়্গ তোলার সুযোগটিই দিলেন না, মহারাজ... তার সাধনা পণ্ড হয়ে গেল... এখন সেই অতৃপ্ত ইচ্ছের জ্বালা নিয়ে সে ছটফট করবে যে প্রভু! মুক্তি পাবে না...”

শিহরিত হয়ে উঠেছিলেন সম্রাট। সত্য, সত্য বলছে প্রবীণ ব্যাধ! অতৃপ্ত আত্মা কি তাঁকেও অবিরত প্রশ্ন করতে আসবে না, নিদ্রায় জাগরণে?

অস্থির কণ্ঠে জরাসন্ধ বলেছিলেন, “আমি তার শান্তিকামনায় বিরাট যজ্ঞ করব। শ্রেষ্ঠ পুরোহিতদের দিয়ে আহুতি দেওয়াব। আমি তার আত্মাকে জ্বালামুক্ত করব...”

আবার চিৎকার করে উঠেছিল বিশাখা, “কী যজ্ঞ করবেন প্রভু! তার তো শেষ কাজটি পর্যন্ত করা হয়নি! তার মরা মুখটাই তো দেখতে পেলেম না...”

কথা শেষ করতে পারেনি একলব্যের মাতা। ধুলায় লুটিয়ে পড়েছিল।

জরাসন্ধ বিস্মিত ভ্রু আর জিজ্ঞাসু চোখে পার্শ্ববর্তী অমাত্যের দিকে তাকিয়েছিলেন। অনুচ্চস্বরে সে জানিয়েছিল, “দেহটি পাওয়া যায়নি। সম্ভবত বন্য পশুতে ভক্ষণ করে ফেলেছে। গিরিকন্দরের মধ্যে নিহত হয়েছিল কি না! আরও গভীরে কোথাও টেনে নিয়ে গিয়ে... খুব বেশি অনুসন্ধানও সম্ভব হয়নি গুপ্তচরদের পক্ষে, শত্রুরাজ্য...”

মগধ-রাজসভাগৃহে প্রৌঢ় করঞ্জাক্ষর কণ্ঠ এখনও ধ্বনিত হচ্ছে। এখনও তিনি পাঠ করে চলেছেন বিভিন্ন দেশের বিচিত্র সংবাদ সব। সিন্ধু থেকে প্রাগ্‌জ্যোতিষ, গান্ধার থেকে সিংহল...

জরাসন্ধ মুখ তুললেন এক বার। ধীর, নিস্তেজ কণ্ঠে বললেন, “পশ্চিমদেশ থেকে গুপ্ত-অনুসন্ধানকারীরা ফিরেছে?”

“হ্যাঁ, মহারাজ,” প্রধান অমাত্য একটু নত হলেন। বললেন, “কিন্তু দেহটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। যদিও অনুমিত ঘটনাস্থল থেকে বেশ কিছু দূরে, জঙ্গল-গুল্মে পূর্ণ এক গভীর খাদের মধ্যে উৎকট পচন-গন্ধ মিলেছে। সম্ভবত মাংসলোভী গৃধ্ররা ওখানেই...”

শ্বাস ফেললেন জরাসন্ধ, “ঘটনার আর কোনও বিশদ বিবরণ?”

“হ্যাঁ, মহারাজ। দ্বারকায় তো উৎসব চলছে। বিবাহের উল্লাসে মুখরিত নগরী। তার মধ্যেই চারণেরা গান বেঁধে গাইছে, বিজয়ী কৃষ্ণের গৌরবগাথা! কী ভাবে যাদব-বীরেরা শত্রুদেরপথেই প্রতিরোধ করল, কী ভাবে রুক্মীর দর্পচূর্ণ করল কেশব, আর তার পর কী ভাবে বাধাদানকারী নিষাদ একলব্যকে...”

“এই সব বলছে, গানে?”

“হ্যাঁ, রাজন! পাহাড়ের নির্জন অন্তরালে নিয়ে গিয়ে চতুর কৃষ্ণ নিষাদের মস্তকটি চূর্ণ করে দেয় প্রস্তরখণ্ডের আঘাতে! এমনই গাইছে চারণকুল...”

জরাসন্ধ উঠে দাঁড়ালেন সিংহাসন থেকে। মুহূর্তের জন্য তাঁর নেত্রে পাবক-স্ফুলিঙ্গ দেখা দিল, চোয়াল হল বজ্রকঠিন, সর্বাঙ্গের পেশি ফুলে উঠল এক বার। দন্তে দন্ত চাপলেন, বললেন, “এই ঋণটিও যুক্ত হল রে, কপট যাদব! পরিশোধ করতে হবে তোকে, স্মরণে রাখিস!”

“কিন্তু, মহারাজ...” করঞ্জাক্ষ কিঞ্চিৎ দ্বিধাগ্রস্ত ভঙ্গিতে বলেন, “অভয় দেন তো বলি— প্রকৃত ঘটনা নিয়ে আমাদের গূঢ়পুরুষদের মধ্যেই ঈষৎ সংশয় ও মতান্তর রয়েছে। অন্য একটি সূত্র থেকে কিছু রহস্যময় তথ্য উঠে এসেছে...”

“মতান্তর!... রহস্যময় তথ্য!” জরাসন্ধ ভ্রু কুঞ্চিত করলেন, “কী তথ্য?”

“এক জন, এক জন মাত্র গুপ্তচর... অতি গূঢ় বিশ্বস্ত সূত্র থেকে এমন আভাস পেয়েছে যে, একলব্যের নিধনের রটনাটি হয়তো বা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার! সে নাকি জীবিত এবং কৃষ্ণের আশ্রয়েই লুক্কায়িত।”

“আশ্রয়ে! কৃষ্ণের আশ্রয়ে!”

“সূত্রের সংবাদ, রৈবতকেরই অতি গোপন কোনও স্থানে— সম্পূর্ণ নিজের কর্তৃত্বে ধূর্ত কৃষ্ণ তাকে গোপন করে রেখেছেন! সূত্রটি অবশ্য অসমর্থিত, মহারাজ। কারণ, প্রমাণ বা সাক্ষ্য মেলেনি, শুধু শ্রুতি।”

জরাসন্ধ আবার বিভ্রান্ত হয়ে আসনে বসে পড়েন। অস্ফুটে, যেন নির্বোধের মতো, বলেন, “লুক্কায়িত... কৃ-ষ্ণে-র আশ্রয়ে! কৃষ্ণের আ-শ্র-য়ে! কিন্তু... কেন হে? কেন?”

৩৮

দ্বিপ্রহর যখন অপরাহ্নের দিকে ঢলে পড়ছে, শিষ্যরা যখন সমিধ-আহরণে অরণ্যের অভ্যন্তরে চলে গিয়েছে, সেই নির্জন ক্ষণে ঋষি উপযাজের তটিনী-তীরস্থ আশ্রমে এক সন্ন্যাসী উপস্থিত হলেন। মধ্যমদেহী, মুণ্ডিতমস্তক, গৈরিক বাস। জানালেন, তিনি তৃষ্ণার্ত। পানীয় জল প্রার্থনা করেন।

উপযাজ তাঁকে পাত্র থেকে জল ঢেলে দিলেন, অঞ্জলিভরে তা পান করে সন্ন্যাসী হাসলেন। বললেন, “সামান্য কিছু নিবেদন ছিল, হে ব্রহ্মর্ষি। কিঞ্চিৎ গূঢ় কথা। যদি অনুমতি করেন, কুটিরাভ্যন্তরে গিয়ে স্বল্পক্ষণ আলাপন সম্ভব?”

একটু বিস্মিত হয়েই আগন্তুককে কুটিরে নিয়ে গিয়ে বসালেন ঋষি। তাঁর অনুরোধমতো, দ্বারও রুদ্ধ করলেন। সন্ন্যাসী অনুচ্চ কণ্ঠে বললেন, “প্রথমে পরিচয় দিই। আমি প্রকৃত সন্ন্যাসী নই, পূজ্যপাদ! আমি পশ্চিমপ্রদেশের রৈবতক-সন্নিহিত দ্বারাবতী নগর থেকে এসেছি। আমার নাম জম্বুক, আমি যাদব-শ্রেষ্ঠ মহান বাসুদেব কৃষ্ণের বার্তাবহ।”

ঋষি উপযাজের মুখে বিস্ময় ও সম্ভ্রম যুগপৎ ফুটে উঠল, “বাসুদেব কৃষ্ণ! যিনি বৃন্দাবন থেকে মথুরায় গিয়ে কংসনিধন করেছিলেন?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ, বিপ্রশ্রেষ্ঠ! সম্প্রতি তিনি পশ্চিমসমুদ্রলগ্ন দ্বারকায় নতুন রাজধানী স্থাপন করেছেন। তিনি আপনাকে সশ্রদ্ধ প্রণাম-সহ এক গুপ্তবার্তা পাঠিয়েছেন।”

“আমাকে!”

“সান্দীপনী মুনির আশ্রমে তিনি যখন শিক্ষারত ছিলেন, আপনার সঙ্গে তাঁর এক বার সাক্ষাৎ হয়েছিল কি?”

“হ্যাঁ, আমার স্মরণে আছে,” বলেন উপযাজ, “তিনি অল্প বয়সেই অসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সান্দীপনী আমাকে জনান্তিকে বলেছিলেন, ইনি বৈষ্ণব-গোষ্ঠীর নেতৃপদে আসীন হতে চলেছেন অচিরে। এমনকি, তিনি স্বয়ং শ্রীহরির অবতার, ঋষিদের মধ্যে এমন গুঞ্জনও শুনেছি আমি।”

সন্ন্যাসীবেশী জম্বুক যুক্তহস্ত ললাটে ছোঁয়াল। তার চক্ষু নিমীলিতপ্রায়, কণ্ঠ গদগদ। সে বলল, “তিনিই সাক্ষাৎ বিষ্ণু, মানবদেহ পরিগ্রহ করেছেন। এতে কোনও সন্দেহ নেই। আপনি তাঁর নানাবিধ লীলার বিষয়ে শুনে থাকবেন। যমুনা-সন্নিহিত নানা ক্ষেত্রই তাঁর লীলাভূমি ছিল।”

জম্বুকের বিমগ্ন ভক্তিব্যঞ্জক শরীরী ভাষা ও উপযাজকে প্রভাবিত করে। তাঁরও দুই করতল স্বতঃই যুক্ত হয়ে ওঠে। তিনি সসম্ভ্রমে বলেন, “আমি জানি, তিনি পূতনা তৃণাবর্ত বৎস বক অঘ প্রভৃতি বিপ্রদ্বেষী রাক্ষস-রাক্ষসী নিধন করে ঋষি-মুনিদের অশেষ উপকার করেছেন। শুনেছি এই মহামানব গো-কল্যাণে গিরিযজ্ঞ করেছিলেন, দুর্ধর্ষ কালীয়কে দমন করে যমুনাকে নিরাপদ করে তুলেছিলেন তিনিই। পাপী কংসকেও তিনিই বিনাশ করেছেন। মনে হয়, তাঁর মধ্যে ঐশ্বরিক শক্তি থাকা অসম্ভব কিছু নয়...”

“কৃষ্ণস্তু ঈশ্বরঃ স্বয়ম্‌!” জম্বুক এ বার প্রায় স্তোত্রপাঠের ভঙ্গিমায় বলে, “গো-ব্রাহ্মণের হিত শুধু নয়, সমগ্র জগতের হিতের জন্যই বাসুদেব কৃষ্ণের আবির্ভাব। ধীরে ধীরে পূর্ণ প্রভায় প্রকট হচ্ছেন বিষ্ণু-অবতার, অচিরেই সমগ্র জগৎ সেই লীলায় উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। আমরা সৌভাগ্যবান, যে তাঁর সঙ্গে এক বাতাসে শ্বাস নিতে পারি, তাঁর পদস্পৃষ্ট ভূমিতে আমরাও হেঁটে বেড়াই!”

জম্বুকের বাকপটুতা অতুলনীয়। উপযাজকেও ক্ষণিকের জন্য আবিষ্ট দেখায়। তিনি মাথা নেড়ে বলেন, “অবতার!... অসম্ভব নয়। যুগে যুগে তো অধর্ম-নিরাকরণে তাঁর আবির্ভাব, সেই মৎস্য-কূর্ম থেকে নৃসিংহ আদি... শাস্ত্রেই বলা আছে... সত্যই!”

“হে পরম-মান্য ঋষিশ্রেষ্ঠ উপযাজ,” জম্বুক এ বার খুব বিগলিত কণ্ঠে বলে, “এই মহান বাসুদেবই আপনার কাছে একটি গূঢ় বার্তা পাঠিয়েছেন। সমগ্র আর্যাবর্তের ভবিষ্যৎ কল্যাণ-সম্পর্কিত একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা আছে তাঁর— আপনাকে তার একটি ক্ষুদ্র ভূমিকা নিতে তিনি অনুরোধ করেছেন।”

“আর্যাবর্তের ভবিষ্যৎ!”

“হ্যাঁ! আপনি দেখতে পাচ্ছেন না ব্রহ্মর্ষি, দেশব্যাপী পাপস্রোত বৃদ্ধি পাচ্ছে? বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন খণ্ডে শির উন্নত করছে নীতিহীনের অনাচার, শক্তিমত্তের অত্যাচার? ধর্মপালনের পরিবেশ বিনষ্ট? সাধুদের দুর্গতি, দুষ্কৃতীদের পরাক্রম? বেদ-বেদাঙ্গের প্রভায় উজ্জ্বল যে-আর্যাবর্তের গরিমা একদা ধর্মপালক ঋষিদের হাত ধরে তুঙ্গ স্পর্শ করেছিল, যে আর্যসমাজ এক দিন ন্যায়, জনহিত আর আধ্যাত্মিক চেতনার পরাকাষ্ঠা হতে পেরেছিল, দুরাচার ক্ষত্রিয় আর পাষণ্ড অনার্যদের অতি-আস্ফালনের কারণে আজ তার চরম অধঃপতন ঘটেছে— এ কি আপনার চোখে পড়েনি?”

কৃষ্ণের যোগ্যতম দূত জম্বুক। কে বলবে সে কয়েক সপ্তাহ আগেই নিষাদপল্লিতে চর্মব্যবসায়ী হয়ে কালযাপন করে এসেছে, কিংবা ভিক্ষুক হয়ে মগধের রাজপথে ভিক্ষা করেছে! এই মুহূর্তে প্রভুর বার্তা সে এমন ভাবে উপস্থাপিত করছে, এমন মর্মস্পর্শী তার বাগ্মিতা— যেন স্বয়ং যদুনাথের ওজস্বী ভাষাভঙ্গিই সে অবিকল তুলে এনেছে! বস্তুত, তাকে যথেষ্ট সময় ধরে এ বিষয়ে শিক্ষিত করেছেন কৃষ্ণ। তবু, অন্য যে কেউ হলে এতটা নৈপুণ্যের সঙ্গে এই সব শব্দবন্ধ প্রয়োগ করতে পারত না আদৌ।

উপযাজও সম্মত হতে দেরি করেন না। বলেন, “ঠিক, ঠিক! দেশের আজ দুর্দিন...”

জম্বুক বলে, “তাই দেশহিতৈষী কেশব এক প্রকাণ্ড পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। ধীর কিন্তু অভ্রান্ত, সুদীর্ঘকাল ব্যাপী কিন্তু অমোঘ, আপাত-চাতুর্যে ভরা কিন্তু পরিণামে মহৎ ও ঐতিহাসিক! তিনি বস্তুত এক সমাজ-বিপ্লব চাইছেন— বর্তমানের অধর্মপীড়িত নৈরাজ্যময় চিত্রের পরিবর্তে এক সুস্থির, স্থিতধর্ম ও সু-রাজক ব্যবস্থা। তার জন্য বহু ধ্বংসের প্রয়োজন, পাশাপাশি বহু নির্মাণ!”

ঋষিকে বিভ্রান্ত দেখায়, “এমন মহৎ ও বিপুল বিষয়ে আমার মতো তুচ্ছ ব্যক্তির...”

“তুচ্ছ নন, ব্রহ্মর্ষি! আপনি সেই বিপুল বিস্তারিত মহাপ্রকল্পের এক স্তম্ভ হয়ে থাকবেন। ভাবীকাল আপনার দিকে তাকিয়ে, পূজ্যপাদ! একমাত্র আপনি ব্যতীত সেই গূঢ় অংশটি আর কেউ নিষ্পন্ন করতে পারবে না। ভেবে দেখুন, সমগ্র জম্বুদ্বীপে একমাত্র আপনার পক্ষে সেই কর্ম সম্ভব— স্বয়ং ঈশ্বরাবতার বৈষ্ণবাবতংস বাসুদেব আপনাকে মনোনীত করেছেন! আর এই শুভ দৌত্যটির জন্য সেই পশ্চিম-সমুদ্রতট থেকে এই যমুনাতীরে আমি, তাঁর দাস— ছুটে এসেছি, শত বিঘ্ন অতিক্রম করে, ছদ্মবেশে!” জম্বুকের স্বর আবেগে কম্পিত এখন, “ইতিহাস আপনাকে আহ্বান করছে, ঋষিবর, বিধাতা আপনার দ্বারে প্রার্থী! বিবেচনা করুন!”

“কিন্তু... কিন্তু... কর্মটি কী? কী সেই গূঢ় অথচ যুগান্তকারী দায়িত্ব? যা এই উপযাজ বিনা কারও সাধ্য নয়... কী এমন ব্যতিক্রমী দুরূহ কর্তব্য?”

মুহূর্তের মধ্যে জম্বুক তার কণ্ঠ ও বাচন পরিবর্তিত করে ফেলে। আর আবেগাপ্লুত নয়, এখন তার গম্ভীর বুদ্ধিদীপ্ত ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়, সে এক বিজ্ঞ অধ্যাপক, শিক্ষার্থীকে গূঢ় তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে বোঝাচ্ছে! ধীর অথচ দৃঢ়, অনুচ্চ অথচ সম্মোহক স্বরে সে বলে, “তবে শুনুন। অতি গোপন এবং জটিল এই পরিকল্পনা। কূটনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজবিপ্লব— সব কিছুর এক অভাবিত সমন্বয়। বিস্ময়কর, বহুমাত্রিক, সুদূরপ্রসারী! একমাত্র বিরল-ধীমান ও কালদ্রষ্টা মহামানব ভিন্ন এমন ভাবনার স্তর আর কারও পক্ষে সম্ভবই নয়। আমরা সাধারণ মানুষেরা হয়তোসেটির সামগ্রিক উপলব্ধি বা গরুড়াবলোকন করতেই পারব না। আপনিও না, আমিও না! আমরা যেটুকু পারি, তা হল, বিনা প্রশ্নে অখণ্ড আনুগত্যে সেই সর্বনিয়ন্তার নির্দেশ পালন, আমাদের জন্য নির্দিষ্ট খণ্ড-দায়িত্বগুলির সাধন। তাতেই দেশের ও দশের কল্যাণ!”

সম্মোহিতই যেন বা হয়ে পড়েছেন ঋষি। গাঢ়স্বরে বললেন, “নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই! আমি আমার যথাসাধ্য করব। এখন আমাকে পরিকল্পনাটির কথাও বলুন— আমার নির্ধারিত দায়িত্বটির কথাও! আমি বিশদে সব শুনতে উৎসুক!”

কয়েক মুহূর্তের একটু বিরতি নেয় জম্বুক। ঈষৎ নাটকীয় বিরতি। তারপর একটু এগিয়ে আনে তার মুখ, বলে, “রাজা দ্রুপদের যজ্ঞটি কিন্তু হওয়াচাই, ঋষিবর!”

“যজ্ঞ!”

“হ্যাঁ, দ্রোণ-বধার্থ পুত্রেষ্টি! যা আপনি প্রত্যাখ্যান করে চলেছেন, এই এক মাস যাবৎ! সেটিতে আপনাকে সম্মত হতে হবে। বাসুদেব তেমনই চান।”

বিহ্বল মুখে উপযাজ বলেন, “বাসুদেব কী ভাবে এ সংবাদ...”

“তিনি সর্বজ্ঞ, ত্রিকালদর্শী,” জম্বুক সামান্য হেসেই প্রসঙ্গে ফিরে যায়, “পাঞ্চালের এই যজ্ঞটির উপর দাঁড়িয়ে আছে সমগ্র দেশের ভবিষ্যৎ। বাসুদেবের সমস্ত পরিকল্পনার কেন্দ্রীয় ভিত্তি হবে এই যজ্ঞ— আপনি হবেন শুধু এই যজ্ঞটিরনয়, আগামী দিনের মহান যুগ-পরিবর্তনেরও ঋত্বিক! ভারতেতিবৃত্তে আপনার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে!”

“যজ্ঞ...! এই যজ্ঞের এত বিশাল গুরুত্ব! বুঝলাম না। আগে শুনি পরিকল্পনাটির সম্পূর্ণ স্বরূপ!”

“নিশ্চয়ই!” জম্বুক আরও একটু সন্নিহিত হয়ে বসে, তার পর বলতে শুরু করে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Story Bengali
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE